Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনা চিকিৎসায় অর্থাভাবে মরতে হলো মুক্তামনিকে দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত

| প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আক্তারুজ্জামান বাচ্চু, সাতক্ষীরা থেকে : বাঁচানো গেল না মুক্তামনিকে। সাদা কাপড় পরে দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলো ১২ বছর বয়সী শিশু মুক্তামনি। গতকাল বুধবার যোহর নামাজের পর জানাযা নামাজ শেষে তাকে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। জানাযা নামাজ পড়ান মুক্তার চাচা কলারোয়া উপজেলার বাটরা মোড়লপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ ক্বারী মো. মনিরুজ্জামান। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান বাবু, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর এম ও) ডা. মো. ফরহাদ জামিল, সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারি আশেক নওয়াজ, হাওয়ালখালি পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা নূরুজ্জামান, দক্ষিণ কামারবায়সা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল খালেক, মাওলানা মো. আদম শফিউল্লাহসহ সাংবাদিক, এলাকাবাসী ও মুক্তার নিকট আত্মীয়রা জানাযা নামাজে অংশগ্রহণ করেন।
বিরল চর্মরোগে আক্রান্ত শিশু মুক্তামণির চিকিৎসার দায়িত্ব প্রথমে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সাবেক সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম এবং পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেন। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পরও বিনা চিকিৎসায় অর্থাভাবে মরতে হলো মুক্তামনিকে। এ নিয়ে সাতক্ষীরাসহ দেশব্যাপি আলোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকের মতে, চিকিৎসার অবহেলায় মরতে হলো মুক্তামনিকে। কেনই বা চিকিৎসকরা তাকে প্রয়োজনে দেশে না হলে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দিলো না। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ১ মাসের ছুটিতে বাড়ি গেলেও কেনই বা তাকে আর ফিরিয়ে আনা হলো না চিকিৎসার জন্য। গত কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে তার পুরনো রোগ বেড়ে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশের পরও নেয়া হলো না কোন পদক্ষেপ। গতকাল তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সাতক্ষীরায় মানুষের মুখে মুখে ছিল এই একই প্রশ্ন। তাহলে কি চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া হয়েছিল শুধুমাত্র প্রশংসা কুরানোর জন্য।
মুক্তামনির চিকিৎসায় শেষ দিকে কোন অবহেলা ছিল কিনা জানতে চাইলে অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন মুক্তামনির চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ড. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, মুক্তামনির পরিবারকে বার বার ঢাকায় নিয়ে আসতে বলা হয়েছে কিন্তু তারা আসেননি। গ্রামে থাকলে ড্রেসিংসহ অন্যান্য চিকিৎসা স্বাভাবিকভাবে করা সম্ভব নয়। তবে কিছুদিন পর পর খোঁজ নেওয়া হয়েছে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, রক্ত নালীর টিউমারে আক্রান্ত মুক্তামনি গতকাল সকাল সোয়া ৮ টার দিকে সাতক্ষীরা সদরের বাঁশদহা ইউনিয়নের কামারবায়সা গ্রামের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। সে মো. ইব্রাহিম গাজীর মেয়ে।
দেড় বছর বয়স থেকে মুক্তামনি’র ডান হাত ফুলে যাওয়া ও ব্যথা যন্ত্রণা’র লক্ষণ দেখা দেয়। এরপর সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকায় চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোন উপকার না হয়ে দিনে দিনে মুক্তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ডান হাতটি আরো ফুলে গিয়েছিলো। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় মুক্তার অসুখের বিষয়টি উঠে আসলে অনেকেই মুক্তার চিকিৎসায় হাত বাড়ান। পরে মুক্তামনির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় মুক্তামনিকে। প্রথমে তার রোগটিকে বিরল রোগ হিসেবে উল্লেখ করেন চিকিৎসকরা। পরে বায়োপসি করে চিকিৎসক জানতে পারেন তার রক্তনালীতে টিউমার হয়েছে। তখন তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করেন বার্ন ইউনিটের ডাক্তাররা। ভিডিও কনফারেন্স’র মাধ্যমে মুক্তামনির সব রিপোর্ট দেখে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ঢামেক হাসপাতালেই তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। ৫ আগষ্ট প্রথম অ¯ো¿াপচার করা হয় মুক্তা মনির ডান হাতে। হাতের ফোলা অংশে অস্ত্রোপচার করে তা ফেলে দেওয়া হয়। পরে আরো দুই দফায় অস্ত্রোপচার করে মুক্তার দুই পায়ের চামড়া নিয়ে হাতে লাগানো হয়।
ঢামেকের বার্ন এন্ড প্লাষ্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের একটি দল মুক্তামনির স্কিন গ্রাফটিং (চামড়া লাগানো) অপারেশনে অংশ নেন। এর কিছুদিন পর আবারো মুক্তামনির হাত ফুলে যায়। তখন ফোলা কমানোর জন্য ডাক্তাররা তার হাতে প্রেসার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। ২২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে মুক্তাকে তার গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ওই সময় থেকেই মুক্তা বাড়িতে ছিলো। দিনে দিনে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। অপারেশন করে হাত থেকে যা কিছু অপসারণ করা হয়েছিল তা আবারো পুরণ হয়ে যায়। এবং তার ডান হাত দূর্গন্ধযুক্ত হয় ও নিয়মিত রক্ত ঝরতে শুরু করে। এমনকি হাত থেকে বড় বড় পোকাও বের হতে থাকে।
মুক্তা মনির পিতা মো. ইব্রাহিম গাজী ও মা আসমা খাতুন জানান, গত কয়েকদিন ধরে মুক্তামনি জ্বরে ভুগছিলো। মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। বুধবার সকালে মুক্তা পানি খেতে চায়। পানি পান করার পর পরই মুক্তা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ডাক্তার হতে চেয়েছিলো মুক্তামনি ঃ মাত্র দেড় বছর বয়সে মুক্তামনি’র ডান হাতে ফোলা ও যন্ত্রনা শুরু হলে তাকে পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরার কয়েকজন ডাক্তারকে দেখানো হয়। এরপর খুলনা ও রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা করান তার পিতা ইব্রাহিম গাজী। কিন্তু কোন উন্নতি না হওয়া এবং তার অসুখটি ডাক্তাররা নির্ণয় করতে না পারা, সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকদফা অপারেশন করে সুফল না পাওয়ায় ভারাক্রান্ত্র মনে বাড়িতে শুয়ে থেকে মুক্তামনি পরিবারের সদস্যদের বলতো, আল্লাহ যদি তাকে সুস্থ করেন, তাহলে সে পড়াশুনা করে একজন বড়ো ডাক্তার হবে। কেউ যেনো ভুল চিকিৎসা না পায়, সেজন্য সে সচেষ্ট থাকবে। মুক্তা আফসোস করে বলেছে তাকে প্রথম অবস্থাতেই ডাক্তাররা ভুল চিকিৎসা করেছে। কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো মুক্তামনি’র জময বোন হীরা মনি। হীরামনি এখন মুক্তামনি’র ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। এজন্য সে সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করোেছ।
কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলো মুক্তার মা ঃ জানাযা নামাজ শেষে যখন মুক্তাকে খাটিয়ায় করে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মুক্ত মুক্তা করে চিৎকার করে কাঁদছিলো মমতাময়ী মা আসমা খাতুন। বারংবার মূর্ছা যাচ্ছেন আবার চিৎকার করে কাঁদছেন। এ দৃশ্য চোখে দেখার মতো নয়। মুক্তা আমার কলিজার ধন। তুই ফিরে আয় মা। হে আল্লাহ তুমি আমার মুক্তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। ওকে জীবিত করে দাও। মমতাময়ী মায়ের এমন আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছিলো। সাথে কাঁদছিলো মুক্তার জময বোন হীরামনিও।



 

Show all comments
  • সেলিম উদ্দিন ২৪ মে, ২০১৮, ২:৫৯ এএম says : 1
    আমাদের জন্য এর চেয়ে আর লজ্জার কী থাকতে পারে ?
    Total Reply(0) Reply
  • ash ২৪ মে, ২০১৮, ৫:১২ এএম says : 0
    R HASINA BUBU , SHOB CHOR CHECHOR MONTRI SHOCHIB DER 75000 TAKA DICHE BAL BAL ER MOBAIL PH KINTE !!! WHAT A JOKEEEEEEEEEEEEEEEEE
    Total Reply(0) Reply
  • Karim ২৪ মে, ২০১৮, ১১:৪০ এএম says : 0
    ঘুমাও শান্তিতে চির শান্তিতে জান্নাতে
    Total Reply(0) Reply
  • সমির ২৪ মে, ২০১৮, ১১:৪১ এএম says : 0
    রমজান মাসে মৃত্যু অনেক সৌভাগ্যের মৃত্যু। তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার কাছে শান্তিতে পৌঁছে যাও।
    Total Reply(0) Reply
  • কবিতা ২৪ মে, ২০১৮, ১১:৪৩ এএম says : 0
    তোমার জন্য সরকার ও রাষ্ট্র এবং দেশের মানুষ অনেক চেষ্টা ও দোয়া করেছে কিন্তু তোমার আয়ু হয়তো এই পর্যন্তই ছিল।
    Total Reply(0) Reply
  • মিনহাজ ২৪ মে, ২০১৮, ১:৫০ পিএম says : 0
    রমজান মাসে মৃত্যু অনেক সৌভাগ্যের মৃত্যু
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কবর

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ