Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নওয়াজের দন্ড দলে বড় আঘাত

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

দুর্নীতির দায়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ১০ বছরের কারাদন্ডাদেশ ২৫ জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনের আগে মুসলিম লীগ এন-এর জন্য একটি গুরুতর আঘাত। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে একটি দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করলে নওয়াজ প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। বিবাদির আইনজীবী মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব বলেন, ‘লন্ডনে মূল্যবান সম্পদ কেনার জন্য [নওয়াজকে] কারাদন্ডের পাশাপাশি ৮০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড (এক কোটি ডলার) ও মরিয়মকে ২০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। নওয়াজ শরিফ ও তার মেয়ে মরিয়ম লন্ডনে অবস্থান করছেন। নওয়াজের স্ত্রী কুলসুম নওয়াজ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে চিকিৎসাধীন। এ কারণে নওয়াজ ও মরিয়ম এই রায় অন্তত সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত শুক্রবারই রায় ঘোষণা করেন।
বিবিসি জানায়, লন্ডনে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনাকে কেন্দ্র করে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এই মামলার রায় শুক্রবার ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু আদালত কয়েক দফা পিছিয়ে বিকেলের পর রায় ঘোষণা করে। নওয়াজ শরিফ বরাবরই দুর্নীতির এই অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে আসছেন।
নব্বইয়ের দশকে লন্ডনে পার্ক লেনের অ্যাভেনফিল্ড হাউসে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনে নওয়াজের পরিবার। পাকিস্তানের জাতীয় জবাবদিহি সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) কৌঁসুলি আদালতকে বলেন, নওয়াজ এই ফ্ল্যাটগুলো কেনার অর্থের বৈধ আয় দেখাতে পারেননি। যদিও নওয়াজের পরিবারের দাবি, বৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে এসব ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা। তবে এনএবির জিজ্ঞাসাবাদে এসব ফ্ল্যাট কেনার বিষয়ে নওয়াজের পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন রকম তথ্য দেন।
২০১৫ সালে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসে নওয়াজের। ওই সময় জানা গিয়েছিল, বেশ কয়েকটি অফশোর কোম্পানির সঙ্গে নওয়াজ শরিফের ছেলে-মেয়েদের যোগসূত্র রয়েছে। অভিযোগ আছে, এই কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করে বিদেশে অর্থপাচার করা হয়েছে এবং বিদেশে নানা সম্পদ কেনা হয়েছে। আলোচনায় ছিল, লন্ডনে কেনা এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলোও। শেষতক সেই ফ্ল্যাটের কারণেই কারাদন্ড হলো নওয়াজ ও তার মেয়ের।
আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ফ্ল্যাট কেনার অর্থের বৈধ উৎস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন নওয়াজ। ‘আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া এনএবিকে অসহযোগিতা করা দায়ে দেওয়া হয়েছে এক বছরের কারাদন্ড। তবে দুটি সাজা একই সঙ্গে চলবে। তাই নওয়াজকে ১০ বছর কারাগারে থাকতে হবে।
অন্যদিকে অবৈধ কর্মকান্ডে উৎসাহ দেওয়ার কারণে সাজা পেয়েছেন নওয়াজ কন্যা মরিয়ম। এ জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে ৭ বছরের কারাদন্ড। আবার এনএবিকে অসহযোগিতা করার দায়ে দেওয়া হয়েছে এক বছরের কারাদন্ড। তবে দুটি সাজা একই সঙ্গে চলায় মরিয়মকে ৭ বছর কারাগারে থাকতে হবে। আর তার স্বামী ক্যাপ্টেন সফদারকে এক বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে এনএবিকে অসহযোগিতা করা দায়ে।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল নওয়াজ শরিফকে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। আদালত তাকে রাষ্ট্রীয় যে কোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে আদালতের রায়ে দলীয় প্রধানের পদও ছাড়তে হয় নওয়াজকে।
দেশে ফেরার ঘোষণা
শুক্রবার আদালতের রায় ঘোষণার পর লন্ডনে অবস্থানরত নওয়াজ সংবাদ সম্মেলন করে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন শরিফ। নওয়াজ বলেন, ‘আমি পাকিস্তানি আসছি। সত্য বলার জন্য এবং পাকিস্তানের জনগণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভোট তথা জনগণের রায়ের প্রতি আস্থা রাখায় যদি কারাদন্ড হয়; তবে তা মোকাবিলা করতে দেশে আসছি।’ তবে দেশে ফেরার সুস্পষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি নওয়াজ।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
রায় ঘোষণার কয়েক মিনিট পর সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নওয়াজ শরিফের ভাই ও পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) চেয়ারম্যান শাহবাজ শরিফ। এই দিনটিকে ‘কালো দিন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী ২৫ জুলাই জনগণ আসল রায় দেবে।
আগামী ২৫ জুলাই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শাহবাজ বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানের সব আনাচে-কানাচে যাব, জনগণকে এই অবিচারের কথা বলব।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান তাহরীকে ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান বলেন, এটাই হচ্ছে নতুন পাকিস্তানের সূচনা। আমি যখন বলছিলাম, তারা (শরিফ ও জারদারি) বিদেশে সম্পত্তি কিনেছেন। তখন কেউ আমার কথায় পাত্তা দেয়নি। পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করলে নওয়াজের মতো মানুষ অনেক আগেই গ্রেফতার করা হতো বলেও মন্তব্য করেন ইমরান।
নওয়াজের উত্থান-পতন
রাজনীতির বাঁকে বাঁকে আসে উত্থান-পতন। রাজনীতির এই খোলা ময়দানে একসময় কেউ মহানায়ক হিসেবে বিবেচিত হন, একই ব্যক্তি আবার পরিণত হন খলনায়কে। পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ এমনই একজন। পাকিস্তানের তিন-তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তিনি। তবে এখন তিনি একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি। গত শুক্রবার দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলায় তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেন অ্যাকাউন্টিবিলিটি কোর্ট। তার রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতনের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ:
জন্ম ও শিক্ষা
১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর লাহোরের ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। লাহোর সরকারি কলেজ ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি নেওয়ার আগে পড়েছেন লাহোরের সেন্ট অ্যান্থনিস হাইস্কুলে। লেখাপড়া শেষ করে নওয়াজ তার পারিবারিক বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইত্তেফাক গ্রুপে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে কুলসুমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
রাজনীতির হাতেখড়ি
প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করার সময় রাজনীতি শুরু করেন নওয়াজ। জাতীয়করণ করা কারখানার মধ্যে তাদের স্টিল কারখানাও ছিল। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান মুসলিম লিগে (পিএমএল) যোগ দেন। পাঞ্জাব প্রদেশে দলটির শক্ত ঘাঁটি ছিল। জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে তিনি প্রথমবারের মতো পাঞ্জাবের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৫ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে দেশটির মার্শাল ল সমাপ্তির পর পুনরায় একই পদে নির্বাচিত হন। ওই বছর স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর দ্ব›েদ্বর কারণে পিএমএল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দলটির একটি পক্ষের দায়িত্ব নেন নওয়াজ, পরে যার নাম হয় পিএমএল-এন।
অস্থিতিশীল পরিবেশে প্রধানমন্ত্রী
১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর নওয়াজ প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওই সময় দেশের জ্বালানিসঙ্কট মোকাবিলায় পরমাণু প্রযুক্তির উন্নয়নে পরমাণুনীতি ঘোষণা করেন তিনি। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিলে তাঁর ক্ষমতায় থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এক মাস পর ক্ষমতা ফিরে পান।
১৯৯৭ সালে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ওই বছরের শেষের দিকে সামরিক অভ্যুত্থানে নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ডও দেওয়া হয় তাকে। পরে চুক্তির মাধ্যমে সউদী আরবে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান তিনি। ২০০৭ সালে দেশে ফিরে এসে পুনরায় রাজনীতিতে যুক্ত হন।
২০১৩ সালের মে মাসে তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানোর নির্দেশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলায় তার সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ফাঁস হওয়া পানামা পেপারসে তার ও তার মেয়ে মরিয়মের নামে দুটি অফসোর কোম্পানি থাকার কথা প্রকাশের পর সেই চাপ বোঝা হয়ে দাঁড়ায় সরকারের ওপর। পানামা পেপারসের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রীর পদে অযোগ্য ঘোষণা করেন। পরে দলের প্রধানের পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। রাজনীতি থেকেও আজীবন নিষিদ্ধ হন তিনি। গত শুক্রবার নিষেধাজ্ঞার কফিনে দেশটির অ্যাকাউন্টিবিলিটি কোর্ট শেষ পেরেক ঢুকিয়ে দিলেন ১০ বছরের সাজা প্রদানের মাধ্যমে। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর ও ডন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ