Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুটিতে বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছে আম চাষীরা

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : আমের ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুটি জানান দিচ্ছে এবার আমের ফলন ভালই হবে। শুধু আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চল নয় সারাদেশে এবার গাছে গাছে মুকুল এসেছে। তাও আবার একসাথে। মুকুল আসতে এবার একটু বিলম্বিত হলেও আবহওয়া অনুকুল থাকায় কাঁচা সোনা রংয়ের মুকুলে মুকুলে ছেয়ে যায় গাছগুলো। গাছ ভরা দৃষ্টিনন্দন মুকুল জানান দেয় ভাল ফলনের। এখন সেসব মুকুল থেকে মটর দানার মত গুটিগুলো উঁকি দিতে শুরু করেছে। ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুটি। যে সব মুকুলে গুটি আসেনি তা এখন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে। এসব গুটি এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রবাদ আছে আমের আনা মাছের পাই। তা থাকলে কে কত খায়। অর্থাৎ গাছে গাছে যত যত মুকুল আসে তার যদি ষোল আনার মধ্যে এক আনাও থাকে আর মাছ যে ডিম পাড়ে তার যদি পাই পয়সার সমান উৎপাদন হয় তাইই অনেক। গাছে গাছে মুকুলের পর এমন ঠাস বুনন গুটি দেখে বাম্পার ফলনের আশা করছেন চাষীরা। নেমে পড়েছেন বাগানের যতœ আত্তিত্বে। কৃষি বিভাগ আর আম চাষেিদর প্রত্যাশা নির্ভর করছে আবহাওয়ার মতিগতির উপর। এখন খরা আর ঝড় ঝাপটার দিকে নজর। চৈত্রে এসে আবহাওয়া একটু একটু করে তেঁতে উঠছে। আবার গুটিতে হপার পোকা নামক এক ধরনের পোকা বাগানে বাগানে হানা দিচ্ছে। আম চাষীরা তা দমনে কীটনাশক স্প্রে করছেন। আবহাওয়া গরম হয়ে উঠলে প্রয়োজনীয় সেচ দেবার প্রস্তুতিও রয়েছে। তবে ঝড় ঝাপটা আর শিলা বৃষ্টির উপর কারো হাত নেই। আল্লাহ একমাত্র ভরসা। ভাল ফলনের লক্ষ্য নিয়ে সারাদেশে বাগানে বাগানে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। কদিন আগে সরেজমিন দেশের আম উৎপাদনকারী ২২ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদাহ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগা, পঞ্চগড়, টাঙ্গাইল, জামালপুর, গোপালগঞ্জ, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন বিশিষ্ট কৃষিবিদ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন। দৈনিক ইনকিলাবের সাথে আলাপচারিতায় জানালেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার আমের উৎপাদন অনেক বেশী হবে। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে দেশে এক লাখ ৭৪ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হচ্ছে। আর উৎপাদন হবে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৩ মেঃ টন। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের সাথে কৃষি বিভাগের হিসাবের আকাশ পাতাল ফারাক । তাদের হিসাবে দেশে ৩৭ হাজার ৮০৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। যার উৎপাদন প্রায় ১১ দশমিক ৬১ লাখ মেঃটন। প্রতি বছর যখন উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় আম বাগানের বিস্তৃতি ঘটছে। সেখানে এমন পরিসংখ্যান বেমানান বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন গড়মিল হিসাব দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। সঠিক পরিসংখ্যান প্রতিফলিত হলে বিশ্বে বাংলাদেশের আম উৎপাদনের সূচকে উন্নতি ঘটবে। আমদানীকারক দেশ গুলোর দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। 

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবে ও এর বাইরে থাকা ছোট খাট উৎপাদনের হিসাবে দেশে ২২ লাখ টন আম উৎপাদন হলে যার গড় মূল্য ৪৫ টাকা কেজি হিসাবে ধরলে মূল্যমান দাড়ায় দশ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে শ্রমিকের মজুরী, প্যাকিং পরিবহন বিদেশে আম, জুস আবার রফতানি সব মিলিয়ে আরো দেড় হাজার কোটি টাকা যোগ হয় আম অর্থনীতিতে। দেশীয় বাজারে আমের গড় দাম ৪০-৪৫ টাকা প্রতি কেজি কিন্তু রপ্তানি উপযোগি আম ৮০-৮৫ টাকা কেজি দরে কেনাবেচা হয়। বর্তমানে আম রপ্তানির পরিমান ০.১ ভাগ যা আম উৎপাদনের তুলনায় খুবই নগন্য। উত্তম কৃষি পদ্ধতি ও ব্যাগিং প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে আম রপ্তানির পরিমান ১০ ভাগে উন্নয়ন করা সম্ভব। যা থেকে আসতে পারে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশী। আমকে ঘিরে এত বিশাল অংকের বাণিজ্য হলেও বিষয়টা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখন আম লাভজনক বলে জমির মালিক আম বাগান তৈরীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে বছর বছর আমের উৎপাদন বাড়ছে। আমের রাজধানী হিসাবে পরিচিত চাপাইনবাবগঞ্জে এখন আম উৎপাদন হয় ২৬ হাজার হেক্টরের বেশী জমিতে। যার উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। রাজশাহী নওগাতে বাগানের বিস্তৃতি বাড়ছে। রাজশাহীতে দশ বছর আগে যেখানে আম গাছ ছিল সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে ছয় লাখ গাছ। এখন সেখানে সাড়ে সতের হাজার হেক্টর জমিতে আম গাছ রয়েছে ৮৪ লাখের বেশি। তেমনি নওগাঁতে পাঁচ হাজার হেক্টরের জায়গায় প্রায় দ্বিগুন জমিতে হয়েছে আম বাগান। ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগার সাপাহার, পোরসা, বদলগাছি উপজেলায় জোতদাররা ধানের চেয়ে আমে লাভ বেশী বলে ধানের জমিকে বাগানে রুপান্তর করেছেন। একেকটি বাগান হচ্ছে আড়াইশো তিনশো বিঘার। এমনিভাবে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, সাতক্ষীরাতে আম বাগান বাড়ছে। রংপুরের মিঠা পুকুরও বদরনগর এলাকায় বেড়েছে হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান। রংপুরের প্রায় তিন হাজার হেক্টর আমের বাগানের মধ্যে এখন সিংহভাগ বাজার দখল করেছে হাড়িভাঙ্গা। এ আম স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দিনাজপুরের চার হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে আমের। শুধু সমতল ভূমিতে নয় চট্রগ্রামের তিন পাহাড়ী জেলায় আমের চাষাবাদ হচ্ছে ষোল হাজার হেক্টর জমিতে। এসব আমও অর্থনীতিতে ভাল ভূমিকা রাখছে। আমের আবাদ নিয়ে দেশজুড়ে হুলস্থুল কর্মকান্ড হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারনে হাজার হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সম্ভবনাময় খাতটি রয়েছে দিশাহীন। বিদেশে আম রফতানির যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে টানপোড়নের কারনে তা গতি হারাচ্ছে। দেশের ২২ জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। ফলনও কম নয়। তাছাড়া উৎপাদিত আমগুলো খুব সুস্বাদু এবং স্বাদ গন্ধের কারণে বিদেশীদের কাছে পছন্দের। বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সুনিশ্চিত পরিকল্পনা।
আমের মধ্যে ক্ষিরসাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলী, আস্বীনা, আ¤্রপালির চাহিদা ব্যাপক দেশে ও বিদেশে। বিশেষ করে বিদেশের বাজারে। এবার আম পাঠানোর প্রত্যাশা রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, পতুগার্ল, ফ্রান্স, রাশিয়াতে। যাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। প্রতিবছর আম রফতানীর মাত্রা বাড়ছে। গত বছর উদ্ভিদ সংগ নিরোগ কর্তৃপক্ষ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও চাষীদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির কারণে চাপাইনবাবগঞ্জের আম চাষীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জের থেকে বাছাই করা ২৯ মেঃটন মাত্র আম রফতানি করা হয়। যা এ অঞ্চলের মোট উৎপাদিত আমের এক শতাংশের কম। সাতক্ষীরা একত্রিশ মেঃ টন আম রফতানি করা হয়। আবার মেহেরপুরের রফতানীযোগ্য আমের সত্তর শতাংশ বাদ দেন বিভিন্ন অজুহাতে। এনিয়ে আম চাষীদের ক্ষোভের শেষ নেই। সরকারের উচ্চ পয্যায়ে রাজশাহীর এগ্রোফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহবায়ক আনোয়ারুল হক অভিযোগ দাখিল করেন। রফতানি করতে গিয়ে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে যারা আম চাষ করেছিলেন তাদের বেশী ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবার সময় মত রফতানি কারকরা চাষীদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ না করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত টিম যার সত্যতা খুজে পান। ভবিষ্যতের জন্য সর্তক করা হয়েছে। প্রতিবেদনে স্পর্শকাতর বৈদেশিক বাজারে আম রফতানীর ক্ষেত্রে ব্যাগিং পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার বালাইমুক্ত ও নিরাপদ আম উৎপাদন যথাযথ গুনগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। এবার শুরু থেকে সে ব্যাপারে সবাই সজাগ দৃষ্টি রাখছে। উদ্ভিদ সংগ নিরোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এবার তারা ২৮জন রফতানি কারকের মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলে থেকে ৩১২জন আমচাষীর নিকট থেকে আম নেয়া হবে। এজন্য মাঠ পয্যায়ে প্রশিক্ষন ও চুক্তি সম্পাদনের কাজ চলছে। শতভাগ শর্তমেনে যাতে আম রফতানি করা যায় সে ব্যাপারে তৎপরতা শুরু হয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান তারা বাঘার কিছু চাষীর সাথে চুক্তি করেছেন। এরপর তারা রফতানিকারকদের সঙ্গে কাজ করবেন। শুধু আম নয় বিদেশে জুস জ্যাম আমের আচারও যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার। বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসর এসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব রাজশাহী ম্যাংগো পোডাক্টের মালিক রাজু আহমেদ জানান আমরা ইউরোপ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে আমের জুস, জেলি রফতানি করছি। এরমধ্যে প্রাণ, একমি, আবুল খায়ের, ইগলু, প্রমি, বনফুল, এলিনা, রাজশাহী ম্যাংগো প্রোডক্ট উল্লেখযোগ্য। প্রান, এলিন, বনফুল, রাজশাহী ম্যাংগো প্রোডাক্ট আচার জেলি রফতানি করছে। বিশ্বে আমাদের আমের জুসসহ পন্যের ব্যাপক বাজার রয়েছে। রাজশাহী নাটোর ও গোদাগাড়ীতে প্রান দুটো ম্যাংগো প্রসেসিং কারখানা করেছে। বছরজুড়ে আমের স্বাদনেবার জন্য স্থানীয় ভাবে কাঁচা আমের আচার, পাকা আমের রসের আমতা, কাঁচা আম শুকিয়ে আমচুর করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড.মনজুর ও জাপানী কৃষিবিদ কেনজিসুজি আম নিয়ে গবেষনা করে পাকা আমের গুড়ো (ডাষ্ট ম্যাংগো) সংরক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এগুলোর স্বাদ ও গন্ধ ও পুষ্টিমান অটুট থাকবে। পুষ্টিবিদরা বলছেন আমে ভিটামিন এবিসি রয়েছে প্রচুর পরিমানে। এছাড়া এটি অক্সিডেন্ট ও মিনারেল রয়েছে প্রচুর। অন্য অনেক ফলের চেয়ে বেশী। মুড ভালো করার ফলের মধ্যে আম অন্যতম। স্বাদের পাশপাশি এর রংয়ের যেমন উজ্জীবীত করে তেমনি আমের মিষ্টি সুবাস মন ভাল রাখে। আম বাগান ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে স্থানীয়রা। বিশেষ করে বড় বড় আম বাগানের মালিকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে বাগানের মধ্যে বাইরে থেকে মানুষ এসে কিছুক্ষন বসতে পারে। লাখ লাখ গাছের কোটি কোটি আমের দুলনী তাদের স্বাগত জানাতে পারে। বাগানে বসে টাটকা কাচা পাকা আমের স্বাদ নেবার ব্যবস্থা করা যায়। অনেক নতুন বাগান মালিক এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন বলে জানান। ইতোমধ্যে তেমন দু’একটা প্রচেষ্টা নজর এড়ায়না। সব মিলিয়ে আম নিয়ে চলছে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা রকম ব্যাপার স্যাপার। এখন শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নজরদারী।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আম

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ