বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
রমজান রহমত, মাগফিরাত এবং নাজাত বা মুক্তির মাস। এটি কোরআন নাজেল হওয়ারও মাস। মক্কার পৌত্তলিক কাফেররা কোরআনকে অস্বীকার করেছিল, মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। নুজুলে কোরআনের পূর্বে ইহুদী, খ্রীষ্টানরা আসমানী কিতাবগুলোকে বিকৃত করেছিল বলে খোদ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। ওরা আশাবাদী ছিল, সর্বশেষ নবীর আগমন ঘটবে তাদের মধ্যে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি, আল্লাহ শেষ নবী প্রেরণ করেছেন আরব জাতির মধ্যে এবং সর্বশেষ আসমানী কিতাব কোরআনও নাজিল করেছেন তারই প্রতি। ইহুদী-খ্রিস্টানরা রাগে, ক্ষোভে, বিদ্বেষে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) এর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তাঁর প্রতি অবতীর্ণ শেষ আসমানী গ্রন্থ আল কোরআনকেও ঝুটলাতে থাকে। কোরআনকে তারা যাদুমন্ত্র আখ্যায়িত করে এবং অস্বীকার করে। আল্লাহ কোরআনের বহু স্থানে তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তার হুকুম অমান্য করার জন্য ভয় প্রদর্শন করেছেন এবং আজাবে এলাহী ও কঠোর শাস্তির কথা বলেছেন। তিনিই বলেছেন, কোরআন খাঁটি, বিশুদ্ধ, নির্ভূল আসমানী কিতাব এতে কোন বেশকম নেই, পরিবর্তন নেই, বিকৃতি নেই, এটি যাদুমন্ত্রের কোন গ্রন্থ নয় এবং সকল প্রকারের দোষ-ত্রæটি মুক্ত রাখার এবং এর নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব খোদ আমার।
খোদাদ্রোহী এবং ইসলামবিদ্বেষীরা যুগে যুগে দেশে দেশে কোরআনের অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে ইহুদী-নাসারা ও কাফের-মোশরেকদের পদাঙ্ক অনুসারী চক্রগুলো ওত পেতে আছে। তারা প্রকাশ্যে গোপনে পবিত্র কোরআনের অবমাননা, বিকৃতি, ভূল ব্যাখ্যা, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণায় লিপ্ত। এ ধরনের ঘটনাবলীর খবরাখবর সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এসব ইসলামবিদ্বেষী চক্রের অপপ্রচার হতে কোরআনকে রক্ষা করার জন্য মুক্তির মাস রমজানে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
ইসলামের দুশমন, নাদান দোস্ত এবং জ্ঞানপাপীদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু লোক সুযোগ পেলেই পবিত্র কোরআন সম্পর্কে নানা প্রকারের অবান্তর অযোক্তিক প্রশ্ন তোলে এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিছু কিছু তথাকথিত বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী অদৃশ্য শক্তি তকদীর (ভাগ্যলিপি) বলে কিছু আছে, এ সত্য ও বাস্তবকে অস্বীকার করে। এমনকি তাদের মধ্যে আধুনিকতা প্রিয় পশ্চিমা বিকৃত আদর্শ ও অপসংস্কৃতির পূজারী লোকেরও অভাব নেই, যারা ঈমান আকীদা বিসর্জন দিয়ে খোদ আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করে। অনরূপভাবে এ বিকৃত চিন্তা ধারার লোকেরাই অদৃশ্য শক্তি, ফেরেশতা, জি¦ন এবং ভাগ্যলিপি ইত্যাদির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে থাকে এবং লওহে মাহফুজ হতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, এ কথাও অস্বীকার করতে তাদের দ্বিধা নেই। তাই এখানে সত্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে ‘লওহে মাহফুজ’ কী তাও বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কেননা তা না হলে ‘লওহে মাহফুজে’র অস্তিত্ব অস্বীকার করে পবিত্র কোরআনের ওপর আঘাত করা সহজ হয়, যাতে ইসলামের ভিত্তিমূলকে দুর্বল ও বিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। ইহুদী-নাসারাদের এ রূপ ষড়যন্ত্র বানচাল করতে ‘নুজুলে কোরআনে’র এ রমজান মাসকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হয়।
মানব বসতি হতে অকল্পনীয়, মানব দৃষ্টির অন্তরালে আরশের পাশে অবস্থিত অপূর্ব একটি কুদরতি নিদর্শন ‘লওহে মাহফুজ’ বা ‘লিখিত ফলক’। পবিত্র কোরআনের আম পারায় সূরা ‘বুরুজে’র শেষ আয়াতই ‘লওহে মাহফুজ’। মক্কার কাফের পৌত্তলিক কোরআন নিয়ে, বিদ্রæপ করত ও কোরআনকে যাদুমন্ত্র ছাড়া আর কিছ্ ুমনে করত না। ওদের এ ভ্রান্ত ধারণার জবাবে বলা হয়; ‘বরং এটা মহিমান্বিত কোরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ আছে।’
‘লওহে মাহফুজ’ বলতে ‘সংরক্ষিত ফলক’ বুঝানো হয়েছে। ‘লওহে মাহফুজ’ কী, কোথায় এর অবস্থান? এসব নিয়ে বিভিন্ন তফসীর গ্রন্থে বিবরণ রয়েছে।
বিখ্যাত তফসীর ‘তফসীরে হাক্কানী’ নামে প্রসিদ্ধ ‘তফসীরে ফাতহুল মান্নানে’ হজরত মওলানা আবু মোহাম্মদ আব্দুল হক হাক্কানী তাঁর ভূমিকায় ‘লওহে মাহফুজ’ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। অন্যান্য তফসীরেও এর বিবরণ রয়েছে যার সংক্ষিপ্তসার এই: এটা আরশের ডান দিকে অবস্থিত। হজরত ইবনে আব্বাস (রা:) এর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘লওহে মাহফুজে’র ওপর লেখা আছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু দ্বীনুহুল ইসলাম, ওয়া মোহাম্মাদুন আবদুহু ওয়া রাসূলুহু, ফামান আ’মানা বিল্লাহি আজ্জা ওয়া জাল্লা, ওয়া ছাদাকা বিআবদিহি, ওয়া ইত্তাবা রুসুলাহু, আদখালাহুল জান্নাতা।
অর্থাৎ- ‘একক আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তার মনোনীত ধর্ম ইসলাম এবং মুহাম্মাদ (সা:) তাঁর বান্দা ও রসূল। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার প্রতি বিশ^াস স্থাপন করেছে এবং তাঁর বান্দাকে স্বীকার করেছে এবং তাঁর রসূলগণের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন।’
তিনি বলেন; ‘ফলকটি হচ্ছে সাদা মুক্তা খচিত। তার দৈর্ঘ আসমান হতে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রস্থে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত প্রসারিত এবং তা মুক্তা ও ইয়াকুত (মূল্যবান পাথর বিশেষ) পাথর দ্বারা বেষ্টিত এবং তার পাশ গুলো লাল ইয়াকুত পাথর দ্বারা সজ্জিত এবং কলম নূরের তৈরি এবং রহস্যময় কালাম (বাক্য) আরশের সাথে যুক্ত এবং তার মূল যুক্ত রয়েছে বাদশাহর কক্ষে। (খাজেন)
এ লওহে মাহফুজকে ‘উম্বুল কিতাব’ও বলা হয়। এর কালাম হচ্ছে কাদীম বা আদি এবং তাতে প্রত্যেক বস্তু ও কথা রয়েছে, যা সমস্ত গ্রন্থের রহিতকারী। ‘লওহে মাহফুজ’ হতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ:) মহানবী হযরত রসূলে করিম (সা:) এর নিকট খন্ড খন্ডভাবে নিয়ে আসতেন এবং নবুওয়াতের মক্কী ও মাদানী জীবনের ২৩ বছর সময় কালের মধ্যে সমগ্র কোরআন অবতীর্ণ করেন। এ কোরআনে সংশয়-সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এটি হেফাজত ও সংরক্ষণের দায়িত্ব খোদ আল্লাহতালা নিয়েছেন বলে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন ‘কোরআনের বিরুদ্ধে আল্লাহদ্রোহী ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।