দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ঈদ আরবী ‘আওদ’ শব্দ থেকে উৎকলিত। এর অর্থ হলো ফিরে আসা। আর ঈদ বার বার ফিরে আসে। মুসলমানদের ইবাদতকেন্দ্রীক এক ধর্মীয় উৎসবের দিন হল ঈদ। ঈদ হলো এক সার্বজনীন ও নির্মল আনন্দের দিন, এক পবিত্র অনুভুতি এবং এক ব্যতিক্রমী সম্মিলনের দিন। সব মুসলমান পরস্পরে ভাই ভাই- উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, আশরাফ-আতরাফ ও আমীর-ফকীরের কোন ফারাক ইসলামে নেই এই বিশ্বাসকে নবায়ন করার দিন হলো ঈদের দিন। ঈদের সকাল হলো এক সুহাসিনী সকাল- যেখানে নেই কোন হিংসা-বিদ্ধেষ, ব্যাথা-বেদনা, আছে শুধু মায়া-মমতা, ভালবাসা, সম্প্রীতি-সহমর্মিতা এবং মানুষকে আপন করে নেয়ার এক আসমানী তাগিদ। যারা নিজের পশুত্ব-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে পেরেছে, তারা আজ নিজেকে আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বিলিয়ে দেয়ার শপথ গ্রহণ করবে। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্র অভাবী মানুষের খুঁজ-খবর নিবে, তাদের দুঃখ-ব্যথা নিজেদের মধ্যে ভাগা-ভাগি করে নেবে। হ্যাঁ, এটাই ঈদের আসল চরিত্র এবং মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে যারা দারিদ্রতার কারণে ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারেনা। বিত্তবানদের ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দের সুবাতাস বইলেও ঐসব লোকের দোরগোড়ায় সুখ আনন্দের সুবাতাস পৌঁছেনা। ঈদের কেনাকাটার সামর্থ তাদের থাকেনা, ঈদ উপলক্ষ্যে স্বতন্ত্র খাবারের আয়োজন তারা করতে পারেনা। আমাদের সমাজে যাদের ঘরবাড়ী নেই, বসবাসের একটা সুব্যবস্থানেই, পরিধানের পর্যাপ্ত পোশাক নেই, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার যাদের ব্যবস্থা নেই, ঈদের দিনে তারা আলাদা খাবার, পিঠা-মিষ্টি, নতুন পোশাক, জুতো ও সাজ-গোজের আয়োজন করবে কিভাবে? এরা সাধারণত বিভিন্ন রেলষ্টেশন, বাসটার্মিনাল, শহরের ফুটপাত, ওভারব্রিজের নীচে বা কোন মাজারের আশেপাশে বসবাস করে। এদের মধ্যে দুর্বল নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। ক্ষুধাও রোগ-বালাই, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অবমূল্যায়ন, প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা, ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ হাজারো সমস্যার সাথে এদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম। তাদের জীবনটাই যেন তাদের জন্য বোঝা। সমাজের এই শ্রেণীর লোকগুলো ঈদের আনন্দের চিন্তা করতে পারে কিভাবে?
দূরারোগ্য ব্যধীতে আক্রান্ত অনেক লোককে দেখা যায় ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের জীবন ধারণ করে। অনেক পঙ্গু, প্রতিবন্ধি আছে যারা ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। ঈদের দিনে ঈদের নামাজে যাওয়ার সময়ও অনেক শিশু কিশোরকে ভিক্ষার ঝুলি কিংবা চটের বস্তা পিঠে ঝুলিয়ে ঘুর ঘুর করতে দেখাযায়। তাদের বয়সের শিশু কিশোরেরা ঈদের আনন্দ উল্লাস করলেও তারা কিন্তু আনন্দ উল্লাসের পরিবর্তে বড়লোকদের উচ্ছিষ্ট কুড়াতে ডাস্টবিনে তখন হানা দেয়। ঈদের আনন্দ কাকে বলে এরা কি তা বুঝে?
আমাদের সমাজে অনেক শিল্পপতি, অনেক টাকাওয়ালা, অনেক ডাক্তার, অনেক হাসপাতাল, অনেক ঔষধ, অনেক যন্ত্রপাতি, অনেক দাতব্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, অনেক মানবাধিকার সংগঠন ও অনেক সমাজ সেবী থাকা সত্বেও এই মানুষগুলোর এই দুরবস্থাকেন? আসলে এদের দিকে কেউ ফিরে থাকাচ্ছেনা। অল্প সাময়িক দান খয়রাত তাদের করা হলেও এর দ্বারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছেনা। তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছেনা। সবশ্রেণীর মানুষকে নিয়েই আমাদের সমাজ। এই অসহায় অযতনে পড়ে থাকা লোকগুলোও আমাদের সমাজের অংশ। ওদের জীবনে শুধু দুঃখ থাকবে, কোন আনন্দ উৎসবে ওরা আমাদের সাথে শরীক হবেনা অথার্ৎ, কেউ করবে বিলাসিতা আর কেউ ক্ষুধায় কাতর, একই সমাজে কেঊ করবে খুরমা-পোলাও রান্না আর কেউ করবে জবা জ্বালায় কান্না, কেউ থাকবে পাঁচতলায় আর কেউ গাছতলায়, কেউ খাবে আর কেউ খাবেনা তা কি কোন সভ্য সুন্দর সমাজের বৈশিষ্ট হতে পারে?
সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ যদি হয় ক্ষুধার্ত, দুস্থ্য, পীড়িত, ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ দুর্দশায় জর্জড়িত তাহলে আগে ঐ মানুষ গুলির জীবনের মনোন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ঈদ আমাদের কে এই অসহায় বঞ্চিত মানুষগুলির পাশে দাঁড়াবার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাদের দুঃখ দুর্দশা ঘুচাতে, তাদের কান্না থামাতে, ঈদের আনন্দ তাদের সাথে ভাগাভাগি করে তাদের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটাতে ঈদ আমাদের অনুরোধ করে।
ঈদগাহের এক কোণে একটি ইয়াতীম শিশুকে কান্না করতে দেখে বিশ্বনবী সা. তাকে বুকে জড়িয়ে নেন এবং তাকে শান্তনাদিয়ে বলেন, ‘আজ থেকে আমি তোমার পিতা এবং আয়শা (রা.) তোমার মাতা।’ বিশ্বনবী, করুনার ছবি, মাবতার কান্ডারী সা. বলতেন, যে ব্যক্তি ধন সম্পদ রেখে মারা গেল তা তার আত্মীয় স্বজনদের পাওনা এবং যেব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় অথবা ছোট ছোট শিশুদের রেখ মারা গেল তার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব এবং তার ইয়াতীম শিশুদের অভিভাবকত্ব আমার উপর।-মুসলিম শরীফ
বিশ্বনবী সা. আরো একটি হাদীসে বলেন, সমস্ত মুসলমান জাতি মিলে এক দেহের মত। এক দেহের এক অঙ্গ যদি ব্যথিত হয় সারা অঙ্গ সেই ব্যথা অনুভব করে। এক চোখে ব্যথা হলে সারা শরীর সে ব্যথা উপলব্ধি করে।-মুসলিম শরীফ।
পবিত্র কোরআনে সূরা যারিয়াতের ১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে,‘ যাদের সম্পদ আছে তাদের সম্পদে ঐসব লোকদের অধিকার রয়েছে যাদের সম্পদ নেই।’ বিশ্বনবী সা. এর একটি হাদীসে আরো বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে, ‘যেকোন মুসলমান অন্য কোন উলঙ্গ মুসলমানকে কাপড় পরিধান করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিধান করাবেন। যেকোন মুসলমান অন্যকোন ক্ষুধার্ত মুসলমানকে আহার করাবে আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল থেকে আহার করাবেন। যেকোন মুসলমান কোন পিপাসার্ত মুসলমানকে পানি পান করাবে আল্লাহ তাকে ‘রাহীকে মাখতুম’ থেকে পানি পান করাবেন।’ আবুদাউদ শরীফ
আজ যারা দারিদ্র্যতা ও অসহায়ত্বের কারণে ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারছেনা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব আমরা ব্যক্তিগত ভাবেও পালন করতে পারি আবার সামষ্টিগতভাবে তথা সমাজিকভাবে ও পালন করতে পারি। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় অনুসন্ধান চালিয়ে কাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই তাদের তালিকা তৈরী করে ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা হলো ঈদুল ফিতিরের দাবি, মানবতার ও নৈতিকতা এবং ঈমানের দাবি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।