Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হয়রানিতে অতিষ্ঠ যাত্রীরা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম | আপডেট : ১১:১৮ পিএম, ৭ জুলাই, ২০১৮

যাত্রা শুরুর পর ৬ মাস অতিক্রান্ত হলেও যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি বন্ধন এক্সপ্রেস। যাত্রীদের অভিযোগ, খুলনা-কলকাতা রেলপথের এই মৈত্রী ট্রেনের ভাড়া তুলনামূলক বেশি। সে তুলনায় সেবার মান খুবই নিম্নমানের। যাত্রাপথে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের নানামুখী জটিলতাসহ হয়রানীর শিকার হতে হয়। এ কারনে সাড়ে চারশ’ আসনের এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী নিয়ে লোকসানে চলছে ট্রেনটি।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর বহু প্রতিক্ষিত খুলনা-কলকাতা রেলপথে বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনটির বাণিজ্যিক পরিচালন শুরু হয় গত বছর ১৬ নভেম্বর থেকে। শুরু থেকেই সাড়ে ৪শ’ আসনের এই ট্রেনে এক-তৃতীয়াংশ যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে খুলনা-কলকাতা সরাসরি ট্রেন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ বেনাপোলে সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলে। বছর দশেক আগে ঐ লাইন পুণঃস্থাপন করে কয়েক বছর আগে কলকাতা-নওয়াপাড়া-খুলনা লাইনে পণ্যবাহী ট্রেন চালু হয়।
তবে ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমান দুই প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচষ্টায় ৫২ বছর পর গত বছর এপ্রিলে খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে এ ট্রেন সার্ভিস দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে যথেষ্ট আশান্বিত করলেও ক্রমে সবার মধ্যে হতাশা বাড়ছে। বর্ধিত ভাড়া এবং সপ্তাহে মাত্র একদিন চলাচলের কারনে এ ট্রেনে ভ্রমণকারীদের কলকাতা থেকে ফিরতে পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
খুলনা-কলকাতার ১৭৫কিলোমিটার রেলপথের এ/সি চেয়ারের ভাড়া ১৫শ’ টাকা। অপরদিকে, এসি কেবিনের প্রতি সিটের ভাড়া ২ হাজার টাকা। অথচ ঢাকা-কলকাতা রেলপথে ৫৩৮ কিলোমিটার দূরত্বে এ/সি চেয়ারের ভাড়া ২৫শ’ টাকা। একইভাবে এসি কেবিনের ভাড়া প্রতি সিটে ৩৪শ’ টাকা। এ হিসাবে ঢাকা-খুলনার তুলনায় ঢাকা-কালকাতা রেলপথে ভাড়া অনেক কম।
যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক এ ট্রেনের টিকেট অনলাইনে বিক্রির কোন ব্যবস্থা নেই। খুলনাতে মূল পাসপোর্ট ছাড়া টিকেট ইস্যু করা হয় না। তাও সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এর সময় সীমা নির্ধারিত। অপরদিকে, কলকাতা স্টেশনে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টিকেট বিক্রির কথা বলা হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সন্ধ্যা ৬টার পরে সেখানে কোনো টিকেট বিক্রি হয় না। যাত্রীরা জানান, কলকাতা স্টেশন থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে গেলে একটি লম্বা ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে যাত্রীদের বসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মেঝেতে বসেই অনেক যাত্রী ফরমটি পূরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শহর থেকে চিতপুরের কলকাতা স্টেশনে পৌঁছতেও প্রতিবারে ট্যাক্সি ভাড়া প্রয়োজন হয় অন্তত ৫শ’ টাকা। কলকাতার ‘ফেয়ারলী প্লেস’ বিদেশীদের জন্য ট্রেন টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’এর টিকেট সংগ্রহে গিয়ে বেশীরভাগ যাত্রীই নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, পুরো ট্রেনটিতে কোন খাবার গাড়ী নেই। খুলনা থেকে বেনাপোল স্টেশন পর্যন্ত রেলওয়ের ক্যাটারিং সার্ভিসের ইজারাদার অনেক চড়া দামে কিছু হালকা খাবার ও চা-কফি সরবরাহ করে। ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতা পর্যন্ত আর কোন খাবার মেলেনা ট্রেনটিতে। অনেক সময় খাবার মিললেও ভারতীয় রুপীর অভাবে অনেকেই খাবার কিনতে পারে না।
এদিকে, বেনাপোলে চেকপোস্টে কোনো মানি চেঞ্জার অফিস বা এজেন্সী না থাকায় ভারতগামী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। কলকাতা স্টেশনে পৌঁছার পর সেখানেও কোন মানি চেঞ্জার অফিস আ এজেন্সী না থাকায় বেশীরভাগ যাত্রীই টাকার অভাবে বাস বা ট্যাক্সির ভাড়া মেটাতে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেকে কলকাতা নিউমার্কেট পর্যন্ত ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে মানি চেঞ্জার এজেন্সীর কাছ থেকে ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রা ভাঙিয়ে পরে হোটেলে যান। এতে করে ট্যাক্সি ভাড়া যেমন বাড়ে, ডলারের দামও তেমনি কমে।
বেনাপোলে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিনের ঘরের যাত্রী ছাউনিতে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস-এর যে চেকপোস্ট। সেখানে যাত্রীদের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই, ফ্যান নেই। এতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রেন থেকে নেমে গরমে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বেনাপোল ইমিগ্রেশনে মোট ১৬টি কাউন্টার থাকলেও কম্পিউটার আছে ৮টিতে। তার মধ্যে ৬টি কাউন্টারে ইমিগ্রেশন পুলিশ কাজ করে। সেখানে নিয়োজিত ইমিগ্রেশন কর্মীদের অনেকেই পারদর্শী না হওয়ায় যাত্রীদের দীর্ঘ সময়ই লাইনে অপেক্ষা করতে হয়।
খুলনামুখী ফিরতি ট্রেনের যাত্রীদের বেনাপোল কাস্টমস-এর নানামুখী হয়রানীর কবলে পড়তে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কাস্টমস-এর স্ক্যানারে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষার পর অনেক যাত্রীর ব্যাগেজ আবার টেবিলে তুলে তল্লাশী করা হয়। আর এ কাজটি করে দালালচক্র। কাষ্টমস চেকপোস্টে কয়েকজন ইনেসপেক্টর দায়িত্বরত (?) থাকলেও কোন সুপারের দেখা মেলেনা । বিষয়টি নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনারের সাথে তার অফিসের ল্যান্ড ফোনে কথা বলা চেষ্টা করা হলেও ‘স্যার খুব ব্যস্ত আছেন’ বলে জানান তার একান্ত সহকারি।
ভুক্তভোগি যাত্রীরা জানান, বন্ধন এক্সপ্রেস বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পেট্রাপোলে প্রবেশের পরেই বিএসএফ ‘ডগ স্কোয়াড’ নিয়ে পুরো ট্রেন তল্লাশী শুরু করে। প্রতিটি যাত্রীর ব্যাগেজ ডগ স্কোয়াড দিয়ে পরীক্ষা করতে অনেক সময় নষ্ট হয়। একই সাথে কুকুর দেখে অনেক শিশু ও মহিলা যাত্রী আতংকিত হয়ে পড়েন। পেট্রাপোল থেকে কলকাতা স্টেশন পর্যন্ত প্রতিটি বগিতে সশস্ত্র বিএসএফ সদস্য পাহারা থাকে। এমনকি কলকাতা স্টেশনে বন্ধন এক্সপ্রেস পৌঁছার পরে সেখানে যাত্রীর চেয়ে বিএসএফ’র আধিক্য নজরে পড়ে।
একজন যাত্রী জানান, কলকাতায় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস-এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে একজন যাত্রীকে এক থেকে দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। শিশু, নারীসহ অসুস্থ রোগীদের এ থেকে কোনো রেহাই নেই। সেখানে কোন কুলি পাওয়া যায় না। বাগেজ নিয়ে যাত্রীদের দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
ফিরতি পথে যাত্রীদের হয়রানীর মাত্রা আরো বেশী। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কাউন্টার থেকে অনেক দুরেই কুলিরা ব্যাগেজ রেখে চলে যায়। কোনমতে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কাস্টমসে পৌঁছলেই নানামুখি হয়রানীর শিকার হতে হয়। এরপর ডলার ভাঙানোর রশিদ থেকে শুরু করে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হন যাত্রীরা। এমনকি ভারতীয় রূপি থাকলে তাও কেড়ে নেয় কাস্টমসের লোকজন। সকাল ৭টার আগে ট্রেনে কোন নাস্তার ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশি মুদ্রায়। এজন্য শিশু, রোগি এমনকি বৃদ্ধদেরকেও অভূক্তবস্থায় অপেক্ষা করতে হয় সাকাল ৯টায় বাংলাদেশের বেনাপোলে প্রবেশ করা পর্যন্ত।
যাত্রীদের অভিযোগ, ‘স্ক্যানিং মেশিন খারাপ’ বলে কলকাতা স্টেশনে ব্যাগেজ তল্লাশী শুরু হয়। তবে ভারতীয় বা বাংলাদেশী টাকার বিনিময়ে কাস্টমস কর্মীদের ম্যানেজ করাও সহজ। অথচ কাস্টমস-এর দরজা পার হলেই একটি স্ক্যানিং মেশিনে ব্যাগেজ পরীক্ষা করা হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে বিএসএফ সদস্যরা। ভারতীয় কাস্টমস কর্মীদের কোন পোষাক নেই। এতে কে দালাল আর কে সরকারি কর্মী তা বোঝার কোন উপায় থাকে না। এমনকি কে কোন স্তরের কর্মচারী বা কর্মকর্তা তাও সাধারন যাত্রীদের বোঝার উপায় থাকে না।
এদিকে, খুলনা রেল স্টেশনে কোন ট্রলি না থাকায় সেখানে কুলিদের অত্যাচারের কাছেই নতি শিকার করতে হয় যাত্রীদের। রেলে নিয়োজিত এসব কুলিদের মজুরীর কোন বালাই নেই। খুলনা রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনের বগির উচ্চতা অনেক বেশী হওয়ায় নারী ও শিশুসহ অসুস্থ রোগী যাত্রীদের অমানবিক দূর্ভোগ পোহাতে হয়। গত বছরের নভেম্বরে মাত্র দুটি সিঁড়ি দিয়ে সার্ভিসটি চালু করা হলেও পরে আরো কয়েকটি সিড়ি দেয়া হয়। ইতোমধ্যে সেগুলোর পটাতন ভেঙ্গে গেছে। ট্রেন আসার পরে ঐসব সিঁড়ি লাগানোর মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব বিষয়ে বেনাপোল রেলস্টেশন মাস্টার শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বন্ধন এক্সপ্রে চালু হওয়ার পর গত ৭ মাসে ৩ হাজার ৪৪৫ জন যাত্রী কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেছে এবং বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৫৭৯ জন যাত্রী কলকাতায় গেছেন। তিনি বলেন, নিরাপদে ও সুষ্ঠুভাবে যাত্রী চলাচল করার পরও এ ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা দিন দিন কমছে। ট্রেনটি সপ্তাহে একাধিক দিন চলাচল করলে এবং যশোর ও বেনাপোলের মানুষের জন্য টিকেটি বিক্রি ও স্টপেজ দেয়া হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তিনি জানান।



 

Show all comments
  • কাওসার আহমেদ ৮ জুলাই, ২০১৮, ৪:২৬ এএম says : 0
    হয়রানি বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রেন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ