দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য মুজিজা সমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুজিজা হল মিরাজ। পৃথিবীর কিছু দূরাচার, হতভাগ্য লোক কর্তৃক অসহনীয় নির্যাতনে দুঃখে কাতর ও প্রিয় স্বজনদের বিয়োগ বেদনায় শোকাহত প্রিয় হাবীবকে আল্লাহ তায়ালার আপন সান্নিধ্যে নিয়ে সমবেদনা জানিয়ে সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেই সংঘটিত হয়েছে এ ঐতিহাসিক মিরাজ। আল্লাহর অসীম কুদরাতের নিদর্শন এ মিরাজেই প্রিয়নবীকে (স.) উপহার দেয়া হয়েছে মানবতার নৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার সালাত। বান্দার সাথে আল্লাহর এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম সালাতকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করাই মিরাজের গুরুত্ত্বপূর্ণ দীক্ষা।
ইসরা ও মিরাজঃ বিশ্বনবীর (স.) পবিত্র মিরাজ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা হচ্ছে ইসরা বা নৈশ ভ্রমন। পরিভাষায়, মক্কার পবিত্র হারাম থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত রাতের এক শুভক্ষণে মহানবীকে (স.) যে সফর করানো হয়েছিল, তাকেই ইসরা বলা হয়। সফরটি জমিনে হয়েছে বিধায় এটি “রিহলাহ আরদিয়্যাহ” বা ভূপৃষ্ঠের সফর নামেও পরিচিত। আল্লাহ তায়ালা এ সফর সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে বলেনঃ “পবিত্র মহান সে সত্ত্বা, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীভাগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা” (সূরা বনি ইসরাঈল- ১)।
আর আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে মহানবীর (স.) উর্ধ্বগমনকে ইসলামী পরিভাষায় মিরাজ বলা হয়। মিরাজের শাব্দিক অর্থ- বাহন, উর্ধ্বগমন বা আরোহণ। ব্যাপকার্থে, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে আকাশে আরোহণ করিয়ে সপ্তাকাশ ভেদ করে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে তাঁর নিজের কাছে ডেকে নেয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাকে মিরাজ বলে। আল্লাহ তায়ালার কুদরাতের বহিঃপ্রকাশ বিশ্বনবীর (স.) এ সফর আসমানে হওয়ায় একে “রিহলা সামাবিয়্যাহ” বা আসমানী সফর ও বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “আর সেতো (মুহাম্মদ স.) তাকে (জিবরাইল আ.) আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট । যার কাছে জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত” (সূরা-আন নাজম, ১৩-১৫)।
মিরাজের ধরন ও সময়কালঃ ইমাম ত্বহাবী (রহ.) বলেন, মহানবীর (স.) স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হয় (আকীদাতুত ত্বহাবী)। এটিই বৃহত্তর মুসলিম জামাতের বিশুদ্ধ আকীদা। কোন তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল তা নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে। সিরাত গবেষকদের অনেকের মতে, মহানবীর (স.) মিরাজ হিজরতের এক বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাত্রে (২৬ তারিখ দিবাগত রাতে) সংঘটিত হয়েছে । তখন মহানবীর (স.) বয়স ছিল প্রায় ৫২ বছর। বিশ্বের মুসলিম জনসাধারনের মাঝে এ মতটিই বেশী প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত (রশিদ রেযা, আসসিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ)।
মিরাজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ নবুয়াতের দশম বছরে মহানবীর (স.) চাচা আবু তালিব মারা যান (ফতহুল বারী)। যিনি কাফির হওয়া সত্ত্বেও স্নেহস্পদ ভাতিজাকে সার্বক্ষণিক নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন এবং তাঁর দাওয়াতী মিশনে অব্যাহতভাবে সাহায্য-সহযোগীতা করতেন।
আবু তালিবের মৃত্যুর তিন দিন পরই মহানবীর (স.) প্রানপ্রিয় স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) ও ইন্তেকাল করেন (ফতহুল বারী)। যিনি শুধু রাসূলের জীবনসঙ্গীনীই ছিলেননা; বরং তাঁর দাওয়াতী মিশনের প্রধান সহযোগীও ছিলেন। তাঁর সমস্ত সহায় সম্পত্তি রাসূলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। উভয়ের মৃত্যুতেই মহানবী (স.) অত্যধিক কষ্ট পেয়েছিলেন (বোখারী ও মুসলিম)। তাদের মৃত্যুর পর কুরাইশদের ঔদ্ধত্য আরো বেড়ে যায়। স্বজন হারানো ব্যাথা, কুরাইশদের ধৃষ্টতা ও মুসলমানদের প্রতি অব্যাহত অত্যাচার নির্যাতনে মহানবীর (স.) জীবন হয়ে ওঠে বিষাদময় ও বিপর্যস্ত । নৈরশ্যের মাঝে কিছুটা আশায় বুক বেধে অগ্রসর হন তিনি তায়েফের পথে । মনে আশা, সেখানের জনসাধারণ হয়তো তাঁর প্রচারিত দ্বীনের দাওয়াত কবুল করবে, তাঁকে আশ্রয় দিবে এবং তাঁর স্বজাতীয়দের বিরোধিতার মুখে তাকে সাহায্য করবে। কিন্ত সেখানে কোনো সাহায্যকারী বা আশ্রয়দাতা তো পাওয়াই গেল না, বরং তারা মহানবীর (স.) সাথে সর্বাপেক্ষা মন্দ আচরণ করে।
তায়েফে দাওয়াতী মিশনের বিফলতা জনিত ব্যাথা, স্বজন হারানো বেদনা, কাফির মুশরিকদের অব্যাহত নির্যাতনে দুঃখে কাতর ও শোকাহত প্রিয় হাবীবকে সান্তনা দানের নিমিত্তে আল্লাহ তায়ালা উর্ধ্বালোকে আরোহন করিয়ে আপন সান্নিধ্যদানে ধন্য করে বন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার অপূর্ব নজির স্থাপন করেন।
মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহঃ সহিহ বোখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য সহীহ হাদীস গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত মিরাজের বিস্তারিত বর্ণনা থেকে সংক্ষিপ্ত ঘটনা প্রবাহ এই, মক্কার শিয়াবে আবু তালিবে অবস্থিত উম্মে হানীর ঘর থেকে হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবীকে (স.) কাবার আঙ্গীনায় নিয়ে এসে ছাক্কুস সাদর বা বক্ষ বিদীর্ণ করেন। সেখান থেকে স্বশরীরে বোরাকে আরোহণ করিয়ে তাঁকে বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ে আসেন।সেখানে বোরাককে মসজিদের আংটার সাথে বেঁধে সমাগত নবীগনের ইমাম হয়ে জামাতে সালাত আদায় করেন। অতঃপর হযরত জিবরাইল (আ.) তাঁকে নিয়ে সপ্তাকাশ পর্যন্ত ক্রমে ভ্রমণ করেন। নবী (স.) তখন প্রথম আকাশে হযরত আদম আ ,দ্বিতীয় আকাশে ঈসা ও ইয়াহইয়া, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ, চতুর্থ আকাশে ইদরীস, পঞ্চম আকাশে হারুন, ষষ্ঠ আকাশে মূসা , সপ্তম আকাশে ইবরাহীম আলাইহিমুস সালাম এর সাথে সাক্ষাত লাভ করেন। তিনি সিদরাতুল মুনতাহা দেখেন, সেখানে আল্লাহর নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি ও নানা রঙের প্রজাপতি ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। সেখানেই তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের পালকির ন্যায় ‘রফরফ’ ও বায়তুল মা’মুরও দেখেন। বায়তুল মা’মুরের কাছেই কাবার প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইবরাহিম (আ.) প্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। এই বায়তুল মা’মুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের বারবার প্রবেশ করার সুযোগ আসবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) স্বচক্ষে জান্নাত ও দোজখ দেখেন। সে সময় তাঁর উম্মতের জন্য প্রথমে ৫০ ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। এরপর তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আকাশে সেসব নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তাঁরাও তাঁর সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাসে নামেন। তাঁরা এখান থেকেই বিদায় নেন এবং রাসুল (স.) বোরাকে সওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কায় পৌঁছে যান।
মিরাজ ও আধুনিক বিজ্ঞানঃ মহানবীর (স.) উর্ধ্বগমণ বা মিরাজ নিয়ে পূর্ববর্তী দার্শনিকগন অনেক আপত্তি তুললেও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে তা সফলভাবে প্রমানিত। আলবার্ট আইনস্টানের সময়ের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, নিউটনের মাধ্যাকার্ষণ তত্ত্ব ও আধুনিক গতিবিজ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণে মিরাজের সত্যতা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। যদিও মিরাজ সহ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত অদৃশ্য বিষয়াবলীতে বিশ্বাস স্থাপনে বিজ্ঞান কোনো মানদন্ড নয়, বরং কুরআন প্রদত্ত দর্শণের বিপরীতে বিজ্ঞানীদের বহুতত্ত্বই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, মহানবীর (স.) উর্ধ্বালোকে আরহণে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ থেকে বেশী গতিসম্পন্ন বোরাক নামক বাহনের তত্ত্বকে পূঁজি করেই পৃথিবীর কোনো স্থুলদেহী মানবের পক্ষে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে গমন সম্ভব হয়েছে। (আল মিরাজ ওয়াল উলূমুল হাদীছাহ)
মিরাজের শিক্ষা ও তৎপর্যঃ মিরাজের কতিপয় শিক্ষা নিচে তুলে ধরা হল
মহান আল্লাহর অপার কুদরাতঃ জগতসমূহের একমাত্রস্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা অতি অল্পসময় একজন মানুষকে আসমানী জগত পরিভ্রমণ করিয়ে সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দেখিয়ে আবার জমিনে ফিরিয়ে আনলেন। আল্লাহ তায়ালার কুদরাতের নিদর্শন অতিবিস্ময়কর বিষয়টি নিয়ে মক্কার কাফিররা অনেক তর্ক-বিতর্ক করলেও চক্ষ্মুানদের কাছে একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালাই এ বিশ্বসংসারের একমাত্র নিয়ন্তা। তাঁর হুকুমে এ বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টিই ক্রিয়াশীল। সকল সৃষ্টির গতি-প্রকৃতির নিয়ন্ত্রকও একমাত্র তিনি। কাজেই কোনো কুদরাত প্রকাশে সৃষ্টির প্রচলিত নিয়ম কাননের মুখাপেক্ষী আল্লাহ তায়ালা নন। (মিরাজঃ দুরুস ওয়া ইবার)
মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক বাইতুল মোকাদ্দাসঃ বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের স্মৃতিবিজরিত এক পূতঃ পবিত্র স্থান। মহানবী (স.) এখানে নামায আদায় করেছেন, নামাজের ইমামতি করেছেন, আকাশে আরোহণ করেছেন, এখানে আগমনের সাওয়াব ঘোষনা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বায়তুল মোকাদ্দাসের মুক্তির সাথেই মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও প্রতিপত্তি নিহিত। (মিরাজঃ দুরুস ওয়া ইবার)
সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতঃ ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল সালাত, যার ফরজ হওয়ার ঘোষণা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। আর এ সালাত দুনিয়াতে ফরজ না করে আকাশে প্রিয় হাবীবকে ডেকে এনে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা যেন উম্মতের জন্য এক মহাপ্রতিদান। (মিরাজঃ দুরুস ওয়া ইবার)
মহানবী (স.) সর্বশেষ নবী ও রাসূলঃ বায়তুল মোকাদ্দাসে মহানবীর (স.) ইমামতির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি নবী রাসূলদের সরদার। তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাত সর্বজনীন। তিনিই সর্বশেষ নবী ও রাসূল।(মিরাজঃ দুরুস ওয়া ইবার)
সত্য প্রকাশে অটল ও নির্ভীকঃ বিশ্বনবী (স.) মিরাজ থেকে ফিরে এসে এ ঘটনার পূর্ণ বিবরন উম্মে হানীকে পেশ করলে তিনি বলেন, আপনি কুরাইশদের সামনে আপনার এ ঘটনা প্রকাশ করবেন না । তারা আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম আমি অবশ্যই তাদেরকে এ ঘটনা বলব (আল- বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। মহানবীর এ ঘটনা থেকে সত্য প্রকাশে সর্বদা নির্ভীকতার শিক্ষা গ্রহন করতে পারি।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, মিরাজ মহান আল্লাহ তায়ালার আসীম কুদরাতের বহিঃপ্রকাশ। ঠুনকো যুক্তির উর্ধ্বে উঠে মিরাজের উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন ও এর থেকে শিক্ষা গ্রহন করাই মুমিনের ঈমানের দাবী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।