Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রভাব পড়ছে বড় শপিংমলগুলোতে বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রমজান মাস, রাজধানীজুড়েই যানজট, প্রচন্ড রৌদ্র আর উষ্ণ আবহাওয়া। এসব বাধা পেরিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে মার্কেটে যাওয়ার পর দোকানির সাথে দর কষাকষির বিষয় তো আছেই। নগরজীবনের ব্যস্ততা আর এতোসব ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে তাই অনেকেই এখন ঝুঁকছেন অনলাইন কেনাকাটায়। ঘরে বসে ছবি দেখে পছন্দ হলে বিস্তারিত জেনে অর্ডার করছেন একটি ক্লিকেই। ৪০ থেকে ১০০ টাকার চার্জের বিনিময়ে একদিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের দরজায়। গত কয়েক বছর ধরেই কেনাকাটার এই মাধ্যমটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। শিক্ষার্থী, তরুণদের পাশাপাশি কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য এখন কেনাকাটার প্রধান মাধ্যম এটি। অর্ডারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই নারীরা। কেনাকাটায় সিংহভাগই তাদের অর্ডার বলে জানিয়েছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইক্যাব)। রমজান, ঈদসহ অন্যান্য ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে এই ভার্চুয়াল বাজার হয়ে ওঠে রমরমা। এখনকার দিনে অনলাইন মার্কেটে জামা-কাপড়, জুয়েলারি, শাড়ি, প্রসাধনী, ঘর গোছানোর সামগ্রী, চাল-ডাল, মাছ-মাংস, সবজি থেকে শুরু করে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, গহনা, ব্যাগ-কসমেটিকস, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সবই মিলছে অর্ডার করলেই। বাদ যাচ্ছে না রমজান মাসের সেহরি ও ইফতার। রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে নামিদামিসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট অর্ডার করলেই ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে পছন্দসই সেহরি ও ইফতার। এর জনপ্রিয়তা ও আগ্রহের কারণে উদ্যোক্তারাও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ই-কমার্স সাইট নিয়ে আসছেন। ওয়েব সাইটের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকও যোগ হচ্ছে এই বেচাকেনায়। ক্রেতাদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে কয়েক বছর ধরে আয়োজন করা হচ্ছে অনলাইন ঈদ মেলারও।
ঈদকে সামনে রেখে প্রায় প্রত্যেকটি অনলাইন শপই বিভিন্ন ছাড় দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই মৌসুমে ব্যাপক পণ্য সমাগমও করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ফ্যাশন পণ্যে অনলাইন শপ দারাজ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। মেয়েদের রূপচর্চা বিষয়ক কিছু পণ্যে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে একই প্রতিষ্ঠান। অনলাইন শপ ‘দারাজ’ ঈদের কেনাকাটায় ৩০০ টাকা পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বাগডুম ঈদ উপলক্ষে ২ হাজার টাকার বেশি কেনাকাটা করলে ৩০০ টাকা পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের পাশাপাশি বিকাশ পেমেন্টে ২০ শতাংশ ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাকের অফার দিয়েছে। বিকাশের অফারটি আছে অথবা, প্রিয়শপ থেকে শুরু করে বেশকিছু অনলাইন শপে। পিকাবোতে রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। এ ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটি শপই ঈদের জন্য রেখেছে তাদের বিশেষ অফার।
ই-কমার্স সাইটগুলো থেকে কেনাকাটা করেন এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে দিনকে দিন। শুধু রাজধানীতে নয়; সরাদেশেই বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা। এতোদিন কেবল ঢাকা কেন্দ্রীয় অনলাইন মার্কেট থাকলেও এখন দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও গড়ে উঠছে এধরণের কেনাবেচা। বাংলাদেশে এখন বছরে এক হাজার কোটি টাকার পণ্য অনলাইনে বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব)।
সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও ইংলিশ সার্চ এর কর্ণধার রাজিব আহমেদ বলেন, প্রতিদিন দেশের এক হাজার অনলাইন শপ অনলাইনে ডেলিভারি দেয় ২০ হাজার অর্ডার। এছাড়া ফেসবুক ভিত্তিক আছে ১০ হাজারেরও বেশি। চলতি বছর এই কেনাকাটা দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। অন্যদিকে সরকারের সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হবে বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বাগডুম ডটকমের চেয়ারম্যান শামীম আহসান।
কয়েক বছর আগেও ঈদ শপিং মানেই ছোটবড় বিভিন্ন শপিংমল, বিপণি বিতান ও ফ্যাশন হাউসে ঘুরে ঘুরে পণ্য কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে অনেক ব্যবসা কার্যক্রম চলছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। প্রয়োজনীয় সব ধরণের পণ্য কেনা বেচা হচ্ছে অনলাইনেই। ফলে এক দিকে যেমন অনলাইন শপিংয়ের পরিধি ও পরিসর সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যদিকে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সেও পড়ছে তার প্রভাব। ঈদের সময় কিছুটা ভিড় থাকলেও অন্যান্য সময় বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কের মতো বড় শপিং মলগুলো অধিকাংশ সময় থাকছে ফাঁকা। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি অনলাইনের এই দাপাদাপিতেও বাজারে তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। বসুন্ধরা সিটির দোকান মালিক সাইফুজ্জামান বলেন, অন-লাইনে কেনাকাটা এখনও একটা নির্দিষ্ট গÐির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া এখনও ঘরে বসে কেনাকাটা করার থেকে বাজারে গিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করার লোকের সংখ্যা অনেক বেশি।
মেয়েরাই বেশি কেনাকাটা করছেন: অনলাইন কেনাকাটায় পুরুষদের তুলনায় নারীরাই বেশি এগিয়ে। অনলাইন শপিং সেন্টার বা ফেইসবুক পেজের মাধ্যমে যারা শপিং সেন্টার খুলে বসেছেন তাদের মতে, সারাদিনে যা অর্ডার আসে তার সিংহভাগই দেন নারীরা। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা। এ বিষয়ে কিনলে ডটকমের প্রধান নির্বাহী এবং ই-ক্যাবের ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান সোহেল মৃধা বলেন, বর্তমানে অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছি। সাধারণ ক্রেতারা এখন অনলাইন কেনাকাটায় বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অবশ্যই এটা একটা সম্ভাবনাময় খাত। তিনি বলেন, সারাদিন ১৫০ থেকে ২০০ কাস্টমারের কল পাই আমরা। পণ্যের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান তারা। সাধারণত অনলাইন কেনাকাটায় নারীরাই বেশি আগ্রহী এবং তাদের কাছ থেকেই বেশি অর্ডার আসে। অনলাইন শপিংয়ে নারীরা এগিয়ে আছেন জানিয়ে রঙ্গিলা শপের স্বত্বাধিকারী শারমিন আক্তার বলেন, বিভিন্ন পণ্য দেখে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটার বিষয়টা মেয়েদের এমনিতেই পছন্দের। বর্তমানে অনেক অনলাইন শপের পাশাপাশি প্রচুর ফেইসবুক পেজের মাধ্যমেও কেনাকাটা হচ্ছে। তিনি বলেন, নারীরা এসব সাইট বা ফেইসবুক পেজে ভিজিট করে নানা ধরনের পণ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন এবং দরদাম তুলনা করতে পারছেন। আর বাজারে গিয়ে কেনাকাটার জন্য যানজট, ভিড়, দামের তারতম্য উপেক্ষা করতেই তারা ঝামেলাহীন অনলাইন শপিংয়ে বেশি আগ্রহী।
উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেইসবুক। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে এ মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এক্সক্লুসিভ ফ্যাসন’এর সত্ত¡াধিকারী ফাহাদ জামান শীলা বলেন, কিছুদিন হল আমি ই-কমার্স শুরু করেছি। অনলাইনে একটি পেইজ ওপেন করেই তাতে কিছু ছবি দিয়ে যে ধরনের সাড়া পাচ্ছি তা অনেক ভালো। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি এই কাজটি করছেন। শীলা বলেন, কুরিয়ারের লোক বাসায় এসে অর্ডার নিয়ে যান, আমার তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না। তা ছাড়া ব্যবসা করতে গেলে যে ধরনের ঝামেলা থাকে তা এই ব্যবসায় নেই।
কেনাকাটায় ঝামেলামুক্ত ও সহজ এই মাধ্যমে ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ। দোকান, শপিং মলের ভিড় উপেক্ষা করে বাজার সারছেন বাড়িতে বসেই। সকাল সাড়ে সাতটায় অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বরে হয়ে সন্ধ্যা সতাটায় ফিরেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী উত্তরার বাসিন্দা কামরুন নাহার। তিনি বলেন, আট ঘণ্টা অফিস আর সড়ে তিন ঘণ্টার যানজট ঠেলে কাজ করার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বের হতে ইচ্ছে হয়না। এছাড়া বাচ্চাদের সময় দেয়া এবং অন্যান্য জমে থাকা কাজ তো আছেই। এজন্য কেনাকাটার সময়ই বের করতে পারেন না তিনি। তাই অনলাইন কেনাকাটা তার জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি জিনিস কিনতে আগে পুরো বিপণিবিতান ঘুরতে হতো। এতে অনেক সময় নষ্ট হতো। এখন ঘরে বসেই পছন্দের জিনিস পেয়ে যাচ্ছি। অনলাইনের ক্রেতারা বলছেন, অনলাইনে কেনাকাটা করার অনেক সুবিধা আছে। সেখানে নিজের পছন্দ মতো জিনিস বেছে নেওয়া যায়। কেউ কিছু নিতে চাপ দেয় না বা বাধ্য করে না। আবার কোনও জিনিস কেনার পরে অসুবিধা হলে বা পছন্দ না হলে টাকা ফেরত ও জিনিস পাল্টে নিতেও কোনও অসুবিধা হয় না।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ই-কমার্স বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই বছরে রাজধানী ও এর আশপাশসহ বড় শহরগুলোর কেনাকাটার চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে চিরাচরিত বাজারগুলোতে ভিড় কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা বলছেন, ১৬ থেকে ৫৫ বছরের পুরুষ ক্রেতাদের বেশিরভাগই অনলাইনে জিনিস কিনতে পছন্দ করছেন। ঠিক তেমনই ১৬ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে অনলাইনে জিনিসপত্র কেনা। বিশেষ করে সেই নারীরা যাদের পেশাগত কারণে প্রতিদিন বাইরে বেরোতে হয়, খুব দ্রæত হারে বাড়ছে এ পরিমাণও। তারা আরও বলছেন, টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে অনলাইনে বেশ কিছুটা কম দামে জিনিস দেওয়া সম্ভব, যা কোনোভাবেই সাধারণ দোকানে দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু পোশাক নয় অনান্য জিনিস কেনার ক্ষেত্রেও তাই বাড়ছে অনলাইনের চাহিদা।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, এখন শুধু অনলাইন ওয়েবসাইটেই (ফেইসবুক বাদে) প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার অর্ডার প্রসেস হয়। অনলাইনে এখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে সব ধরনের পণ্যই পওয়া যায়। টিকেট বিক্রি, স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয় অনলাইনে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে সবচেয়ে বড় সুবিধা ক্রেতারা যেটা পাচ্ছেন, সেটা হল ঘরে বসে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন। আর অনেক ক্ষেত্রে এই দাম শপিংমলের দামের থেকেও কম থাকায় ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

 



 

Show all comments
  • তপন ১ জুন, ২০১৮, ৪:২৬ এএম says : 0
    সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে যায়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শপিং

৯ এপ্রিল, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ