হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় দুঃখ করে বলেছিলেন : ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’।
বহু বছর পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথের এ হতাশা-জনিত ক্ষোভের জবাব দিয়ে বলেছিলেন, কবিগুরু, আপনি দেখে যান, বাঙালিরা আপনার দুঃখ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে মানুষ হয়েছে, তারা বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্যে সত্যের মধ্যে অবশ্য কিছুটা আবেগের মিশেলও ছিল। উপমহাদেশে বসবাসরত সকল বাঙালির বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অকল্পনীয় সুযোগ একবারই এসেছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ও পকিস্তানের বাইরে তদানীন্তন বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর সার্বভৌম বাংলা পরিকল্পনার মাধ্যমে। এ পরিকল্পনার প্রতি মুসলিম লীগ হাইকমান্ড কায়েদে আজম জিন্নার সমর্থন থাকলেও কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল প্রমুখ অবাঙালি নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রচ- বিরোধিতার কারণে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সে সুুন্দর পরিকল্পনাটি ভ-ুল হয়ে যায়। শেষোক্ত নেতা (শ্যামপ্রসাদ) তখন এমনও বলেছিলেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে ভাঙালি হিন্দুরা চিরদিনের জন্য বাঙালি মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে!
এর ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হলো। বাংলার পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের এবং পশ্চিমাঞ্চল ভারতের অংশ হলো। পূর্ববঙ্গ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পশ্চিমবঙ্গ এখনো অবাঙালি-শাসিত ভারতের অন্যতম প্রদেশ (রাজ্য) হিসেবেই রয়ে গেছে। অন্যপক্ষে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে একমাত্র বাঙালি-শাসিত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় সমাসীন।
বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এ উত্তরণ অবশ্য এমনি এমনিতে সম্ভব হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহুজনের বহুদিনের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের পাশাপাশি জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং সূক্ষ্মদর্শী নেতৃবৃন্দের অবদান। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এ গৌরবময় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করে মজনু শাহের ফকির বিপ্লব, তিতুমীরের সংগ্রাম, শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়ার ফরায়জী আন্দোলন, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, সৈয়দ আমির আলী, নবাব সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী, জেনারেল ওসমানী, জিয়াউর রহমান হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত কারও অবদানকেই অস্বীকার করা যাবে না।
উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শেখ উপাধিধারী দুই মহান নেতার নাম প্রায় সবারই জানা। এদের একজন শেখ মুুজিবুর রহমান, আরেকজন শেখ আবদুল্লাহ। উভয়েরই জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজ জন্মভূমির স্বাধীনতা। কিন্তু ভুল পন্থা অনুসরণ করে একজন কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় শেখ আবদুল্লাহ তাঁর পারিবারিক বন্ধু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প-িত নেহেরুর শাসনামলে তাঁর জেলে কাটিয়ে জন্মভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূরিত রেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আরেকজন বাস্তবপন্থী শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় ধাপে ধাপে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন।
ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে আজ আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, তার অভ্যুদয় সম্ভবই হতো না যদি উপমহাদেশের এ সুদূর পূর্বাঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার না ঘটত এবং তার পরিণতিতে এতদঞ্চলে এক বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে না উঠত। কারণ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল বলেই ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিরূপী এমন একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সুযোগ হয়, যাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দাবি করা হয় উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো পরিকল্পনা উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। ১৯৪১ সাল থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের আংশিক বিজয় ঘটে ১৯৪৭ সালে এবং পূর্ণাঙ্গ বিজয় হয় ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সম্ভবই হতো না যদি উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার এবং তার ফলে এক বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে না উঠত।
শুধু বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মূলেই নয়, বাংলা ভাষা এবং বাংলা সনের মূলেও রয়েছে ইসলাম তথা মুসলমানদের ঐতিহাসিক ভূমিকা। বাংলাদেশের শহরে বসবাসকারী আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে ইংরেজ শাসনামলে চালু হওয়া খ্রিস্টীয় সন অদ্যাবধি ব্যাপক চালু থাকলেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো বাংলা সন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। গ্রামের আপামর জনসাধারণ এখনো তাদের কৃষিকাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করেন বাংলা সনের ভিত্তিতে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পীর-মাশায়েখদের অধিকাংশ ইসালে সওয়াব ওয়াজ মাহফিল প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয় বাংলা সন অথবা হিজরি সন মোতাবেক।
এমনিতে ইসলামী সকল ধর্মানুষ্ঠান তো হিজরি সন মোতাবেকই অনুষ্ঠিত হয় বাস্তবতার তাগিদে। তদুপরি বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদের অধিকাংশ কর্মকা- পরিচালিত হয় যে বাংলা সনের হিসাবে, সে বাংলা সনের জন্মও হয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে হিজরি সালের সৌর সংস্করণ হিসাবে। মধ্যে কিছু দিন বাংলা সনের গননা জ্যোতির্বিদদের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে সংস্কার সাধনের পর বাংলা সন এখন খ্রিস্টীয় সনের মতোই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রচলিত রয়েছে। সুতরাং বাস্তবতা বিবেচনায় দাবি করা যায়, যে বাংলা সন বাংলাদেশের নিজস্ব সন হিসেবে সুপরিচিত, তার মূলেও রয়েছে ইসলামের তথা মুসলমানদের অবদান।
এবার আসা থাক বাংলা ভাষার কথায়। ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান অবলম্বন। এই ভাব প্রকাশ আবার সবচেয়ে সহজ হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। পৃথিবীতে কোনো বড় ঘটনা হঠাৎ রাতারাতি সংঘটিত হয় না। ভাষার জন্মের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। বাংলা ভাষা আজ যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে সে পর্যায়ে পৌঁছতে বহু সময় লেগেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার আসনে বসাতে আমাদের বহু সংগ্রাম ও রক্তদান করতে হয়েছে এ কথা আমরা সবাই জানি। এই সংগ্রামের স্মৃতি হিসেবে সারা বিশ্বে এখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য এমনি যে, এ ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় তার শৈশব-কৈশোর থেকেই। গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষার জন্ম হয় সপ্তম শতাব্দীতে ইন্দো-এরিয়ান ভাষা পরিবারে সুদীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া যায় ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’র মধ্যে। বৌদ্ধ পাল আমলে এর জন্মকালটা ভালোভাবে কাটলেও শৈশবেই একে গলা টিপে মারার ষড়ন্ত্র শুরু হয়।
একাদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন বংশ পাল বংশকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। সেন রাজারা শুধু মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টিকারী জাতিভেদ প্রথাই প্রবর্তন করেন না, তারা সাধারণ জনগণের ব্যবহৃত বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ও ষড়যন্ত্র শুরু করে দেন। তারা সংস্কৃতকে রাজভাষা ঘোষণা করে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করতে থাকেন। তাদের এ মনোভাবে উৎসাহিত হয়ে ব্রাহ্মণ প-িতরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সংস্কৃতকে দেবতার ভাষা এবং বাংলাকে সাধারণ মানুষের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে জারি করা এমনি একটি সংস্কৃত শ্লোক ছিল নি¤œরূপÑ
অষ্টাদশ পুরান রামায়োন্যাম চরিতানিচো
ভাষায়ং মানবং শ্রুত রৌঢ়ব নরকং ব্রজেত।
অর্থাৎ যারা মানব রচিত বাংলা ভাষা অষ্টাদশ পুরান ও রামায়ণ শ্রবণ করবে তাদের স্থান হবে রৌঢ়ব নরকে।
সৌভাগ্যক্রমে এই রাষ্ট্রীয় সামাজিক পটভূমিতে ১২০৩ সালে ইফতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা জয় করেন। বাংলাদেশে সুমলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জাতিভেদ-লাঞ্ছিত তদানীন্তন সমাজেই শুধু বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় না, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির ইতিহাসেও এক গৌরবময় অধ্যায়ের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। মুসলিম শাসনামলে যদিও রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি, তবুও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সমর্থ হয়। শুধু ইসলামী বিষয়ে নয়, অনৈইসলামী বিষয়েও সাহিত্য চর্চা উৎসাহিত করা হয়। ফলে সে সময় আরবি, ফার্সি ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষার বহু গ্রন্থ অনুবাদ কার্যের পথ উন্মুক্ত হয়।
বিখ্যাত গবেষক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন এ প্রসঙ্গে যথার্থই মন্তব্য করেন :“হীরা কয়লার মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের অপেক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করিয়া থাকে, বাংলা ভাষা তেমনি কোনো শুভদিন, শুভক্ষনের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলিম বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভদিন শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল।” [দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন]।
এতে প্রমাণিত হয় বাংলা ভাষার জন্ম বৌদ্ধ আমলে হলেও নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে শৈশব-কৈশোরে এ ভাষার লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করেন মুসলমান শাসকবৃন্দ।
১৭৫৭ সালে পলাশী ট্র্যাজেডির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর বাঙালি মুসলমানদের জীবনে নেমে আসে অকল্পনীয় ভাগ্য বিপর্যয়। প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য জমিদারি, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে বেছে বেছে মুসলামানদের উৎখাত সেখানে ইংরেজ অনুগত হিন্দুদের বসানোর পালা শুরু হয়। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই এক কালের সমৃদ্ধ মুসলিম সম্প্রদায় একটি অসহায় জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এ চক্রান্ত ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়। ফোর্টউইলিয়াম চক্রান্তের মাধ্যমে বাংলা ভাষা মুসলিম সমাজে বহুল ব্যবহৃত আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃতবহুল এক দুর্বোধ্য বাংলা ভাষার জন্মদানের চেষ্টা করা হলে মুসলিম সাহিত্য সাধকদের অনেকে অভিমান করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষতায় বাংলা ভাষা চর্চা থেকে সরে বটতলার পুঁথি চর্চায় মনোনিবেশ করেন। অবশ্য পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সাহিত্য চর্চার মূল ধারায় ফিরে আসেন। ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে মীর মশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, কায়কোবাদ, শেখ আবদুর রহিম প্রমুখের আবির্ভাব সম্ভব হয়।
ইংরেজ শাসনের অবসানে যে পটভূমিতে আজকের বাংলাদেশ প্রথম দিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় সে কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৫৬% জন মানুষ বাস করত এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ আমলাদের মধ্যে অবাঙালিদের সংখ্যাধিক্যের সুযোগে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের আগেই গোপনে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্ত শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বর মাসেই। যে সংস্থাটির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন শুরু সেটি ছিল একটি ইসলামী সংস্কৃতিক সংস্থা। নাম তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জন্ম নেয়া মুসলিম ছাত্রলীগও এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এ দুটি সংস্থার উদ্যোগে সারা পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে প্রথম সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানের জের চলে কয়েক দিন ধরে। ফলে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ ভাষা সংগ্রামীদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে ভাষা সংগ্রামীদের সব দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে এক জন সভার ঘোষণা করে বসেন : উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে জনগণের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এর ফলই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ দিবস। এদিন বাংলার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে অসংখ্য যুবকের রক্তদানের মাধ্যমে জন্ম হয় মহান একুশে। একুশের পথ বেয়েই পরবর্তীকালে জন্ম হয় স্বাধিকার চেতনা। এই স্বাধিকার চেতনাকে টিককা বাহিনী পশু বলে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হলে জনগণ সশ¯্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের মধ্যে জন্ম দেয় তদানীন্তন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
আমরা আগেই বলেছি, উপমহাদেশের প্রত্যন্ত পূর্বাঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি না ঘটলে এবং তার পরিণতিতে বিশাল মুসলিম জনগণ গড়ে না উঠলে আজকের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মই সম্ভব হতো না। একইভাবে আমরা দেখেছি আজকের যে বাংলা সন তার জন্ম হয় মোগল বাদশাহ আকবরের শাসনামলে হিজরি সনের বাংলা রূপান্তর হিসেবে। অপরদিকে বাংলা ভাষার শৈশব-কৈশোরে এর লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করেছেন মুসলিম শাসকগণ। শুধু তাই নয়, বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য যারা রক্ত দিয়েছে তারা সবাই মুসলিম তরুণ। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়েছে একমাত্র যে দেশটি সেটিও একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ, বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলা সন বাংলাভাষা, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশÑএ তিনেরেই মূলে রয়েছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।