Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাল নেই, রানা প্লাজা ধসে সাটু‌রিয়ার নিহত ৪ শ্রমিকের পরিবার

সাটু‌রিয়া (মা‌নিকগঞ্জ) সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:২৬ এএম

কবিতা হেসকার কালে বাড়ী আইছিল পহলো বৈশাখে, মনয় ১৪ ই এপ্রিল। মাইয়াডা বাজার তন তরমুজ কিনা আইছিল। নিজের আতে কাইটা বাড়ীর হগলরে খাইয়াল। যাইবার সময় বলছিল মা আবার বাড়ী আহনের সময় তোমাগ লিগা গরুর মাংস আনুম। হেই যে গেল কবিতা গরুর মাংস আনব কইয়া, কবিতা বাড়ী আইল ঠিকই লাস হইয়া। এ কথা বলতেই আর কথা বলতে পারছিল না রানা প্লাজা ধসে নিহত কবিতার মা রাজেদা বেগম।
২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় ধ্বসে পড়ে শত শত গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়, আহত হয় কয়েক হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে মানিকগঞ্জের সাটু‌রিয়া উপ‌জেলার ৪ জন শ্রমিক নিহত হয়। এদের একজন কবিতা বেগম। তার বাবার বাড়ী মা‌নিকগ‌ঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদে।
ক‌বিতার মা রাজেদা বেগম ব‌লেন, কবিতারে বিয়া দিছিলাম, কিন্তু স্বামীর ভাত খাইলনা। পরে নিজের পায়ে দারনের লিগা কাম নেয় রানা প্লাজায়। কিন্তু নিজের পায়ে দারনের আগেই মাইয়াডা মারা গেলে।
একই গ্রামের সোহেল, বড় ভাইয়ের সাথে কাজ করতো রানা প্লাজায়। সোহেল বলেন প্রতিদিনের মত ২৪ এপ্রিল কাজ করতে রানা প্লাজায় যাই। তিনি ৮ তালায় কাজ করছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে বিকট শব্দ হয়। এরপর জ্ঞান ফেরার পর ধুলা ও অন্ধকার কিছুই দেখছি না। শুধু মনে হল আমার মাথার উপর আধা হাত জায়গা আছে। হামাগুড়ি দিয়ে একটু আলো দেখতে পাই। আলো ধরে এগুতে থাকি পরে উপর থেকে লাফ দেই। পরে দেখি ৮ তলা থেকে লাফ দিয়েছি। ব্যথা পেলেও বেঁচে যাই আমি। কিন্তু আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীর কে আর খুঁজে পাই নাই।
রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক সাটু‌রিয়ার জাহাঙ্গীর বাবা আরান সিকদার জানায়, আমার ২ ছেলে রানা প্লাজায় আক্রান্ত হয়। ছোট ছেলে সোহেল কে পেলেও বড় ছেলে জাহাঙ্গীর কে খোজে পাইনি। সবার লাশ পেলেও বড় ছেলে জাহাঙ্গীর কে আর খোজে পাই নি। পরে মরদেহের সাথে আমাদের ডিএনএ টেস্ট করার পর নিশ্চিত হই আমার বড় ছেলে মারা গেছে। আমার বাবার কবর টা বাড়ীতে থাকলে তা দে‌খে নয়নটা জুড়াইতে পারতাম।
আরান সিকদার আরো বলেন, আমাদের ৩ বার নোটিশ দিল সেখানে লেখা ১৫ লক্ষ ৬১ হাজার ২ শত ৩৭ টাকা সাহায্য পাব। কিন্তু কয়েক দাপে টাকা পেলাম সব মিলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। আর টাকা গেল কোথায়। নোটিশ মুতাবেক টাকা দিলে কিছুটা ভাল করে চলতে পারব।
সাটু‌রিয়া উপ‌জেলার বরাইদ গ্রামের আরেক নিহত শ্রমিক শিপরা রাজবংশী শীলা (২০)।
তার শ্বশুর কালাচান রাজবংশী জানায়, আমার ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র রাজবংশীর সাথে বিয়ের ৩ মাসের মাথায় সংসারের সচ্ছলতা আনার জন্য সাভারে চলে যায় ‌শিপরা। শিপরা রানা প্লাজায় কাজ করত আর ছেলে মাছ বিক্রি করতো। কিন্ত কয়েক মাসের মাথায় শিপরা মারা যায় রানা প্লাজা ধ্বসে।
সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটী গ্রাম। এ গ্রামের টগবগে তরুণ ছিল দ্বীন ইসলাম। এইসএসসি পাশ করে পড়া শুনার পাশাপাশি কাজ নিয়েছিল রানা প্লাজায়। ২ সন্তানের জনক দ্বীন ইসলাম রানা প্লাজার ধ্বসের ১২ দিন পর তার মরদেহ খুঁজে পায় স্বজনরা।
নিহত শ্রমিক দ্বীন ইসলামের ভাই মনির হোসেন জানায়, আমি সামান্য ইলেকট্রি‌শিয়া‌নের কাজ করি। আমার মৃত ভাইয়ের ২ সন্তান। আমার সামর্থ্য নাই তাদের সহযোগিতা করব। সরকার আমার ভাইয়ের এতিম সন্তানের মত অন্যান্য সন্তানদের পড়াশুনা খরচ বহন করত তাহলে ওরা মানুষ হতে পারতো।
দ্বীন ইসলামের বোন রুমা জানায়, রানা প্লাজায় যারা নিহত শ্রমিকদের স্ত্রী ও স্বামীরা অন্যত্র বিয়ে করে তাদের স্বামী এবং স্ত্রী পেয়েছে। আমার ভাবীও অন্যত্র বিয়ে করে নতুন সন্তান জন্ম দিয়েছে। আমরা ত আর ভাই পাই নি। প্রতি বছর এই দিনটা আসলে ভয়ে আঁতকে উঠি। আমার ভাই কত কষ্ট করে মারা গেছে।
সাভারের রানা প্লাজায় ধসে নিহত সাটু‌রিয়ার ৪ শ্রমিকের বাড়ীতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সাহায্য পেলেও তারা এখনও সচ্ছল হয়ে উঠতে পারেনি। সংসারের আলো জ্বালানোর জন্য এসব হতভাগা গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাড়ী ছেড়েছিল। অথচ আলো জ্বালানোর আগেই তাদের জীবনের প্রদীপ বন্ধ হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ শাখার অফিস সহকারী মো. দেলোয়ার হোসেন জানায়, রানা প্লাজা ধসে মানিকগঞ্জের সাটু‌রিয়া উপ‌জেলার ৪ জন শ্রমিক নিহত হয়। এর মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছে ২ এবং পুরুষ শ্রমিক ২ জন। তবে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকের কোন সংখ্যা মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যাল‌য় থে‌কে জানা যায় নি।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. নাজমুছ সাদাত সেলিম জানায়, নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশুনা অর্থের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কোন পরিবার যদি আমার নিকট এ ব্যাপারে আসে তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করা হ‌বে। আর ১৫ লক্ষ টাকার বিপরীতে ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আমার কোন তথ্য জানা নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ