Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী বন্দীদের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বানাচ্ছে বোকো হারাম

প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : বোমাটি তোমার বগলে রাখ যাতে তা স্থির থাকে। তোমার শত্রু যাতে লড়ার সুযোগ না পায় সেজন্য পিছন থেকে তার মাথা কেটে ফেল। মহিলা ও তরুণীদের এভাবেই শিক্ষা দেয়া হয়।
নাইজেরিয়ার পিতামহী হওয়া এক মহিলা রাহিলা আমোসকে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারিণী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তিনি বলেন, তাকে সতর্কতার সাথে শেখানো হয় যে পিছন থেকে ঘাড় কাঁটা হলে তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটে।
পশ্চিম আফ্রিকাজুড়ে বোকো হারাম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের বিভীষিকা সৃষ্টিকারী কাজের মধ্যে রয়েছে মসজিদ, গির্জা ও স্কুলে হামলা, বেসামরিক লোকদের গণহত্যা, গ্রামগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল বন্দী মহিলা ও তরুণীদের হত্যাকারীতে পরিণত করার সক্ষমতা।
সন্ত্রাসী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী দি লং ওয়ার জার্নাল-এর মতে, বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর উগ্রপন্থী গ্রুপ বোকো হারাম ২০১৪ সালের জুন থেকে কমপক্ষে ১০৫ জন মহিলা ও তরুণীকে আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহার করেছে। ঐ সময় এক নারী নাইজেরিয়ার একটি সেনা ছাউনিতে বোমা হামলা চালায়।
তারপর থেকে মহিলা ও নারীরা ঝুড়ি বা তাদের পোশাকের আড়ালে বোমা লুকিয়ে নিয়ে মাছ ও সবজি বাজার, স্কুল, নদীবন্দর এমনকি সহিংসতা থেকে পালিয়ে এসে শিবিরে আশ্রয় নেয়া লোকদের উপরও হামলা চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করেছে।
ক্যামেরুনের যোগাযোগ মন্ত্রী ইসা চিরোমা বাকারি বলেন, এটাকে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে পরাজিত করতে বা নির্মূল করতে পারবেন না। ক্যামেরুনে এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন মহিলা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারিণী চিহ্নিত হয়েছে। তিনি বলেন, আপনি জানেন না কে কী। আপনি যখন দেখবেন যে কোনো তরুণী আপনার দিকে এগিয়ে আসছে আপনি কি করে জানবেন যে তার কাছে একটি বোমা রয়েছে কি না?
তিনি বলেন, সন্দেহভাজন মনে হলেই সৈন্যরা কোনো মহিলা বা তরুণীর উপর গুলি চালাতে পারে না। বোকো হারামের ঐ মহিলা বা তরুণী জানে কোথায় আমাদের দুর্বলতা।
বোকো হারাম কর্তৃক মহিলাদের অপব্যবহারের ঘটনা বিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে দু’বছর আগে যখন তারা নাইজেরিয়ায় একটি স্কুলে হামলা চালিয়ে ৩শ’ ছাত্রীকে অপহরণ করে। তাদের অনেকেরই এ পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি। এ ছাড়াও শত শত মহিলা ও তরুণীকে অপহরণ, কারারুদ্ধ, ধর্ষণ ও কোনো কোনো সময় ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী করা হয়েছে। সম্ভবত নতুন প্রজন্মের যোদ্ধা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়।
রাহিলা আমোস বলেন, বোকো হারামের যোদ্ধারা সকালে তাদের গ্রামে আসে। তারা গুলি ছঁড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে এবং নারী ও শিশুদের আটক করে।   
৪৭ বছর বয়স্কা রাহিলা আমোস একজন খ্রিস্টান। বন্দী হওয়ার পরপরই তাকে বোকো হারামের ইসলাম শিক্ষার ক্লাসে তাকে ভর্তি করা হয়। আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্য তৈরি করার এটি ছিল প্রথম ধাপ।
কয়েকমাস প্রশিক্ষণ চলে। তারপর এক সময় তিনি পালাতে সক্ষম হন। মাগরিবের নামাযের সময় সবাই চলে গেলে তিনি থেকে যান। তার দু’টি অল্পবয়সী ছেলে ও শিশু নাতিকে একসাথে জড়ো করেন যাতে ক্যামেরুন সীমান্তের দিকে পালিয়ে যেতে পারেন।
ক্যামেরুনের বিরাট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত অসংখ্য তাঁবুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শিবিরে আশ্রয় নেয়া রাহিলা বলেন, আমি কোনো বোমা নিতে চাইনি।
ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়ার কর্তৃপক্ষ বলেন, রাহিলার অভিজ্ঞতার বহু বিবরণ বোকো হারামের কাছ থেকে পালানো অথবা বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে আটক হওয়া অন্য মহিলা ও তরুণীদের বিবরণের সাথে মিলে যায়। এমনকি বোকো হারামের আটকাবস্থা থেকে ছাড়া পাওয়া মহিলা ও তরুণীরা যেসব বিরণ দিয়েছেন, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীকে অভিযানে পাঠানোর আগে তার জানাযা পাঠ করার বিবরণও রয়েছে, সেসবের সাথেও বিস্ময়করভাবে একই দেখা যায়।
এসব বিবরণ থেকে বোকো হারামের ভিতরের অনেক কথাও জানা যায় যে কীভাবে এ উগ্রপন্থ’ী সংগঠনটি তাদের নির্মূল করার আন্তর্জাতিক অভিযানের সামরিক চাপ সত্ত্বেও নাইজেরিয়া, শাদ, ক্যামেরুন ও নাইজারের বিস্তৃত এলাকার রণাঙ্গনে ভীতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
এক সময় দখল করা এলাকা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তা করতে অক্ষম বোকো হারাম নতুন তৈরি করা মহিলা ও তরুণী সন্ত্রাসীদের হামলা চালাতে পাঠাচ্ছে যারা ভয়াবহ মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
ক্যামেরুনের এক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র কর্নেল দিদিয়ার বাদজেক বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সৈন্যরা বোকো হারামকে তাদের দখল করা গ্রামগুলো থেকে বিতাড়িত করার পর মহিলা ও তরুণীদের কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে। তিনি বলেন, নারী বন্দীদের আটক থাকা অবস্থায় পবিত্র কুরআন ও সহিংসতা উভয়ই শিক্ষা দেয়া হত।
কর্নেল বাদজেক বলেন, তারা নিহতদের সংখ্যা সর্বোচ্চ পরিমাণ করার প্রশিক্ষণ দেয়।
বোকো হারাম প্রায়ই পুরুষ যোদ্ধাদেরকে মসজিদগুলোতে হামলা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু গত মাসে উত্তরপূর্ব নাইজেরিয়ায় একটি গ্রামের মসজিদে ফজরের নামাজের সময় পুরুষের ছদ্মবেশে একজন মহিলা প্রবেশ করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আরেকজন মহিলা বাইরে অপেক্ষা করছিল। প্রথম বোমা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া লোকদের উপর সে বোমা হামলা চালায়। এতে ২৪ জন নিহত হয়।
মহিলাদের বোমা হামলা এখন এমন ব্যাপক হয়ে উঠেছে যে মানবাধিকার গ্রুপগুলো পর্যন্ত খাদ্য, পানি বিতরণ ও অন্যান্য সাহায্য দেয়ার কথা পুনরায় বিবেচনা করছে। তাদের দুশ্চিন্তা যে মহিলাদের কারো কাছে যদি বোমা থাকে?
ক্যামেরুনে সাম্প্রতিক কালে বোমা হামলার অনেকগুলোই চালিয়েছে কিশোরী মেয়েরা। কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বিস্মিত এ বেবে যে তারা হয়ত বোমা সম্পর্কে সচেতনই নয়। নাইজেরিয়ায় সম্প্রতি বোমা হামলাকারীদের কয়েকজনকে দেখা গেছে তাদের চুল সামনের দিক থেকে পিছনে টেনে বাঁধা যা মৃত মেয়েদের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল।
তবে বোকো হারামের আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে দেখা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে ক্যামেরুনের প্রত্যন্ত উত্তর অঞ্চলে একটি গ্রামে আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্য প্রেরিত এক তরুণী তার বোমা ফেলে দেয় ও কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তার তথ্যের ভিত্তিতে বোকো হারামের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হয়।
একই মাসে উত্তরপূর্ব নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের ভয়ে পালিয়ে আসানাইজেরীয়দের একটি শিবিরে হামলা চালানোর জন্য বোমা সজ্জিত তিন তরুণীকে পাঠানো হয়। দু’জন বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৬০ জনকে হত্যা করে। কিন্তু তৃতীয় তরুণী ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের মধ্যে তার বাবা-মাকে দেখতে পায়। সে তার বোমাগুলো ঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে।
মানবাধিকার গ্রুপগুলোর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বোকো হারাম গত বছর ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। গ্রুপটি ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত নারী ও ছেলেমেয়েসহ ২০০০ জনকে অপহরণ করে। বালকদেরকেও তারা বোমা হামলা চালাতে ব্যবহার করছে।
বহু দিক দিয়েই নারী বোমাবাজরা হচ্ছে আদর্শ অস্ত্র। পুরুষ পরিচালিত নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে তাদের প্রায়ই তল্লাশি করা হয় না, করলেও অল্পস্বল্প। তাদের পোশাকের আধিক্য বা বোরকার আড়ালে বোমা লুকিয়ে রাখা সহজ।
কয়েক দশক ধরেই নারীরা উগ্রপন্থীদের ট্রেডমার্কে পরিণত হয়েছে। চেচনিয়ায় তাদের ছদ্মনাম ছিল ব্ল্যাক উইডো। শ্রীলংকায় তারা তামিল টাইগারদের লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। মিয়া ব্লুম তার ‘বম্বশেলঃ উইমেন অ্যান্ড টেরোরিজম’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ১৯৮৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আত্মঘাতী বোমা হামলার এক চতুর্থাংশই চালিয়েছে নারীরা।
বোকো হারামের সাথে লড়াইকারী এক সৈন্য বলে, তার বিশ্বাস যে বোকো হারাম মেয়েদের খাবারের সাথে মাদক মিশিয়ে দেয়।
রাহিলা আমোসের মতে, নারীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বোকো হারামের পরিকল্পিত কৌশল। কিছু নারী তা গ্রহণ করে। তিনি বলেন, তার সাথে ৩০ জনের মত বন্দী মহিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ৭ জন তরুণী আত্মঘাতী মিশনে যেতে রাজি হয়। তিনি বলেন, তাদের গ্রুপকে বলা হয়েছিল, এটা হচ্ছে বেহেশতে যাবার পথ।
তিনি এখন মিনাওয়াও উদ্বাস্তু শিবিরের ৫৮ হাজার অধিবাসীর একজন। খাদ্যাভাবের শিকার মেয়েদের এনে ভালো খাবার দিয়ে ও বেহেশত লাভের লোভ দেখিয়ে সম্ভাব্য আত্মঘাতী হামলাকারী হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বোকো হারাম যখন তাদের শহরে হামলা চালায় তখন তারা দু’ ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। তার স্বামী তাদের ৫ সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি বন্দী হন। তার সাথে তার ছোট দু’ ছেলে ও এক নাতিও বন্দী হয়। বোকো হারাম অন্য নারী ও শিশুদের সাথে তাকেও একটি দীর্ঘ গর্তের মধ্যে আটকে রাখে। সেখানে তারা তিনদিন ছিলেন। তাদের এক বেলা খাবার দেয়া হয়। অবশেষে এক যোদ্ধা এসে তাকে জিজ্ঞেস করেঃ তুমি খ্রিস্টান থাকবে না মুসলিম হতে চাও?
সব নারীই তাদের হত্যা করা হবে এ ভয়ে মুসলমান হতে রাজি হয়। শুরু হয় তাদের প্রশিক্ষণ।
তাদের প্রতিদিন ৬ দফা শিক্ষা দেয়া হত। প্রথম দু’দফায় কুরআন শিক্ষা, পরের তিন দফা ছিল আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো ও শিরñেদ করার প্রশিক্ষণ। তিনি বলেন, কী ভাবে হত্যা করতে ও কোনো বাড়ি বোম বিস্ফোরণে ধ্বংস করতে হয় তা আমাদের শেখানো হয়।
রাহিলার ভাগ্য ভালো ছিল। বোকো হারাম যোদ্ধারা তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু তার গ্রুপের ১৪ মহিলা ৪ তরুণীর ভাগ্য ভালো ছিল না।
আটক থাকার মাসগুলোতে দিনে তাদের এক বেলা খাবার জুটত। তার ওজন ভীষণ কমে যায়।
তিনি বলেন, কয়েকমাস আগে বোকো হারাম যোদ্ধারা মহিলাদের একসাথে জড়ো করে একটি কারখানাতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি অনেক মেয়েকে দেখতে পান যাদের ভালো খাবার দেয়া হয় ও তাদের পানির কোনো অভাব ছিল না। তাদের মধ্যে কয়েকটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলে যে তারা চিবোক থেকে এসেছে। বোকো হারাম সেখান থেকেই স্কুলের মেয়েদের অপহরণ করেছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা অপহৃত স্কুল বালিকাদের ব্যাপারে তার বক্তব্য তদন্ত করে দেখবে। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারী বন্দীদের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বানাচ্ছে বোকো হারাম
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ