Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পা হারোনো রোজিনাও আর নেই : দীর্ঘ হচ্ছে মৃতের তালিকা

| প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন : নির্মম ও নিষ্টুরভাবে গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে প্রান হারানোর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। রাজধানীতে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় বেপরোয়া গাড়ির চাকার নিচে চাপা পড়ে পা হারানো রোজিনা আক্তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা গেছেন। নিয়ম না মেনে গাড়ি চালিয়ে একের পর এক হাত-পা ছিঁড়ে ফেলছে চালকরা। সম্প্রতি সময়ে পরপর চারটি ঘটনায় নগরবাসীকে আতংকিত করে তুলেছে। এসব ঘটনায় কঠোর বিচার না হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা করছেনা চালকরা। এদের কাছে অনেকটাই অসহায় প্রশাসন। এখন পরিবারের কোন সদস্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর ফিরে না আসা পর্যন্ত চিন্তায় থাকতে হচ্ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের। গত শনিবার যাত্রবাড়ী ফ্লাইওভারে রাসেলের পা হারানোর ঘটনায় বাস মালিক পক্ষের কেউ যোগাযোগ করেনি তার পরিবারের সাথে। এছাড়া গোপালগঞ্জের খালিদ হাসান হৃদয়। বগুড়ার শেরপুরে ছোট্ট শিশু সুমি। এসব ঘটনায় জড়িতরাও অধরা। হৃদয়, সুমি আর রাসেল এখন বাঁচার লড়াইয়ে। 

প্রত্যক্ষদর্শী নুর হোসেন সোহাগ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, চোখের পলকেই ছেলেটার (রাসেল) পা ছিঁড়ে গেল। বাসচালক একটা অমানুষ। ও যদি মানুষ হতো, তবে বাস থামিয়ে কথা বলতো; ওর গায়ের ওপর তুলে দিত না। ছেলেটা বারবার বাসচালককে অনুরোধ করে বলছিল, বাস থেকে নামেন, ঝামেলা সমাধান করেন। কিন্তু বাসচালক ছেলেটা কোনও কথা না শুনেই চাপা দিয়ে চলে যায়। গত শনিবার বেলা ৩টার দিকে রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ধোলাইপাড় ঢালে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-২৭৮৬) চাকায় পিষ্ট হয়ে রাসেল (২৫) নামের এক প্রাইভেটকার চালকের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অ্যাপোলো হাসপাতালে শনিবার রাতে গুরুতর আহত রাসেলের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন তার সঙ্গে থাকা এপিআর এনার্জি কোম্পানির সিকিউরিটি বিভাগের ক্লোজ প্রোটেকশন অফিসার আরিফ হোসেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত গ্রিন লাইন পরিবহনের মালিক আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। পুলিশ গতকাল গ্রিনলাইন বাসের চালক কবির মিয়াকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে রোজিনার চাচা সুরুজ মিয়া হাসপাতালে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, রোজিনা অভাব অনটনে বড় হলেও তার ছিল অসাধারণ গুণাবলী। সে অন্যের বাসায় কাজ করে নিজের পাশাপাশি পরিবারও চালাত। যে বাসায় সে কাজ করত সেখানে সবাই তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখত। কখনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি ওই পরিবার। সবাই প্রসংশা করত। কিন্তু এত ভালো মেয়ে এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে তা কেউ ভাবতে পারিনি। তিনি বলেন, অপরাধীর কোনো শাস্তি হবে না। দেইখেন সে বাহিরে ঘোরাঘুরি করবে। দেইখেন এমন ঘটনা শুধু ঘটতেই থাকবে। রোজিনার বাবা রসুল মিয়া বলেন, শুনছি মেয়েকে সরকারি একটা গাড়ি মাইরা দিছে। কিন্তু কই সরকার তো আমাদের পাশে দাঁড়াইল না। যে চালক এ কাজ করছে সেও নাকি জামিন পাইয়্যা বাহিরে ঘুইরা বেড়াইতাছে। আমি এর বিচার চাই। যেন আর কোনো বাবাকে সস্তান হারাইতে না হয়। উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল আত্মীয়ের বাসায় থেকে ফেরার পথে রাত ৮টার দিকে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে বিআরটিসির বাস (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৫৭৩৩) ধাক্কা দেয় রোজিনাকে। এতে রোজিনা রাস্তায় পড়ে গেলে বাসটি তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, তার বøাড ইনফেকশনটার কারণেই মূলত মৃত্যুটা হয়েছে। এ ধরনের ইনফেকশন ক্রাশের ঘটনায় হয়ে থাকে। তার শরীরের অন্যান্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ইনফেকশনটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সর্বোচ্চ বিচার হওয়া উচিত। প্রতিদিন ঘটছে এমন ঘটনা। রাজিব, রোজিনা, হৃদয় কিংবা রাসেল সবাই এমন নির্মমতার শিকার। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে অথচ অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। এজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রোজিনার লাশ গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢামেক থেকে নিজ বাড়ি ময়মনসিংহের দোবাউড়া থানার ঘোষগাঁও এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিকেলে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। রোজিনা গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ওই ঘটনায় গাজী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন।
রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, তিনি একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা। সম্প্রতি সময়ে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা বাসায় না ফেরা পর্যন্ত আতংকে থাকে। তারা দিনে কয়েকবার ফোন করে জানতে চান কোথায় আছেন কি করছেন। তিনি বলেন, আগে ফোন করে পরিবারের সদস্যরা খবরাখবর নিলেও তাদের মধ্যে কোন আতংক ছিল না। এখন আমার পরিবারের মতো অনেক পরিবারই তাদের আপনজনদের জন্য চিন্তায় থাকেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী জাকির হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সব কিছু আল্লাহর নির্দেশেই হয়। তবুও বেশ কিছুদিন যাবত পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গেছে। রাজধানীতে বাস চালকরা এখন আইন মানছে না। তাদের বিবেকও কাজ করছে না। মনে হয় নেশার ঘুরেই বাস চালাচ্ছে তারা। প্রতিদিন কেউ না কেউ প্রান হারাচ্ছেন, কারো বা হাত-পা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে গাড়ির চাকার নীচে পড়ে। এছাড়া যানবাহনে যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটছে। এসব কারনেই সন্তানরা বাইরে গেলে আমি নিজে যেমন চিন্তায় থাকি, তেমনি আমাকে নিয়েও পরিবারের সদস্যরা চিন্তায় থাকেন কখন কি ঘটে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক দুর্ঘটনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ