Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গাজীপুরে সিইসি কথা রাখলেন!

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৮, ১২:০১ এএম

‘সিইসি কথা রাখবেন তো’ শিরোনামে ইনকিলাবে ক’দিন আগে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়র প্রার্থী, নির্বাচন কর্মকর্তা, আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় প্রধান নির্বাচন কশিমনার এ কে এম নূরুল হুদা প্রতিশ্রæতি দিয়ে বলেন, ‘এখানে (গাজীপুর) নির্বাচন খুলনার মতো হবে না’। ভোটের দিন দেখা গেল তিনি সত্যিই কথা রেখেছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে খুলনার মতো নয়; বরং আরো ‘বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতোই ফকফকা ভোট হয়েছে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ভাষায় ‘ভোটের নামে নিবিড় প্রশাসনিক ম্যাকানিজম’ হয়েছে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মুজমদারে মতে, গাজীপুরে নির্বাচন হয়েছে ‘প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত’ এবং নির্বাচন কমিশন ছিল ‘ক্রীড়নক’। সৈয়দ আবুল মকসুদ এই ইসির জাতীয় নির্বাচন করার যোগ্যতা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। খুলনায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়; আর গাজীপুরে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের আগেই ভয়ভীতি দেখানো হয়। যারা ভয় পাননি তাদের ভোটের দিন ভোরে গাড়ীতে তুলে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরে সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। খুলনার চেয়েও আরো সুনিপুণ সেই জাল ভোট দেওয়া, এজেন্ট বের করে দেয়া, ব্যালটে সিল মারা, কারচুপি করা, হুমকি-ধমকি, নিয়ন্ত্রন। কূট-কৌশল ও রাখঢাকের পরও গাজীপুর ভোটের চিত্রবিচিত্র খবর মিডিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে। ভোটাররা বলছেন, ‘এমন বিচিত্র ভোট গাজীপুরে বিগত একশ বছরেও দেখিনি’।
খুলনার নির্বাচনে ‘প্রশাসনিক কারচুপির’ অভিযোগের পর সিইসি একেএম নুরুল হুদা ছিলেন নীরব। কমিশনের সচিব হেলালউদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ‘খুলনায় সুষ্ট-নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে’। গাজীপুরের নির্বাচনের সময় খুলনার নির্বাচন ভাল হয়নি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে সিইসি প্রতিশ্রæতি দেন, ‘খুলনার মতো গাজীপুরে হবে না’। ভোটার ও সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন সিইসি হয়তো ‘খুলনার মতো হবে না’ বলতে নির্বাচনে ‘অনিময় হবে না’ বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু ভোটের দিন মানুষের ভুল ভেঙ্গে যায়। সিইসি খুলনার মতো হবে না বলতে যা বোঝান তা মানুষ বুঝতে ব্যর্থ হয়। সিইসি সেদিন গাজীপুরে ভোট গ্রহণে আরো নিবিড় ম্যাকানিজম ও ক্যারিশমার কৌশলের কথাই হয়তো বুঝিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সিইসি ক্ষমতাসীনদের ‘নাচের পুতুল’। বিএনপির অপর এক নেতার ভাষায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ ‘ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে’ যে দায়িত্ব পালন করেছেন; গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সিইসি তাই করেছেন।
প্রশ্ন হলো সিইসি পদ ‘চাকরি’ না ‘দায়িত্ব পালন’? সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ, সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ড. সাদত হুসাইনসহ প্রায় অর্ধশত নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব নিত্যদিন টিভিগুলোর নির্বাচন কশিমনের ক্ষমতা, নির্বাচনী আইন ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরছেন। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কি ধরণের পদ্ধতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ-উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু সিইসি’র নড়নচড়ন নেই। সাবেক সিইসি রকিবউদ্দিন আহমেদ সরকারকে খুশি করতে ‘ইসির ক্ষমতা কমানোর’ আবেদন করেন; তেমনি বর্তমান সিইসি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক পদ। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালন করা ভাগ্যের ব্যাপার। পদটি গৌরবের বটে। সাংবিধানিক পদ কার্যত ‘চাকরি’ নয় ‘দায়িত্ব’ পালন। ইচ্ছা করলেই সরকার বা নির্বাহী বিভাগ এই পদের ব্যাক্তিদের বরখাস্ত-চাকরিচ্যুত করতে পারেন না। কিন্তু বিগত দিনে পদটিতে বসে কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ ভেল্কিবাজী করে নির্বাচন কমিশনের ইমেজ খুইয়েছেন। আদেশ-নির্দেশ পালনে মুখিয়ে থাকতেন। বর্তমান সিইসি গাজীপুরে রকিব উদ্দিন মÐল নামের এক কর্মকর্তাকে পেয়েছেন। তাকে দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করে ইসিকে আরো ডুবালেন? নির্বাচন ইস্যুতে যতই নিরপেক্ষতার অভিযোগ করা হোক না কেন সিইসি শোনেন; দেখবো-দেখছি প্রতিশ্রæতি দেন। অতপর নির্বাচনের নামে প্রহসন হয় আর সিইসি ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম/ তুমি চলে গেলে’ গানের মতোই শুধু তাকিয়ে দেখেন।
গাজীপুর সিটির ভোটে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রত্যাখান করে বলেছেন, খুলনায় নতুন কৌশলে ভোট ডাকাতি করে তারই ধারাবাহিকতায় গাজীপুরে নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গাজীপুরে আরো একটি কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হলো। তিনি গণগ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, ভাংচুর, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকতে না দেওয়া, নির্বাচনের আগের রাতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স বোঝাই করা, নির্বাচনের দিন এজেন্টদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার চিত্র তুলে ধরেন। ভোটের দিন সংবাদ সম্মেলন করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচন কমিশন কথা রাখেনি। সরকারের পাতানো পথেই হাঁটছে। ইসির কাছে বার বার গেছি তথ্য প্রমান নিয়ে; কিন্তু তারা প্রতিকার করেননি।
গাজীপুর নির্বাচনের চিত্র বিক্ষিপ্তভাবে মিডিয়ায় এসেছে। কর্পোরেট হাউজগুলোর পত্রিকা ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো খবর এবং খবরের পিছনের খবর নয়; খবর প্রচারে ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করার কৌশল নিয়েছে। গাজীপুরের নির্বাচনের খবর প্রচারে সেটা উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্যতা রক্ষা ও দর্শক ধরে রাখার কৌশলে দুই পক্ষ্যের খবর ও মতামত প্রচার করে। প্রচারণায় ক্ষমতাসীনদের স্তুুতি নীতিতে অভ্যস্ত এমন একটি চ্যানেলে নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর বক্তব্য সরাসরি প্রচার করা হয়। বক্তব্যে হাসানউদ্দিন সরকার বলেন, ধানের শীষের দুই-তিনশ পোলিং এজেন্টকে ভোরে জোর করে গাড়ীতে তুলে ময়মনসিংহে নেয়া হয়। দুপুরে তাদের ছেড়েও দেয়া হয়। এ জন্য অনেকগুলো কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট ছিল না। তিনি ভোট ইস্যুতে জুলুম-নির্যাতন ও ব্যপক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম জানান, অনেকগুলো কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট দেয়নি সেটা তিনি জানেন। কেন দেয়নি সেটা তার নৌাকার প্রার্থীর দোষ হতে পারে না। বরং ধানের শীষের প্রার্থী সহায়তা চাইলে তিনি পুলিং এজেন্ট দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারতেন। টিভিতে সরাসরি দুই প্রার্থীর কথাবার্তায় গাজীপুর ভোটের কিছুটা প্রকৃত চিত্র উঠে আসে। প্রশ্ন হলো এতো বড় দলের প্রার্থী এজেন্ট দিতে পারলো না, কেন এজেন্টদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, পরিবেশ কেমন ছিল সেগুলো দেখার দায়িত্ব ইসির। কিন্তু ইসি কি সে দায়িত্ব পালন করেছে নাকি পলাশির প্রান্তরের মতো গাজীপুরে ‘ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার’ ভুমিকা রেখেছে? গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচনে পরাজিত হলো কে? #



 

Show all comments
  • Towhid Chowdhury ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৩ এএম says : 1
    বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতি আর কোনো আগ্রহ নেই
    Total Reply(0) Reply
  • আরাফাত সিদ্দিকী ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৪ এএম says : 1
    কমপক্ষে ১০০ অধিক কেন্দ্র দখল হয়েছে আর স্থগিত হয়েছে মাত্র ৯ টি, আওয়ামীলীগের অধীনে নির্বাচন যে কখনো সুষ্ঠু হবেনা তা আবারও প্রমাণ হয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Abid Abdullah ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৪ এএম says : 1
    গাজীপুরে প্রশাসনি ভাবে আওয়ামীগ প্রার্থী জিতেছে।, শুধু শুধু নির্বাচনের নামেমে টাকা নষ্ট না করে সরাসরি বলে দিলেই তো হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • AB Hannan Shah ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৫ এএম says : 1
    ইতিহাঁস এইসব নিলজ্জদের ক্ষমা করবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Omar Faruk ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৬ এএম says : 1
    এই কলঙ্ক ইতিহাস জাতি কবো ভুলবে না, গাজী পুর নির্বাচন
    Total Reply(0) Reply
  • Rafik Uddin ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৬ এএম says : 1
    এই কাথা তো মানুষ নিবাঁচনের আগেও জানতেন
    Total Reply(0) Reply
  • Gias Uddin ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৭ এএম says : 1
    এগুলো কী নিবাচন? বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mehedi Riaz ২৮ জুন, ২০১৮, ৪:৩৯ এএম says : 1
    লজ্জা শরম কি দেশ থেকে উঠে গেছে নাকি?
    Total Reply(0) Reply
  • Moinuddin ২৮ জুন, ২০১৮, ১১:৪৮ এএম says : 0
    মিডিয়াতে আরো বেশি লেখা লেখি করা দরকার
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গাজীপুর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ