Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডুবন্ত জাহাজ সুন্দরবনের গলার কাঁটা

ডুবে যাওয়া কয়লা বোঝাই এমভি বিলাস উদ্ধারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

| প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বন্দর কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের উদ্ধারকারী কোনো জলযান নেই

আবু হেনা মুক্তি : উদ্ধার না হওয়া জাহাজগুলি এখন সুন্দরবনের গলার কাঁটা। বার বার ডুবছে জাহাজ। লোক দেখানো কিছুদিন চেষ্টা করা হয় উদ্ধারের। এরপর আর কোন খবর থাকে না। যেন দেখার কেউ নেই। সর্বশেষ সুন্দরবনে পশুর নদের হারবাড়িয়া এলাকায় ডুবে যাওয়া কয়লাবাহি লাইটার জাহাজ এমভি বিলাসকে দেড় মাসেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জাহাজটির ভেতরে পলি জমে বড় স্তর তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় জাহাজটির ভেতর থেকে কয়লা উত্তোলন বন্ধ রেখে সনাতন পদ্ধতিতে জাহাজটিকে টেনে তোলার জন্য প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু আগামী ৭ দিনের মধ্যে এটা উদ্ধার করা সম্ভব না হলে আর কখনও এটি উদ্ধার হবে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পণ্যের রাসায়নিক পদার্থে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ জীববৈচিত্র। পানির মাধ্যমে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বনের মাটিতেও। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘কয়লার ক্ষতি প্রাথমিকভাবে চোখে ধরা পড়ছে না। তবে কয়লার সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের পানি, জীব ও পরিবেশকে দূষিত করবে। যার ফলে নদীতে মাছের বংশবিস্তারে সমস্যা হবে। দূষিত পানি ব্যবহার করে স্থানীয়দের নানা ধরনের রোগ হতে পারে।’
এদিকে ডুবে যাওয়া জাহাজটির মালিক পক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. বাহারুল ইসলাম বাহার বলেন, আধুনিক জলযানের অভাব, নদীর ¯্রােত আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কয়লার জাহাজটি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জাহাজটি নদীর তলদেশে আরও দেবে যাচ্ছে। প্রচুর পলি পড়ায় এখন আর কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, যদি খুলনায় বিআইডবিøউটিএ অথবা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে বড় ধরনের উদ্ধারকারী কোনো জলযান থাকতো তাহলে এত দেরি হত না। বর্তমানে জাহাজটিকে দু’পাশে দুটি টাগ বোট দিয়ে টেনে তোলার জন্য প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে সরঞ্জামাদি আনা হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব না হলে এটি উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিতে হবে বলে এ শ্রমিক নেতা জানিয়েছেন।
মোংলা বন্দরের হারবার সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি এক হাজার মেট্রিক টন কয়লাবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ এমভি আইচগাতি ডুবে যায়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ শ্যালা নদীর ধানসাগর এলাকায় এক হাজার ২৩৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জাবালে নূর, ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পশুর নদীর চিলা এলাকায় খাদ্য গুদামের (সাইলো) কাছে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জিয়ারাজ। একই বছর পশুর নদীর হারবারিয়া এলাকায় সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল জিপসাম নিয়ে ডুবে গিয়েছিল এমভি সি হর্স। বড় বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বরে। এদিন চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। এতে তেল ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। এতে বনের জীববৈচিত্র্য ও মাছের উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, শেলা নদী দিয়ে এখন আর পণ্যবাহি জাহাজ চলাচল করে না। তবে মোংলা বন্দরের কারণে পশুর নদ দিয়ে পণ্যবাহি জাহাজ চলাচল করে। সে কারণে এটি বন্ধ করার সুযোগ নেই। এখন প্রয়োজন জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন। তিনি বলেন, জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়।
বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক চক্র নানা চক্রান্ত্রে সক্রিয়। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের বুক চিরে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো জাহাজ অবাধে চলাচল, একের পর এক জাহাজ ডুবি, ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার না হওয়া, মাঝে মধ্যে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল নদীতে সয়লাব সহ নানাবিধ কৃত্রিম সংকটে হুমকির মুখে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন। পরিবেশবাদীদের অন্দোলন সংগ্রামের মুখে সুন্দরবনের কোল ঘেষে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান আর ঘন ঘন সুন্দরবনের নদীতে জাহাজ ট্যাংকার ডুবির ঘটনা একই সূত্রে গাথা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি এটি নাশকতা কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
উল্লেখ্য, গত ১৪ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদের হারবাড়িয়া এলাকায় ডুবোচরে ধাক্কা লেগে লাইটার জাহাজ এমভি বিলাস ডুবে যায়। জাহাজটিতে ৭৭৫ টন কয়লা ছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ ও নবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির বিভাগীয় মহাসচিব আজগর হোসেন বলেন, বার বার সুন্দরবনের নদ নদীতে জাহাজ কার্গো ট্যাংকার ডুবি হচ্ছে। ডুবন্ত জাহাজগুলি উদ্ধারে নেয়া হচ্ছে না দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ। বাংলাদেশী অংশে সুন্দরবন ধ্বংসে অন্য রাষ্ট্রের চক্রান্ত রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ সুন্দরবন বাংলাদেশের সম্পদ। আর ভারত সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন প্রকল্প সুন্দরবনের কোলেই নির্মান করছে। এ ধরণের ক্ষতিকর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারত কেন তাদের সুন্দরবন অংশে করল না। তিনি এ ব্যাপারে বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
প্রকৃতির এই অনাবদ্য দান সুন্দরবনকে তার আপন গতিতে চলতে বাধা সৃষ্টি এবং সুরক্ষায় বাস্তবমুখী প্রকল্প গ্রহন না করায় সুন্দরবন যেন কাঁদছে। যে সুন্দরবন প্রকৃতির রূদ্র রোষ থেকে মায়ের মত আগলে রাখে উপকূলীয় অঞ্চলের জনপদকে তাকে যেন আর কৃত্রিম সংকটে ক্ষতবিক্ষত না করা হয় এমন দাবি তুলেছেন পরিবেশবিদরা। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় বিশ্ব যেখানে সদা জাগ্রত সেখানে অভ্যন্তরীনভাবে সুন্দরবন সুরক্ষায় বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাহাজ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ