পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আরব নিউজ : ফরিদা মিয়াহ (ছদ্মনাম) একদিন জানতে পারলেন যে, তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন ও ১৮ বছরের দাস্পত্য জীবনের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এখনো তিনি সে আঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। ফরিদা বাংলাদেশী বংশোদ্ভ‚ত ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি যুক্তরাজ্যের একটি দেওয়ানি আদালতে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন যে, তার স্বামী ইসলামী আইন মোতাবেক মোহরানা ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। ফলে তার কিছু পাওনা নেই।
ফরিদা বলেন, আমাদের যা কিছু ছিল তার সব কিছুরই অধিকারী স্বামী।
ফরিদা লন্ডনে বাস করেন। পরিচয় প্রকাশ না করতে তার নাম গোপন রাখা হয়েছে। তার সমস্যার কারণ,
যুক্তরাজ্যের বহু মুসলিম নারীর মতো তার বিয়ে হয়েছে ইসলামী রীতিতে, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ইংরেজ আইনে। এক দশক পেরনোর পরও তিনি পরস্পর বিরোধী সাংস্কৃতিক ও আইনি বিধানের মধ্যে তার দাম্পত্য জীবনে ফেরার লড়াই করে চলেছেন।
আরব নিউজকে ফরিদা বলেন, যুক্তরাজ্যের আদালত বলেছে যে, এ ব্যাপারে তাদের করার কিছু নেই। এমন কোনো আইন নেই যা আমাকে সাহায্য করতে পারে। যেখানেই গেছি, সেখানেই আমার পথ বন্ধ দেখতে পেয়েছি।
ব্রিটিশ মুসলিম সমাজের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হার ইসলামী বিবাহ (রেজিস্ট্রি বিহীন বিবাহ), যাকে আরবীতে ‘নিকাহ’ বলা হয়, বিষয়ে যুক্তরাজ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। আনুষ্ঠানিক আইনগত স্বীকৃতি না থাকায় সম্পর্ক বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দম্পতিরা নাগরিক সমাজে প্রচলিত সুরক্ষা পাচ্ছেন না।
লন্ডনের এসওএএস বিশ^বিদ্যালয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র প্রভাষক সামিয়া বানু বলেন, রাষ্ট্র শুধু বিবাহ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আপনার অধিকার প্রদান করতে পারে। তাছাড়া আপনি কোনো সমর্থন পাবেন না। বিবাহ বিচ্ছেদের পরিণতি দু’পক্ষের উপরই, বিশেষ করে নারীদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে যা প্রায়ই তাদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
২০১৭ সালে এক হাজার মুসলিম মহিলার উপর যুক্তরাজ্যের টিভি স্টেশন চ্যানেল ৪-এর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, তাদের দু’ তৃতীয়াংশেরই বিয়ে হয়েছে ইসলামী নিকাহ রীতিতে। এক চতুর্থাংশেরও বেশি মহিলা বুঝতে পারেননি যে, এতে তারা অধিকার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন যা তারা পেতেন আইনগতভাবে স্বীকৃত ম্যারেজ ইউনিয়নে।
শারিয়া বিবাহ বিচ্ছেদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী সারাহ খান বশির বলেন, এসব নারীর জন্য এ আবিষ্কারটি মারাত্মক হতে পারে। তারা মনে করে যে, স্বামী ও স্ত্রীর যে অধিকার থাকা উচিত তার সবই তারা পেয়েছে, কিন্তু আসলে তা পায়নি। আর যখন তারা তা জেনেছে তখন অনেক বেশি দেরী হয়ে গেছে। তার এক নারী মক্কেল বাড়ি হারানোর সম্মুখীন হন যখন তার ২৩ বছরের বিবাহিত জীবনের পর স্বামী মারা গেলে তিনি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন যে, তার স্বামী তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। খান বশির ঐ নারীর কাছে ব্যাখ্যা করেন যে, কার্যত নিকাহর প্রেক্ষিতেই তিনি স্বামীর সাথে একত্র বাস করেছেন। এ বিষয়টি দৃশ্যত ঐ নারীর জন্য আঘাত ছিল।
পারিবারিক আইনজীবী সিদ্দিক প্যাটেল বলেন, নিকাহ বিবাহ অধিক জনপ্রিয় হচ্ছে। ৩০ বছরের নিচের মুসলিম নারী ও পুরুষেরা যারা যুক্তরাজ্যে জন্ম গ্রহণ করেছে ও বেড়ে উঠেছে , তারা আমাদের কাছে আসছে যাদের বিবাহ রেজিস্ট্রি হয়নি।
সচেতনতার অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে কোনো কোনো সময় সম্পদশালী অংশীদার, সাধারণত পুরষ, বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সম্পত্তির সমান ভাগ এড়াতে সামাজিক রীতিনীতি পাশ কাটিয়ে যায়। প্যাটেল বলেন যে, তারা ৫০ঃ ৫০ ভাগাভাগি হবে বলে ভীত। তিনি বলেন, মহিলারা পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্যাটেল ‘রেজিস্ট্রার আওয়ার ম্যারেজ’ আন্দোলনের পিছনে থাকা টিমের একজন। এ আন্দোলন সকল বিয়ে রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক করা এবং সকল ধর্মকে আওতায় আনা ১৯৪৯ সালের বিবাহ আইনের সংস্কার দাবি করছে। এ আন্দোলনে উদ্যোক্তা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আইনা খান বলেন, ৬৯ বছরের পুরনো এ আইন আধুনিক বহু-সংস্কৃতি ভিত্তিক সমাজের জন্য উপযোগী নয়। এ আইনে শধু অ্যাংগলিকান, কোয়েকার খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মীয় বিবাহরীতি স্বীকৃত। যদিও অন্য সকল ধর্মীয় বিবাহই এ আইনে ক্ষতিগ্রস্ত বলে তারা বিবাহ রেজিস্ট্রি করতে ইচ্ছুক হলেও নতুন বিবাহিত মুসলিমদের ৮০ শতাংশই তা করে না।
ইসলামিক কালচারাল সেন্টার ও লন্ডন কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ড. আহমেদ আল দুবায়ান বলেন, যুক্তরাজ্যের মুসলমানদের দু’টি বিবাহ রীতিই থাকা প্রয়োজন। ব্রিটিশ নাগরিক বা যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী হিসেবে আমাদের সিভিল ম্যারেজ একটি শর্ত হওয়া প্রয়োজন যেহেতু আইন তা চায়। কিছু দম্পতি শুধু নিকাহ বিবাহ পছন্দ করে, কারণ সম্পর্কছেদ হলে তখন আদালত ছাড়াই বিষয়টির সমাধান করা যায়।
ইসলামিক শারিয়া কাউন্সিল বোর্ডের সদস্য ব্রিটিশ মুসলিম স্কলার ড. হাইসাম আল-হাদ্দাদ বলেন, ইসলামী বিবাহ সহজ। এ জন্য কোনো ইমাম লাগে না, রেজিস্ট্রি অফিস প্রয়োজন হয় না, কোনো নির্দিষ্ট ভবন দরকার হয় না। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রি বিয়ের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ উভয় পক্ষের জন্যই দুঃস্বপ্ন।
ইসলামী বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থীরা শারিয়া কাউন্সিল বা স্থানীয় ইমামের মাধ্যমে সে ব্যবস্থা করতে পারেন। সমস্যা হচ্ছে যে ্এর মাধ্যমে তারা সমান্তরাল আইনি পদ্ধতি স্থাপন করেন , কিন্তু যুক্তরাজ্যে কোনো কাউন্সিল বা ইমামের দেয়া বিধান স্বীকৃত নয় অথচ ব্রিটিশ মুসলমানদের মধ্যে তার গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব রয়েছে।
ইস্ট লন্ডন মসজিদের ্পর ড. হাদ্দাদের অফিসের বাইরে ১৮ বছরের বিয়ে ভাঙ্গার বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য অপেক্ষমান সুমাইয়া আলি (আসল নাম নয়) বলেন, যুক্তরাজ্যের বিবাহ বিচ্ছেদ আদালতে যাওয়ার চেয়ে এ পথ বেশি সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের। তিনি বলেন, এটা আমার জন্য ভালো, তবে আমার তা করা দরকার নেই।
ইসলাম ধর্মে স্বামীরা তিনবার ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করে স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। কিন্ত স্ত্রীরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে স্বামীর সম্মতি নিতে হয়। তাতে ব্যর্থ হলে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য শারিয়া কাউন্সিলের কাছে ‘খুলা’ চেয়ে আবেদন করা ছাড়া স্ত্রীর আর কোনো পথ নেই।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ড. আল হাদ্দাদের অনুমান যে যুক্তরাজ্যে শারিয়া কাউন্সিলে শুরানি করা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আবেদনই ম্ঞ্জুর করা হয়। কিন্তু শারিয়া কাউন্সিল নেই ইউরোপের এমন সব দেশে মহিলা আসলেই ভোগান্তির শিকার, কারণ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ সংঘটিত করার মত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
আদালতে ব্যয় বৃদ্ধি ও সময় ক্ষেপণের কারণে ব্রিটিশ মুসলিমরা বেশি করে শারিয়া কাউন্সিলের দ্বারস্থ হচ্ছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের সম্প্রদায়গুলোর একীভ‚তকরণ বিষয়ক ক্যাসি রিভিউতে বলা হয়, শারিয়া কাউন্সিলের প্রভাব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মহিলাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য মূলক আচরণের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
লন্ডনে জাতিগোষ্ঠিগত মহিলাদের প্রতিনিধিত্বকারী অলাভজনক সংস্থা সাউথল বø্য্রাক সিস্টার্স মনে করে যে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে সকল বিবাহের জন্য একটি আইন থাকা উচিত।
৪৪ বছর বয়স্কা ফরিদা ইস্ট লন্ডন শারিয়া কাউন্সিলের কাছে তার বিষয়টি জানান এ আশায় যে তারা নিকাহ বিবাহ অনুযায়ী তার প্রাপ্য অর্থ আদায়ে সাহায্য করবেন। তিনি বলেন, তাদের সাড়া ছিল হতাশাজনক। যেহেতু তার তালাক ইংরেজ পদ্ধতিতে হয়েছে, ইসলামী রীতি মোতাবেক নয় Ñ তাই তার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে তাকে পরামর্শ দেয়া হয়।
ফরিদার স্বামী, যিনি তার চাচাতো ভাই, বাংলাদেশ থেকে তার নতুন স্ত্রীকে এদেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ফরিদা শারীরিক ভাবে অসুস্থ ও মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে পড়েন। সাউথল বø্য্রাক সিস্টার্স-এর কাউন্সেলাররা তার মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এখনো তিনি তার ১২ বছর বয়সে পুতুল খেলার বয়সে তার বাবা-মার জোর করে তার চেয়ে ১৩ বছরের বড় এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেয়ার কথা মনে করে পরিতাপ করেন।
২০০৫ সালের ১৬ মার্চ স্বামী তালাক দেয়ার ১৩ বছরেরও বেশি সময় পর তিনি অতীতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, আমি যখন সার্টিফিকেটে ঐ তারিখটি দেখি , আমি মনে করি, ঐ দিনটিতে আমি মুক্তি পেয়েছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।