পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মাহে রমজানে অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যথেষ্ট লুটপাটের তোড়জোড় : কোনো
খুচরা মূল্য লেখা থাকে না!
শফিউল আলম : ঠিক ১২ কেজি ওজন নিশ্চিত হয়েই দোকান থেকে এলপি গ্যাসের একটি সিলিন্ডার কিনেন চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব বাকলিয়ার মোঃ সিরাজউদ্দিন। সিলিন্ডারের মুখ ছিল সিল করা। কিন্তু কিছুদিন বাসার চুলা জ্বালানোর এক পর্যায়ে দেখা যায় সিলিন্ডার দিয়ে আর কোনো গ্যাস বের হচ্ছে না। তার মনে সন্দেহ হয়। স্থানীয় যে দোকান থেকে এলপিজি কিনেন সেখানে গিয়ে ওজন দিয়েই দেখা গেলো সিলিন্ডারে তখনও প্রায় সাড়ে ৪ কেজি ‘গ্যাস’ আছে। তাহলে চুলা জ্বলছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে দোকানি তাকে জানান, এই সাড়ে ৪ কেজি অবশিষ্ট তরল পদার্থ গ্যাস নয়। সবটুকুই পানি। এমনটি মাঝেমধ্যে ঘটছে। কেন ঘটছে তা জানিনা। আমরা তো খুচরা বিক্রেতা। আপনার ভাগ্য হয়তো খারাপ।
একইভাবে বায়েজিদ অক্সিজেন এলাকার মহিউদ্দিন, হাটহাজারীর নুরুল ইসলাম, পটিয়ার আলী আহমদ, মীরসরাইয়ের লিটন দে ও ফটিকছড়ির আবদুল গনি এলপিজি কিনতে গিয়ে গ্যাসের সাথে পানি থাকার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান। ১২ কেজির সিলিন্ডারে গ্যাস বাদে বাদবাকি দুই-আড়াই কেজি থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত এবং ৩৩, ৩৫ ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডারে ৭/৮ এমনকি ১১ কেজি পানি ওজন দিয়ে পাওয়া গেছে। এ ধরনের অভিযোগ হরহামেশাই আসছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সেই পানির অনুপাতে গ্যাসের মূল্য ফেরত বা ক্ষতিপূরণ ক্রেতাদের কাছে কখনোই দেননা।
অন্যদিকে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ সিলিন্ডারে গ্যাসের সাথে মিলছে পানি। এরফলে গ্রাহকরা সরাসরি প্রতারিত হচ্ছেন। কেননা গ্যাসের দামেই কিনতে হচ্ছে পানি। সিলিন্ডারে গ্যাসের সাথে পানি ভর্তি থাকায় নির্ধারিত ১২, ৩৩, ৩৫ বা ৪৫ কেজি ওজন থাকে ঠিকই। এলপি গ্যাস বাজারজাতকারী কোম্পানির সিলযুক্ত থাকে সিলিন্ডারের মুখ। গ্রাহকরা সরল বিশ্বাসে কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সিলিন্ডারের গ্যাসে যেখানে এক দেড় মাস চলার কথা তা নিঃশেষ হয়ে যায় ১০, ১৫ থেকে ২০ দিনেই। একটি সিলিন্ডারে ১২ কেজি গ্যাসের ভেতর গড়ে ৪ থেকে ৫ কেজি পানি ভর্তি থাকলে একেকজন ক্রেতা বা গ্রাহকের ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা যাচ্ছে পানিতে। ৩৩ কেজি, ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজি গ্যাসের সিলিন্ডারে সেই সমানুপাতে পানি দেয়া হলে এক-দেড় হাজার টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। গ্যাস কোম্পানিসমূহের সরাসরি লাইনের সংযোগ যারা পাননি, সারাদেশের এমন লাখ লাখ গ্রাহক এলপি গ্যাস ব্যবহার করেন। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ শহর-নগর-গঞ্জের অনেক বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা, হোটেল-রেস্তোঁরা, ফাস্টফুড শপে রান্না হয় এলপি গ্যাসে। এ প্রেক্ষাপটে এলপি গ্যাসের ভেতরে পানি দিয়ে সিলিন্ডার ভর্তি ও বিক্রির ফলে ক্রেতাদের কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে পানিতে।
এ বিষয়ে আলাপকালে কয়েকজন এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রেতা ও এজেন্ট জানান, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তবে ক্রেতা পানি ভর্তি সিলিন্ডার ফেরত দিতে আসেন, তখন আমাদের কিছুই করার থাকেনা। এ নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সিলিন্ডারে পানি ভর্তির দায়-দায়িত্ব কেউই নিতে চাইছে না। এলপিজি বাজারজাতকারী কোম্পানির কয়েকজন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, গ্যাস ভর্তি করার সময় সিলিন্ডার পানি কিংবা বায়ুমুক্ত করা হয়। গ্যাসের সাথে সিলিন্ডারে পানি ভরে বিক্রি করতে গেলে গ্রাহকই সেই গ্যাস আর কিনবেন না। কাজেই কেন কোম্পানি ব্যবসা হারানোর ঝুঁকি নেবে? তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এলপি গ্যাস বিভিন্ন স্টেশনে রি-ফিলিং বা বোটলিং করার সময়ই অসাধু এজেন্ট ও ডিলারের লোকজনের যোগসাজশে পানিসহ ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে বিক্রির জন্য চলে যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। চট্টগ্রামের সীতাকুÐ, মিরসরাই, নাজিরহাট, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বেশকিছু এলপিজি রি-ফিলিং স্টেশনে চলে এই কারসাজি। এদের এহেন পুকুর চুরি ধরতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ঝটিকা অভিযানের তাগিদ দিয়েছেন সাধারণ ভোক্তাগণ।
এলপিজি ক্রেতা আনোয়ারুল হাসান জানান, গ্যাস ফুরিয়ে গেলে আমরা রি-ফিল করার জন্য সিলিন্ডার নিয়ে আসি। গ্যাস ভর্তি করে সমান ওজনের একই কোম্পানির আরেকটি সিলিন্ডার নিয়ে বাড়ি যাই। কিন্তু সিলিন্ডারে কী পরিমাণে গ্যাস দেয়া হলো বা পানি আছে কিনা তা বুঝার কোন উপায় নেই। সিলিন্ডারের গায়ে শুধু লেখা থাকে কত কেজি। চুলা কম জ্বালালেও দেখি গ্যাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কোম্পানিগুলোর পরিমাণ মতো গ্যাস ভর্তির নিশ্চয়তা চাই।
মূল্যেও ঠকছেন ভোক্তা
অনুসন্ধানে জানা যায়, এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি গ্যাস) খাতে অবাধেই চলছে ব্যাপক ঠগবাজি। সিলিন্ডারে গ্যাসের ভেতরে পানি ভর্তিসহ বিভিন্ন উপায়ে কারসাজি করে ওজনে কম দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে অযৌক্তিক চড়া দামেও যথেচ্ছ কাটা হচ্ছে ক্রেতাদের পকেট। এর নেপথ্যে সক্রিয় সংঘবদ্ধ একটি চক্র। মাহে রমজানের আর বাকি মাত্র ১১ দিন। রোজার মাসজুড়ে এবং ঈদ পর্যন্ত হরিলুটের তোড়জোড় করছে অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কেননা মাহে রমজান ও ঈদের সময় এলপি গ্যাসের চাহিদা থাকে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি। গ্যাস সিলিন্ডারের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) লেখা থাকেনা। সেই সুবাদে ক্রেতাদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছে অসৎ সিন্ডিকেট। মাহে রমজান, পবিত্র ঈদ বা বিভিন্ন উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদা যখন বেড়ে যায় তখন সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা ২৫, ৩০, ৪০, ৫০ ভাগ বেশি ইচ্ছেমতো এমনকি দ্বিগুণ মূল্য হাঁকা হয়। অসৎ এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে পুরোদমে জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্রেতারা।
জানা গেছে, দেশে ১৫ বছর আগে শুধুই সরকারি তথা বিপিসির এলপিজি প্ল্যান্ট থেকে সিলিন্ডারজাত গ্যাস বাজারজাত করা হতো। বর্তমানে এলপি গ্যাস বোটলিং ও বাজারজাত করছে এক ডজনেরও বেশি বেসরকারি কোম্পানি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) এলপিজির জোগান কম থাকায় বাজার প্রধানত বেসরকারি গ্যাস কোম্পানিগুলোর দখলে। এরমধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকো, ওমেরা, বিএম, টোটাল, সেনা, লায়াস, এলপি, সুপার, বিএইচবি, চিটাগাং গ্যাস, জিগ্যাস, টিকে। গৃহস্থালী তথা বাসাবাড়ির চুলার জন্য বেশিরভাগই চাহিদা ১২ কেজি এলপিজির। প্রতিটির রি-ফিলিং মূল্য ৮শ’ টাকা থেকে ৯৫০ কিংবা ১০২০ টাকা। এছাড়া ৩৩, ৩৫ ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডারের রি-ফিলিং মূল্য ১৫শ’ ৫০ টাকা থেকে ২৬শ’ ৫০ টাকা। সিলিন্ডারের গায়ে পরিমাণ লেখা থাকলেও খুচরা বিক্রয় মূল্য (এমআরপি) লেখা থাকেনা।
এ কারণে এলপি গ্যাস বিক্রির সময় উক্ত মূল্যের কোন তোয়াক্কা করেন না ব্যবসায়ীরা। সুযোগ বুঝে উচ্চমূল্য হাতিয়ে নেয়া হয় যথেচ্ছ হারে। ১২ কেজির ৮শ’ থেকে ৯৫০ টাকার এলপিজির দাম নেয়া হয় দেড় হাজার থেকে ১৭শ’ টাকা। আরো বেশি পারিমাণের সিলিন্ডার ভর্তি গ্যাসের দাম হাঁকা হয় দুই হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায়। মাহে রমজান এলেই এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। কেননা চাহিদা থাকে অনেক বেশি। রোজাদারের চাহিদাকে পুঁজি করে মুনাফা লুটতে দোকানে দোকানে কিছু সিলিন্ডার রেখে বেশিরভাগ বাইরে অন্য কোথাও মজুদ করে এলপিজির কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্য উসুল করে নেয়া হয়।
এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞমহল সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের সঙ্কট নিরসনে গত ২৪ এপ্রিল সর্বপ্রথম ‘এক্সিলেন্স’ জাহাজযোগে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার (৬০ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন) এলএনজি (ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করা হয়েছে । চলতি মে মাসের মধ্যে তা গ্যাসে রূপান্তর করে মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনাল থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে আমদানিসহ আনুষঙ্গিক উচ্চমূল্যের কারণে সেই গ্যাসের মূল্য বেশিই পড়বে। যা গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সমন্বয় করবে সরকার। ফলে এলপি গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। তাছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অনুসরণে গ্যাসের অপচয়, চুরিরোধে সরাসরি গ্যাস লাইনের সরবরাহ আর আগামীতে থাকছে না। সেই স্থান দখল করবে এলপিজি। এতে করে এলপি গ্যাসের ব্যবহার এবং মূল্য বৃদ্ধি পাবে। বাড়তি দাম গুণতে হবে ভোক্তা-ক্রেতাদেরই। এই পরিপ্রেক্ষিতে এখনই যদি এলপিজি খাতে অসৎ সিন্ডিকেটের হরেক কারসাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি, ফাঁকি কঠোর হাতে রোধ করা না হয় তাহলে ভোক্তাসাধারণের আরও আর্থিক ক্ষতি ও স্বার্থহানি ঘটবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।