Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিজেদের সাবমেরিন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করছে ভারত ও পাকিস্তান

বিধ্বংসী যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি

| প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভক্স : পাকিস্তান নৌবাহিনী ফ্রান্সের নির্মিত তাদের ৫টি ডিজেল চালিত সাবমেরিনের মধ্য ৩টিকে শিগগিরই পারমাণবিক অস্ত্রসহ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে আরো ৮টি ডিজেল-বিদ্যুত চালিত অ্যাটাক সাবমেরিন কেনার চুক্তি করেছে। সেগুলোকেও পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত করা যেতে পারে। এ সাবমেরিনগুলো ২০২৮ সালে সরবরাহ দেয়ার কথা রয়েছে। আরো উদ্বেগের বিষয় যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ বলছে যে তারা জুলফিকারের মত পানির উপরে ভাসমান যুদ্ধজাহাজে পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করছে।
নতুন প্রজন্মের পারমাণবিক সাবমেরিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিধ্বংসী যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে।
পাকিস্তান বলেছে, তার নৌবাহিনীতে পারমাণবিক অস্ত্র সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২০১৬ সালের আগস্টে ভারতের পারমাণবিক সাবমেরিন অরিহন্ত মোতায়েনের সরাসরি জবাব হিসেবে। ভারতের আরো অত্যাধুনিক দ্বিতীয় সাবমেরিন অরিঘাত নভেম্বরে সাগরে পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের নৌবহরে আরো ৪টি পারমাণবিক সাবমেরিন যুক্ত হবে। এটা ভারতকে পারমাণবিক ত্রিত¦তা দেবে যার অর্থ ভারত ভ‚মি থেকে, জঙ্গি বিমান থেকে ও সাগরে সাবমেরিন থেকে (জল- স্থল-অন্তরীক্ষ থেকে) পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম।
সাবমেরিন একটি গুরুত¦পূর্ণ বিষয়। শত্রুর ভয়াবহ প্রথম হামলার মুখে একে অত্যন্ত টেকসই বলে বিবেচনা করা হয় এবং তাই সাবমেরিন টিকে যাওয়ার কারণে পাল্টা আঘাত হানতে সক্ষম হবে। পারমাণবিক নিরোধ তত্তে¡ এই অশুভ ত্রিত¦তা যুদ্ধে জয়লাভকে অসম্ভব ও অর্থহীন করেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের বিষয় যখন আসে , বিপরীতক্রমে পারমাণবিক সাবমেরিনের নতুন প্রজন্ম দীর্ঘদিনের দু’ শত্রæর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে, হ্রাস নয়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দু’দেশ পরস্পরের প্রবল শত্রæতে পরিণত হয়। গত দু’দশক ধরে দেশ দু’টি ভ‚মিতে ভয়ংকর পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। এখন এ অস্ত্র- প্রতিযোগিতা অস্ত্র প্রতিযোগিতা ভারত মহাসাগরে নিয়ে পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনক করে তোলা হল। এর ফলে পারমাণবিক অস্ত্রের উপর চেইন অব কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার পাশাপাশি অস্ত্রের সংখ্যা বাড়বে ও এবং সেগুলোকে এমন স্থানে রাখা হবে যাতে ভুল কিছু হয়ে যেতে পারে।
ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ^বিদ্যালয়ের একজন পারমাণবিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাফর জশপাল বলেন, ভারত মহাসাগরের পারমাণবিকীকরণ শুরু হয়ে গেছে।
বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশে^র অত্যন্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ মহাসাগরে টহলরত সাবমেরিনগুলোতে শিগগিরই অধিক সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হবে এবং অন্যপক্ষ থেকে আকস্মিক হামলার শংকায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকা ভীতু ও সম্ভাব্য প্যারানয়েড অফিসারদের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হবে।
আধুনিক পারমাণবিক শক্তি চালিত, পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন এ যাবতকালের সর্বাধিক আতংক সৃষ্টিকারী অস্ত্র। মার্কিন নৌবাহিনীর ১৮টি ওহিও ক্লাস সাবমেরিনের প্রতিটি ১৫৪টি করে পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে। সেগুলো সাগর তলে মাসের পর মাস কাটাতে পারে। সনাক্ত অযোগ্য এসব সাবমেরিন শুধুমাত্র ক্রু ঘাটতি বা খাদ্য সরবরাহ উপলক্ষে যাত্রা বিরতি করে।
প্রসঙ্গক্রমে সাবমেরিনের শক্তির উৎসের কথা উল্লেখ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য , ফ্রান্স ও চীনের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আছে যা পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত। ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন আছে, কিন্তু সেগুলো ডিজেল-বিদ্যুত জেনারেটর চালিত। এ ধরনের সাবমেরিনগুলো পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিনের মত নিঃশব্দে চলে না। এগুলোতে শব্দ সৃষ্টি হয় ও সহজেই সনাক্তযোগ্য। একটানা এক সপ্তাহ, বড় জোর দু’ সপ্তাহের বেশি এগুলো পানির নিচে থাকতে সক্ষম নয়।
ভারত পারমাণবিক সাবমেরিন ক্লাবে যোগ দিতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে এবং বিপর্যয়ের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২৯০ কোটি ডলারের অরিহন্ত কমিশনিং-এর কয়েকমাস প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর একটি হ্যাচ খুলে গিয়েছিল ও প্রপালসন কম্পার্টমেন্ট সাগরের পানিতে ভরে গিয়েছিল। এ বিব্রতকর ঘটনার জন্য মানবিক ভুলকে দায়ী করে বিষয়টি চাপা দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনকি ভারতের সিনিয়র রাজনীতিকদেরও এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হয়। গত ফেব্রæয়ারি থেকে সাবমেরিনটির ব্যাপক মেরামত কাজ চলছে।
এদিকে ভারতের অপর পারমাণবিক শক্তি চালিত আকুলা ক্লাস সাবমেরিন আইএনএস চাকা প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে ঋণে রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়। এক অ-সনাক্তকৃত দুর্ঘটনায় এর সংবেদনশীল সোনার সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এটি এখন ড্রাইডকে রয়েছে। রাশিয়া এর মেরামত বাবদ ভারতের কাছে ২ কোটি ডলারের একটি বিল পাঠিয়েছে।
পাকিস্তান গত বছর ঘোষণা করে যে তারা সাবমেরিন থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে যা পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম। এটা ছিল সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে তারা তাদের সাবমেরিনগুলো পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত করতে চায়। তারা আরো ইঙ্গিত দিয়েছে যে পানির উপরে ভাসমান যুদ্ধজাহাজগুলোও তারা পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত করতে ইচ্ছুক।
সমস্যা হচ্ছে যে সাগরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন তাৎপযৃপূর্ণ ভাবে চেইন অব কমান্ড ও অস্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করবে যার অর্থ দু’দেশের মধ্যে দুর্ঘটনা ক্রমে গুলি বিনিময় অথবা পূর্ণ পারমাণবিক । যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবত রেখেছে। ভারতে চেইন অব কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণের চ‚ড়ান্ত কর্তৃত্ব বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃতে¦র হাতে।
তাত্তি¡ক ভাবে পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ বেসামরিক হাতে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল কমান্ড অথোরিটি নামক প্রতিষ্ঠান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের সর্বাপেক্ষা স্থিতিশীল ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকৃত সামরিক বাহিনী পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
সমভবে গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই তাদের অস্ত্র ও সরবরাহ ব্যবস্থা ‘অ-মিলিত’ (ডি-মেটেড) রেখেছে অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ মজুদ রেখেছে ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বহু দূরে যাতে করে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করার কথা। অথবা ভারতের বোমার ক্ষেত্রে, ট্রিগার বা ডেটোনেটর রাখা হয়েছে ফিসাইল কোর থেকে বিপুল দূরতে¦।
কিন্তু সাগরে, বিশেষ করে আপনি যখন তলদেশে যাবেন , এটা একেবারেই অসম্ভব। যুদ্ধাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র সেখানে সংযোজন ও মজুদ করা থাকে একই স্থানে এবং পৃথক সাবমেরিন ক্যাপ্টেনের রয়েছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা যে তারা তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে কি না।
পাকিস্তানের পরমাণু পদার্থবিদ ও প্রিন্সটন বিশ^বিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার পারভেজ হুডভয় বলেন, দু’দেশের জন্যই ুনতুন বিপদ হচ্ছে যে সাবমেরিনের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ খুবই ভঙ্গুর হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, স্থল ভিত্তিক অস্ত্রসমূহসহ যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে পৃথক। সাবমেরিনে আপনি এটা করতে পারবেন না। সাবমেরিন যখন বন্দর ত্যাগ করে তখনি তা সশস্ত্র হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, সামরিক পরিকল্পকদের কাছে দু’টি অপশন আছেঃ হয় আপনি ক্যাপ্টেনদের কাছে কোড দেবেন না অথবা তিনি বন্দর ত্যাগ করার আগেই তাকে তা দিয়ে দিন এবং তিনি তার নিজ বিবেচনায় একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারবেন।
সাগরের নিচে, সনাক্ত অসম্ভব অবস্থায় পারমাণবিক সাবমেরিনের বিশাল সুবিধা রয়েছে শত্রæদেশের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ও শত্রæদেশের উপর ভয়াবহ পাল্টা আঘাত হানার। তিনি এ প্রসঙ্গে সগরের তলদেশের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে রচিত ‘ক্রিমসন টাইড’ থ্রিলারের কথা উল্লে করেন। এতে একটি পারমাণবিক সাবমেরিন শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে কাহিনী বলা হয়েছে।
পাকিস্তান ও ভারত কাশ্মীর নিয়ে ১৯৯৯ সালে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। ১৯৬২ সালে কিউবা সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের ট্রিগার টানার পর্যায়ে পৌঁছেছিল,তার চেয়েও কাছাকাছি। কাশ্মীর সমস্যা দু’দেশের মধ্যে বিরোধের কারণ। ক্রিমসন টাইড-এর মত কোনো ঘটনা যদি ঘটে তাহলে একজন ভারতীয় সাবমেরিন কমান্ডার যিনি জানেন যে তার দেশ আক্রান্ত, তিনি যদি একটি অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট নির্দেশ লাভ করেন, তখন তিনি কি করবেন? (অসমাপ্ত)



 

Show all comments
  • আশিক ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১১ এএম says : 0
    উপমহাদেশের ১২ টা বেজে যাবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ