Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রফতানির শঙ্কায় চাষিরা

বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম ‘ফ্রুট ব্যাগিং’

| প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : আমগাছে বাবুই পাখির বাসা। অবাক কান্ড বলে ভ্রম হতেই পারে যারা প্রথম বার চাপাইনবাবগঞ্জের আ¤্রকুঞ্জে এসেছেন তাদের কাছে। গাছে গাছে দু’চারটা নয় শত শত ব্যাগ ঝুলছে। এগুলো হলো ফ্রুট ব্যাগিং। সব মিলিয়ে এখন এর সংখ্যা পাঁচ ছয় কোটির উপরে। সংখ্যা এখনো বাড়ছে। শেষ অবধি সাত আট কোটি হবে এমনটি ধারণা করা হচ্ছে। আম চাষে ক’বছর হলো যোগ হয়েছে ‘‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি। দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। সবাই চায় নিরাপদ বিষমুক্ত আম। তাই বলে অন্য আম যে নিরাপদ নয় তা কিন্তু নয়। এখন আম চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। শুধু দেশে নয় বিদেশেও আম যাচ্ছে। চাষীদের মধ্যে এখানকার আম মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ পাঠানোর স্বপ্ন। এতে দেশের নাম হবে আর চাষীরা ভাল দাম পাবে। বছর তিন চারেক আগে অতিরিক্ত বালাইনাশক ও ফরমালিন দেয়াকে কেন্দ্র করে যেসব অভিযান চলে তাতে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মেট্রিকটন আম রোলারের নীচে পিষ্ট হয়। চলে নেতিবাচক প্রচারণা। আম চাষীরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত। এসময় চীনে যান চাপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার কৃষি বিজ্ঞানী ড. মো: শরফ উদ্দিন। সেখানে প্রত্যক্ষ করেন ফ্রুট ব্যাগিং আম চাষ। কিছু ব্যাগ নিয়ে এসে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে ভাল ফল পান। এরপর এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেন আম চাষীদের মধ্যে। শুরুতে পদ্ধতিটি চালু করা খুব একটা সহজ ছিলনা। কিভাবে ব্যাগিং করতে হবে তা জানা ছিলনা। প্রথম একটু দ্বিধা থাকলেও প্রশিক্ষণ পেয়ে তা অল্প সময়ে ঠিক হয়ে যায়। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফ্রুট ব্যাগিং। বাংলাদেশে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের জনক ড. মো: শরফ উদ্দিন বলেন এগুলো হলো এক স্তর বিশিষ্ট সাদা এবং স্তরবিশিষ্ট বাদামী রংয়ের বিশেষ কাগজের ব্যাগ। যা আমের ওজন যখন চল্লিশ পয়তাল্লিশ গ্রাম হয় কিংবা আম ধরার ষাট দিনের পর জাত ভেদে ব্যাগিং করতে হয়। ব্যাগের ভেতরে বাড়তে থাকে আম। এর বৈশিষ্ট হলো আম গাছে বালাই নাশকের ব্যবহার সত্তর হতে আশী ভাগ কমানো সম্ভব। যেখানে সাধারণ আমগাছে মুকুল আসার আগ থেকে শুরু করে ফল নামানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে পোকা দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা হয় পনের থেকে পঞ্চাশবার। সেখানে ফ্রুট ব্যাগিং আমে পাঁচ সাতবার কীটনাশক ব্যবহার যথেষ্ট। নন ব্যাগিং কীটনাশকের খরচের চেয়ে ব্যাগিং পদ্ধতি অনেক সাশ্রয়ী। তাছাড়া এ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপন্ন হয়। ব্যাগিং পদ্ধতির এ প্রযুক্তি চীন ছাড়াও থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে বেশ সফলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ড. শরফের হাত ধরে চাপাইনবাবগঞ্জে প্রযুক্তি চালু হয়। শুরুতে এর প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতা বিশেষ করে ব্যাগিং করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মধ্যেই শুরু হয় ফ্রুট ব্যাগিংয়ের যাত্রা। এ আম বিষমুক্ত ও নিরাপদই শুধু নয় গাছ থেকে নামানোর পর দশ পনের দিন পর্যন্ত ভাল থাকে। স্থানীয় বাজারের পাশপাশি বিদেশে আম রফতানির সম্ভাবনার দুয়ার খোলে। এ বছর ব্যাগিং পদ্ধতির আম বাগানেই পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বাগানেই প্যাকিং ও স্থানীয় কৃষি দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকা বিমান বন্দরের কোয়ারেনটাইনের মাধ্যমে সরাসরি রফতানি হয়। এ প্রক্রিয়াটি ছিল সহজ। আমের মান দেখে রফতানিকারকরা খুশী। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশে আম রফতানি হয় প্রায় সাড়ে ছয়শো মে:টন। এরমধ্যে ব্যাগিং আম দেড়শো টনের মত। ফ্রুট ব্যাগিং নিয়ে আম চাষীদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। বাগান মালিকরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। ২০১৭ সালে আম রফতানি যেন ভালভাবে হয় সে জন্য আরো গোছানো প্রস্তুতি চলে। রফতানির প্রত্যাশা নিয়ে জোরেশোরে শুরু হলো ব্যাগিং করা। সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো পৌনে তিনকোটি। বিধিবাম হঠাৎ করে জানানো হলো আম সরাসরি নয় আম নারায়নগঞ্জের শ্যামপুরে প্যাকিং হবে। সেখানে রফতানির জন্য আম পাঠানো হলেও নানান কারসাজি করে ব্যাগিং আমের খুব সামান্য অংশ রফতানি করা হয়। তখনও গাছে গাছে লাখ লাখ ব্যাগিং আম নিয়ে চাষীরা পড়ে বিপাকে। আম গাছে থাকা অবস্থায় রফতানি বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্যদিকে নন ব্যাগিং আম রফতানি হয়। এমন অবস্থায় রাজশাহী এগ্রো প্রডিউসার সোসাইটির আহবায়ক আনোয়ারুল হক প্রধানমন্ত্রীর এমডিজি বিষয়ক সমন্বয়ককে বিস্তারিত তুলে ধরে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার চান। তাতে বলা হয় সরকারের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্মকর্তারা কীটনাশক ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজস করে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করেছেন। পক্ষান্তরে কীটনাশক ব্যবহার ও কীটনাশক আমদানীকে উৎসাহিত করেছেন। অভিযোগ পাবার পর কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়্। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অবস্থা দৃষ্টে প্রতিয়মান হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যাগিং আম রফতানির জন্য উৎসাহিত করেছেন বা অগ্রাধিকার দিয়েছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং রফতানিকারকদের ব্যাগিং পদ্ধতির আম সংগ্রহে অবহেলা দেখিয়েছেন। প্রতিবেদনের সুপারিশ মালায় প্রথমেই ব্যাগিং পদ্ধতির আম চাষের সুবিধাগুলো বিবেচনায় রফতানির পাশপাশি দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবার কথা বলা হয়। বিদেশে আম রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার পাশপাশি যথা সময়ে আম পাড়া বাছাই প্যাকিং পরিবহন করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে সতর্কতার সাথে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত। সাথে সাথে আম রফতানিকারক নির্বাচিত চাষীদের সঙ্গে আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পন্ন লিখিত চুক্তি সম্পন্ন করার তাগিদ দেয়া হয়। সরকারী সুপারিশে আম রফতানির ক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিংকে অগ্রাধিকারসহ বিভিন্ন ভাবে উৎসাহিত করায় এবার আম চাষীরা আরো বেশী আগ্রহী হয়। বিদেশে বেশী পরিমান আম রফতানির আশায় শুরু করে গাছে গাছে ফ্রুট ব্যাগিং। যা বাবুই পাখির মত গাছে গাছে দোল খাচ্ছে। সাথে দোল খাচ্ছে আম চাষীদের স্বপ্ন। চাপাইনবাবগঞ্জের চককীর্তি ইউনিয়নের মজিবর রহমান গতবার করেছিলেন নয় লাখ আমে ব্যাগিং। এবার করেছেন চৌদ্দ লাখ। তাছাড়া ব্যাগিং করার প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন অনেকে ক্ষণিকের জন্য কাজ পেয়েছেন গুটিতে ব্যাগ লাগানো। গত বছর প্রায় দু’কোটি আমে ব্যাগিং করা হয়েছিল। এবার পাঁচকোটি ছাড়িয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাতকোটিতে ঠেকবে। ব্যাগিং চাষীরা বলেন ব্যাগ বিদেশ থেকে আমদানী করায় প্রতিব্যাগের দাম পড়ছে ডাবল সিঙ্গেল লেয়ার মিলে গড়ে চার টাকা। দেশে একটি কোম্পানী এ ব্যাগ তৈরী করছে। স্থানীয় কোম্পানী সূত্র জানায়, বিভিন্ন শুল্কের কারণে দাম কমানো যাচ্ছেনা। যদি শুল্ক রেয়াত পাওয়া যায় তাহলে দাম একদেড় টাকার মধ্যে থাকবে। নিয়ম অনুযায়ী রফতানি কারক কৃষি বিভাগ আর চাষীদের সঙ্গে আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পন্ন লিখিত চুক্তি এখনো হয়নি। এ ব্যাপারে চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হুদা এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন এবার ভাল ফলন হয়েছে। ব্যাগিংও হয়েছে প্রচুর। এটি ভাল পদ্ধতি। সব আমে করা যায়। তবে ফজলী আর আশ্বীনায় লাভ বেশী। আম পাকার সময় ইথোফেন ব্যবহার করা কোন ক্ষতিকর বিষয় নয়। এনিয়ে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করা ঠিক নয়। আম রফতানির চুক্তির বিষয়ে বলেন দশজন চাষীর সাথে মৌখিকভাবে চুক্তি করা হয়েছে। আশা করা যায় আম রফতানি ভাল হবে। নন ব্যাগিং আম খারাপ নয়। তবে ফ্রুট ব্যাগিং আমের দাম নন ব্যাগিংয়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। এতে চাষীরা লাভবান হবে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তারা বাঘার চৌদ্দজন চাষীর তালিকা পেয়েছেন কিন্তু এখানেও চুক্তি হয়নি। আম চাষীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন কীটনাশক ব্যবসায়ীরা তৎপর রয়েছে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের বিরোধীতায়। আবার নন ব্যাগিং আম নিয়ে ইথোফেন, কার্বাইড, ফরমালিন ইত্যাদি ব্যবহারে অজুহাতে রোলারের নীচে আম পিষ্ট হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবিষয়ে তৎপর হতে হবে এখনি। নইলে রফতানির ক্ষেত্রে এবারো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

 



 

Show all comments
  • কাজল ৩০ মে, ২০১৮, ২:৩২ এএম says : 0
    এই বিষয়ে সরকারের পুর্ন সহযোগিতা প্রয়োজন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আম

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ