Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান ১০ লাখ টাকা জরিমানা

চিকিৎসাসেবা অনির্দিষ্টকাল বন্ধ , রোগীদের চরম দুর্ভোগ

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

সেই ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গতকাল (রোববার) সকাল থেকে টানা ৪ ঘণ্টার অভিযান চালানো হয়।
এদিকে ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান শুরুর খবর পেয়ে বিএমএ ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি সভা থেকে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে লাগাতার ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতি। বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিকদের এ কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করার মধ্যদিয়ে আবারও সাধারণ রোগীদের জিম্মি করেছে ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ।
জানা যায়, মেহেদীবাগের ম্যাক্স হাসপাতাল ও নগরীর প্রবর্তক মোড়ের বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআর এবং জিইসি মোড়ের মেট্রোপলিটন হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব।
অভিযানে ম্যাক্স হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) অনুমোদনহীন ওষুধ, অস্ত্রোপচারে মেয়াদহীন সার্জিক্যাল আইটেম। প্যাথলজি ল্যাবে কোন পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে রিপোর্ট। ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্সেরও মেয়াদ শেষ দুই বছর আগে। প্যাথলজিতে নেই কোন মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফার্মেসিতে নেই ফার্মাসিস্টও। শতাধিক র‌্যাব সদস্যের উপস্থিতিতে অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারোয়ার আলম। তাকে সহযোগিতা করেন ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ডা. দেওয়ান মোঃ মেহেদী হাসান ও ওষুধ প্রশাসন চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক গুলশান জাহান। বেশ কয়েকটি অপরাধে ক্রটিপূর্ণ লাইসেন্সে অদক্ষ চিকিৎসক ও নার্স দ্বারা পরিচালিত হাসপাতালটিকে তাৎক্ষণিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। চিকিৎসা সেবায় নানা ক্রটি সারাতে বেঁধে দেওয়া হয় ১৫ দিন সময়।
নগরীর প্রবর্তক মোড়ের বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, অপারেশন থিয়েটারে মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল আইটেম, লাইন্সেসবিহীন ফার্মেসি পরিচালনাসহ নানা অনিয়মের দায়ে এ জরিমানা করা হয়। এছাড়া ভবিষ্যতে এসব অনিয়ম দূর করতে হাসপাতালটিকে সতর্ক করে দেয়া হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, সেখানে বেশ কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে। অপারেশন থিয়েটারে কিছু সার্জিকাল আইটেম পাওয়া গেছে যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। কিছু কিছু আইটেমের মেয়ার শেষ হয়েছে ২০১২ সালে। এছাড়া হাসপাতালের দুইটি ফার্মেসির মধ্যে একটির লাইসেন্স নেই বলে জানান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক গুলশান জাহান।
অভিযান শেষে হাসপাতাল চত্বরে জনাকীর্ণ এক প্রেসব্রিফিংয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ম্যাক্স হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, হাসপাতালটির মূল সমস্যা হলো বিভিন্ন ভুইফোঁড় বা অখ্যাত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে সেগুলো ম্যাক্স হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের প্যাডে প্রিন্ট করে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অর্ধেক দামে অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করিয়ে এনে রোগীদের কাছ থেকে তার জন্য দ্বিগুণ দাম নেওয়া হচ্ছে। যা রোগীদের সাথে প্রতারণা। রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন স্যাম্পল কালেকশন করে তারা চট্টগ্রাম ও দেশের বাইরের বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়। অনেকটা কমিশন এজেন্টের মত তারা কাজ করেন। অথচ রোগীরা তাদের বিশ্বাস করেই এখানে মেডিকেল টেস্ট করান। দেশের বাইরে স্যাম্পল পাঠাতে সরকারি অনুমোদন লাগে। কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তারা এসব নমুনা বিদেশে পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, একজন নমুনা সংগ্রহ করছে, অন্যজন পরীক্ষা করছে আবার অ্যানালাইসিস করা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এভাবে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে ম্যাক্সের ল্যাবে। এগুলো আসলেই পরীক্ষা হয়েছে কি না সেটাই তো নিশ্চিত না।
তিনি বলেন, হাসপাতালের প্যাথলজিতে কোনো মাইক্রোবায়োলজিস্টকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে এইচএসসি পাস লোকজন চাকরি করছে। এখানে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রিধারী বা বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্নদের কাজ করার কথা। একটা হাসপাতাল চালাতে হলে অবশ্যই নমুনা পরীক্ষার নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে সেটা তাদের নেই। অভিযানে ম্যাক্স হাসপাতালে এপিক হেলথ কেয়ার, ল্যাব এইড, পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টার, ডা. লাল প্যাথ ল্যাব, প্যাথ কেয়ার ল্যাব ও সিগমা ল্যাব লিমিটেডে করানো বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে বলেও জানান ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।
ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তা গুলশান জাহান বলেন, ম্যাক্স হাসাপাতালের অষ্টম তলায় নিজস্ব ফার্মেসির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এতদিন লাইসেন্সবিহীন চলছে। হাসপাতালে অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট নেই। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজিস্ট্রেশন নম্বরও নেই।
র‌্যাবের অভিযান শুরু হতেই চিকিৎসকদের সেবা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা প্রসঙ্গে সারোয়ার আলম বলেন, কেউই আইনের উর্দ্ধে নয়। চিকিৎসা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। চিকিৎসকরা এই অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। সরকারের চেয়ে ক্ষমতাশালী কেউ নেই। চিকিৎসকরা আইন মানতে বাধ্য।
হঠাৎ চিকিৎসা সেবা বন্ধে রোগীদের চরম দুর্ভোগ
ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের প্রতিবাদে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিকদের পক্ষ থেকে। আর এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবা এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেবা বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন রোগীরা। বিকেল থেকেই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় ডায়গনস্টিক সেন্টারের সেবাও।
চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার থেকে ফিরে যাচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে রোগীদের। খবর নিয়ে জানা গেছে বেসরকারি হাসপাতালে আগে থেকে যেসব রোগী আছেন তাদেরও চিকিৎসা সেবা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ চিকিৎসকরা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছু ইন্টার্নিকে দিয়ে হাসপাতালের সেবা দেয়া হচ্ছে।
গতকাল ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান শুরুর খবর পেয়ে বিএমএ ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি সভা থেকে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে লাগাতার ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতি। সভা শেষে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। কর্মসূচির অংশ হিসেবে নগরীর বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবাও বন্ধ থাকবে। তিনি বলেন, নগরীর বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ক্লিনিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের প্রতিবাদে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সেবা দেওয়া অব্যাহত রাখতে চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধও জানান তিনি। যেসব রোগী এরই মধ্যে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ভর্তি আছেন মানবিক কারণে তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে বলেও জানান এই চিকিৎসক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতির এই সিদ্ধান্তে বিএমএ একাত্মতা জানিয়েছে।
ক্যাবের উদ্বেগ
কোন প্রকার ঘোষণা ছাড়াই চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণাকে অমানবিক উল্লেখ করে ক্যাব নেতারা বলেছেন, এর মধ্যদিয়ে চিকিৎসকেরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করলো। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবেহেলায় শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে ব্যাপক অনিয়মে অভিযুক্ত বিতর্কিত ম্যাক্স হাসপাতালকে জরিমানার পর সকল চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা মানুষের জীবন নিয়ে খেলার নামান্তর। বিবৃতিদাতারা হলেন ক্যাব কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারন সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, মহানগর সভাপতি জেসসিন সুলতানা পারু, সাধারন সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু।



 

Show all comments
  • Mohammad Shamsuddoha Tapos ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:২০ এএম says : 0
    রুগীরা চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নেয়া বয়কট করুন। যারা ২ নাম্বার তাদের তেল বের হয়ে যাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sultan Ahmed ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:২৫ এএম says : 0
    কেউ এদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না ।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdulla Al Zobayed ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:২৬ এএম says : 0
    মাদকের মত এদেরও নির্মুল করা উচিৎ, যারা মানুষ এর জীবন নিয়ে ব্যাবসা করে।
    Total Reply(0) Reply
  • Masum Billah ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৫ এএম says : 0
    এইসব হাসপাতাল, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে ব্যান করে দেওয়া দরকার বাংলাদেশ থেকে। যেন তারা দ্বিতীয় বার সুযোগ না পায়
    Total Reply(0) Reply
  • Delowar Hossain ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৬ এএম says : 0
    যারা হাসপাতালের কার্যক্রম বন্দ রেখেছে সাথে সাথে সব হাসপাতালের সব লাইসেন্স বাতিল করে দিয়ে সরকার অধিগ্রহন করলে সব ঠান্ডা ।
    Total Reply(0) Reply
  • David Peterson Das ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৩৭ এএম says : 0
    সরকারি হাসপাতালে যেতে তো সমস্যা নাই। তাই দুর্নীতিযুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল বয়কট করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে তাদের দুর্নীতি একটু হলেও কমে আসবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসপাতাল

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ