Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের নিষ্ফল হাহাকার

প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে এখনো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এ ব্যাপারে গত ১৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের পুনরুচ্চারণ ২০ মে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই তা কারো মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। বলতে হয়, বিশ্বশক্তি হিসেবে ক্ষীয়মান ভাবর্যাদার এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কথা আগের মতো আর মূল্য পাচ্ছে না। তাই তা উপেক্ষা করা বা সে কথাকে গুরুত্বের সাথে না নেওয়া মোটামুটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন এ অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ আর দশটি সাধারণ কথার বেশি গুরুত্ব পায়নি।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভীতিকর সামরিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আবির্ভাব ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ঊনিশ শতকে বিশ্বে সুপার পাওয়ার ছিল ব্রিটেন। বিশ শতকে দু’ দু’টি বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় দেশটি কাবু হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে তার দুর্বলতা উন্মোচিত হতে থাকে। আর সেই ফাঁকে শক্তির থাবা ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে অর্থ ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমার অধিকারী দেশ হওয়ার কারণে তার প্রাধান্য অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। আণবিক বোমা এ সময় অস্তিত্ব ও মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, তারপর ব্রিটেন, পরে ফ্রান্স ও তারও পরে চীন পারমাণবিক বোমার অধিকারী দেশে পরিণত হয়। তবে সামরিক শক্তিতে আমেরিকার সাথে টক্কর দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রায় গোটা বিশ্বই পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে বেশ বিপাকে পড়ে। শুরু হয় শক্তির প্রতিযোগিতা। কোরিয়া উপদ্বীপ, সুয়েজ খাল, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি ইস্যুতে দু’ বিশ্বশক্তির মধ্যে চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জ, পরোক্ষ লড়াই চলে। সবকিছুর পর যা সর্বস্বীকৃত সত্য হয়ে দাঁড়ায় তা হলো এই যে, যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের একমাত্র শক্তি যে প্রয়োজনবোধে স্বল্প সময়ের নোটিশে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে তার সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ও অস্ত্র সাহায্য তার অতীব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অস্ত্রে পরিণত হয়। এ অবস্থায় অনেক দরিদ্র ও ছোট দেশই ঋণ ও অস্ত্রলাভের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। গোটা বিশ শতক ধরেই এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। এখনো মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কাছে কোনো কোনো দেশকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে দেখা যায়। যেমন পাকিস্তান। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে, একুশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভিত্তিতে উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান, সামরিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার পুনরুত্থান এবং আগামী পরাশক্তি হিসেবে চীনের পশ্চাতে ভারতের আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়া বিশ্ব ভূরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তারই পরিণতিতে দেখা যায়, সউদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে, পাকিস্তান বিকল্প নির্ভরতার সন্ধান করছে চীনের কাছে, বাংলাদেশ এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল নয় ইত্যাদি।  
এ পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ আজ অনেকের কাছেই পাত্তা পায় না। আর বিদ্যমান বাস্তবতা স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র তা মেনেও নিচ্ছে বলে দেখা যায়। তাই ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল সেটি ছিল একতরফা নির্বাচন। সে নির্বাচনের পরই তাকে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আখ্যায়িত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সকলদলের অংশগ্রহণভিত্তিক একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাগাদা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এ বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কীÑ এ মর্মে এক সাংবাদিকে প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জন কিরবি ১৮ মে বলেন, আমরা এখনো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই। আমরা এখনো চাই বাংলাদেশের মানুষেরা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাতে অংশ নিতে পারে।
এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অবস্থান। গত দু’বছরে তাদের এ অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানকে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার গুরুত্ব দেয়নি, দেয় না, তা সবারই জানা। আরেকজন মার্কিন বিশ্লেষক এ বিষয় আলোকপাত করেন অন্য প্রসঙ্গের আলোচনায় গিয়ে। তিনি হলেন বাংলাদেশে সাবেক মার্কিন রাষ্টদূত, বর্তমানে ওয়াশিংটনস্থ উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র বিশ্লেষক উইলিয়াম বি. মাইলাম। ১৯ মে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যাকা- ও উগ্রবাদের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নিজ মত তুলে ধরেন তিনি। মাইলাম বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি আলোচিত হত্যাকা-ের সাথে সন্ত্রাসবাদের চেয়ে সুশাসনের বিষয়টিই বেশি জড়িত। ২০১৪ সালে সর্বশেষ নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নই বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটিয়েছে। আর এ কারণেই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে কার্যত এক দলের রাষ্ট্র বানিয়েছে। সরকারের কথিত আইন প্রয়োগের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বিএনপি। রুটিন মাফিক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আইন বিভাগ ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগ। মাইলাম বলেন, বাংলাদেশের সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের বিষয়টিকে চাপা দিয়ে রাখার জন্য সকল প্রকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ হচ্ছে ছাইচাপা আগুনের মতো। সরকার নানা প্রয়াসে এটাকে ছাই দিয়ে ঢাকে, কিন্তু হঠাৎ করেই আবার তা বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যে কোনো আলোচনা-পর্যালোচনায় এ নির্বাচনের বিষয় এসে যায়। যেমন গত ৭ জুন বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক হয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরে অনুষ্ঠিত এ বিতর্কে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বাংলাদেশে বিতর্কিত নির্বাচনের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ বিতর্কে দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘অর্থবহ সংলাপে’ বসার আহ্বান জানানো হয়। বিতর্কে ইতালির নারী রাজনীতিক, ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট , ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ফেদেরিকা মগেরিনির পক্ষে বক্তব্য রাখেন নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্ট কোয়েন্ডার্স। বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি এবং স্থানীয় আঞ্চলিক সংঘাতের প্রসঙ্গ নিয়ে নির্ধারিত বিতর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর এখন অর্থবহ সংলাপে বসার সময় হয়েছে। তিনি বলেন, এখনি এই সংলাপ হওয়া দরকার। কোয়েন্ডার্স বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুরোপুরি সুরক্ষা ও বিকাশের লক্ষ্যে সামগ্রিকভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, সহনশীলতা ও রাজনৈতিক বিতর্কের লক্ষ্যে উন্মুক্ত পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বিচারে গ্রেফতার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের হয়রানি এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।
বার্ট কোয়েন্ডার্স বলেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিরোধী দলের বর্জন করা বিতর্কিত নির্বাচনের সমালোচনা করার পর থেকেই দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিতর্কের উপসংহারে তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ প্রবণতা বন্ধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেডা বলেন, ২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশে অনেক আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেখানে আমরা নির্বাচনী প্রতিনিধিদল পাঠাই। নির্বাচন বয়কটের ফলে বড় ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিনিধিদলের চেয়ার জ্যাঁ ল্যাম্বার্ট বলেন, শক্তিশালী সুশীল সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার সুরক্ষাকারী সংগঠনগুলোর ওপর নিপীড়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি অধিকার-এর প্রসঙ্গ টানেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, অনেক বেশি সাংবাদিককে কারাগারে যেতে দেখছি আমরা।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য জোসেফ ওয়াইডেনহোলজার বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিপজ্জনক গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও নাকচ করে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক দুই শিবির একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হয়ে পড়েছে। সহিংসতা বাড়ছে। অন্যরা আছে যারা এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে সচেষ্ট। মানবাধিকার রক্ষকদের প্রতি আচরণ খারাপ হচ্ছে। তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে।   
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি ও মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য আমজাদ বশির বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা অবশ্যই একটি সার্বভৌম দেশের নিজস্ব ব্যাপারে নাক গলাতে পারি না। কিন্তু সহিংসতাকে নিন্দা জানানো ও রাজনৈতিক সংলাপের জন্য উৎসাহিত করার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফেরার বাস্তব সম্মত উপায় হলো, দেশটির নেতৃস্থানীয় দলগুলোকে সত্যিকারের নেতৃত্ব দেখাতে হবে যাতে করে দেশটিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে বের করে আনা যায়। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের একমাত্র উপায়।
এক্ষেত্রে নীতির অস্পষ্টতার কারণে আন্তর্জাতিক অবস্থানে যে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে সে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার বলে মনে করে। তারা মনে করে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের ভাষায় গণতন্ত্রকে পঙ্গু করে দিলেও এবং ২০১৪ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সরকার বহাল থাকলেও তারা কথামালার বেসাতি ছাড়া গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের উপর কোনোই চাপ সৃষ্টি করছে না। ফলে তাদের এসব উদ্বেগ প্রকাশের কোনো সুফল আশা করা যায় না। এটি যেমন সরকারের জন্য বিব্রতকর নয়, তেমনি বাংলাদেশের ক্ষুব্ধ ও সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার মানুষদের জন্যও আশাব্যঞ্জক কিছু নয়।
বাংলাদেশে আমরা যারা বাস করি, এ দেশের অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। অন্যরা দেশের লোকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ও তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির যে মূল্যায়ন করে তা শতভাগ পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কথা নয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এ বিতর্কেও তাই বাংলাদেশের সব বিষয় উঠে আসেনি। যেমন গুম, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। কিংবা এ বিতর্কে সদ্য সমাপÍ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সর্বশেষ রেশটুকুও ধুয়ে-মুছে ফেলার কথা আসেনি। বহু মানুষ মনে করেন, বাংলাদেশ এখন এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে যেখানে যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা যাদের ক্ষমতা নেই তাদের কোনো কথা বলতে দেয় না। ক্ষমতাহীনদের সত্যকে প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। যদি বা সত্য কোনোভাবে প্রকাশিত হয়, নির্দেশে চলা বা প্রভাবাধীন প্রশাসনের কাছে তা গুরুত্ব পায় না। মাঝে মধ্যে উচ্চ আদালতে অন্যায়ের প্রতিকার মেলে, সেটুকুই শুধু ভরসা। কিন্তু অনস্বীকার্য যে এ পর্যায়ে যে বিপুল ব্যয় ও সময় প্রয়োজন হয়, সে কারণে অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া হয়ে ওঠে না। এদেশে এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, সরকারি দল ও তাদের সমর্থকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যকে সম্মান প্রদান করেন না বা ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে কোনো কথা বলেন না। তারা যা বলেন সবই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। দলের, দলীয় ব্যক্তির স্বার্থ ও অবস্থানের বাইরে আর কোনো কিছুই তাদের কাছে গ্রহণীয় বা কাম্য নয়। তারা জেনেশুনেই বাস্তব ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন। সবচেয়ে বড় কথা, তারা চান না যে তাদের প্রতি কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হোক।   
২০১৬ সালে এসে দেশের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আর কোনো নৈতিক অপরাধ বোধ করে না। আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত সে নির্বাচনের পর একাত্তর টিভির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এটি একটি ম্যান্ডেট বিহীন নির্বাচন। এ বছরের মধ্যেই আরেকটি নির্বাচন হবে। তবে তাঁর এ কথা ছিল তার আরো অনেক কথার মতই কথার কথা। কিছুদিনের মধ্যে বিএনপির নিষ্ক্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার ভোল পাল্টে ফেলে। তারা আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ সরে আসে। যাহোক, আন্তর্জাতিক বিশ্ব সে নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন করে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন বোধ করলেও তার জন্য সরকারের উপর কার্যকর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে চায় না। তাই তাদের কথা শুধু কথামালাতেই পর্যবসিত। তারা এখন দৃষ্টি দিচ্ছে ২০১৯ সালের নির্বাচনের দিকে। সে নির্বাচনও নিশ্চিতভাবে যে এবারের ইউপি নির্বাচনেরই আরেকটি সংস্করণ হবে, বিএনপিকে যে কোনোভাবেই হোকÑ সে নির্বাচনের সম্ভাব্য সুফল লাভ থেকে বঞ্চিত করার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে মর্মে যে আশঙ্কা এখনি ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব বিষয় তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পাবে বলে জোর দিয়ে বলা যায় না। বাংলাদেশের জনগণের অধিকাংশই ২০১৪-র নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। ইউপি নির্বাচনে এবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অবস্থান সবারই জানা। তাদের ভাষায়, ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩৫ জন মানুষের মৃত্যু আর ১০ হাজার লোকের আহত হওয়া তাদের কারো কাছে কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও আগামীতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য চেহারা দেশের বেশিরভাগ মানুষ আঁচ করে নিতে পারেন।



 

Show all comments
  • Rabbi ১৮ জুন, ২০১৬, ৪:২৩ পিএম says : 0
    nice article
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের নিষ্ফল হাহাকার
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ