Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি

আরটি | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মধ্যপ্রাচ্যে যুুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ বলে যে শাসক পরিবর্তনের আগাম নীতির আওতায় ১৫ বছর আগে ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে সে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ইরাক থেকে কোনো শিক্ষা যুুক্তরাষ্ট নেয়নি।
পেন্টাগনের নব্য যুদ্ধবাজরা যে পরিকল্পনা নেয় তাতে ছিল তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা, তার জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ সরকার বসানো এবং তারপর সিরিয়া, ইরান এবং লিবিয়ায় শাসক পরিবর্তন করা।
সে সময় পেন্টাগন চালাচ্ছিলেন ইসরাইলপন্থী যুদ্ধবাজরা-যেমন তৎকালীন উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পল উলফউইজ এবং প্রতিরক্ষা দফতরের সহকারী মন্ত্রী ডুগ ফেইথ। তারা পেন্টাগনকে ইসরাইলের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের এক যন্ত্রে পরিণত করেন যে মধ্যপ্রাচ্যকে ইসরাইল তার অস্তিতে¦র জন্য হুমকি মনে করত। এমনকি উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার আগেও পল উলফউইজ সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
তিনি প্রথম দিকে সন্ত্রাসবাদের প্রতি ইরাকের সমর্থন ও পরে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) রাখার ভিত্তিতে ইরাকে আগ্রাসন চালাতে চেয়েছিলেন।
তখন সময়টি ছিল যুুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে। কুয়েত থেকে ইরাককে বিতাড়িত করতে ও তার মিত্ররা ইরাকের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, জাতিসংঘ তা তুলে নিতে যাচ্ছিল।
আমি তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অফিসে প্রযুক্তি নিরাপত্তা কার্যক্রমের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ডব্লিউএমডি পরিদর্শকরা এক দশকে ধরে ইরাকের ভিতরে ও বাইরে এক দশক ধরে নজরারি চালালেও সে সময় কয়েক বছর ধরে ইরাকি গবেষণা ও নির্মাণ কেন্দ্রগুলোর প্রযুক্তি মনিটরিংকারী আমার অফিস নিশ্চিত হয় যে ইরাকে কার্যকর ডব্লিউএমডি থাকার কোনো প্রমাণ নেই।
যাহোক, এটা তখন জর্জ টেনেটের নেতৃতে¦ পরিচালিত সিআইএকে থামাতে পারেনি। সিআইএ ২০০২ সালে অক্টোবরে জাতীয় গোয়েন্দা রিপোর্টে বলে যে ইরাকে ডব্লিউএমডি আছ্। তারপর ২০০২-এর ডিসেম্বরে জর্জ টেনেট প্রেসিডেন্ট বুশকে ব্রিফ করেন যে ইরাকে ডব্লিউএমডি থাকার জোর প্রমাণ রয়েছে।
ইরাকে ডব্লিউএমডির অস্তিত¦ প্রমাণে সিআইএর নিজস্ব সংকল্প কৌতূহল সৃষ্টিকর যেহেতু অনেক বছর ধরেই পেন্টাগনের গোয়েন্দা বিভাগ ইরাকি ডব্লিউএমডি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল যখন জাতিসংঘে যখন সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের প্রস্তাব পেশ করেন তখন টেনেট তার পিছনেই উপবিষ্ট ছিলেন।
টেনেটের বিশ্লেষকরা সে সময় অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের পশরা সাজান।
তবে তা সত্তেও যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ২০০৩ সালের মার্চে ইরাকে আগ্রাসন চালায়।
ইরাকে আগ্রাসন চালানোর তিন মাস আগে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অফিসে পেন্টাগন নীতিপ্রণতাদের সাথে ব্যাকচ্যানেল খোলার জন্য সিরীয়রা বৈরুতে আমার বন্ধু লেবানিজ -আমেরিকান ড. ইমাদ হেজের কাছে প্রস্তাব দেয়। সে সময় আমি সরাসরি ফেইথ ও উলফউইজের বিশেষ সহকারীর অধীনে কাজ করছিলাম।
মার্কিন আগ্রাসনের আগে হেইজ বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও স্থানীয় মিডিয়া পাশপাশি মার্কিন কর্মকর্তাদের জানান যে একটি যুদ্ধের পরিণতি হবে ভয়াবহ। সাধারণ ভাবে ইরাকি জনগণের উপর তার মারাত্নক প্রভাব পড়বে, আর নির্দিষ্ট ভাবে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে ইরাকের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর।
তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ মাসের মধ্যে হয়ত সাদ্দাম হোসেনকে পরাজিত করতে পারবে, কিন্তু কয়েক দশক ধরেও ইরাকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
তিনি ইরাকের সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিদ্যমান সহিংসতা ও প্রতিহিংসার প্রেক্ষিতে আমাকে বলেছিলেন, একটি যুদ্ধ ইরাককে রক্তাক্ত গ্রীক নাট্যমঞ্চে পরিণত করবে। তিনি আরো বলেছিলেন, ইরাক, যেখানে তখন কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল না, শেষপর্যন্ত জিহাদিদের স্বর্গভ‚মিতে পরিণত হবে।
হেজ এরপর সাদ্দামের কাছ থেকে আসা একটি বার্তা পাঠান। তিনি (সাদ্দাম) একটি চুক্তির কথা বলেছিলেন। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ না করলে ৬টি ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়। সিরিয়ানরা উদ্বিগ্ন ছিল যে এ ধরনের একটি আগ্রাসন ঘটলে তাদের দেশের উপরও তার প্রভাব পড়বে।
৬টি ছাড়ের মধ্যে দুটিকে ইরাকের সদিচ্ছা নির্ণয়ের পরীক্ষায় ব্যবহার করা যেত। একটি ছিল বাগদাদে বসবাসরত ইরাকি-আমেরিকান সন্ত্রাসী আবদুল রহমান ইয়াসিনকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া। ইয়সিন ১৯৯৩সালে বিশ^ বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলায় জড়িত ছিলেন। এখন পর্যন্ত ইয়াসিন মুক্ত রয়েছেন। তাকে আটকের জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
আরেকটি ছাড় ছিল যে ডব্লিউএমডি খুঁজে দেখার জন্য সাদ্দাম হোসেন ৫ হাজার মার্কিন সৈন্যকে ইরাকে ঢুকতে দেবেন। তা যদি হত তাহলে একটি গুলি না ছুঁড়েও যুক্তরাষ্ট্র ইরােেক পা রাখতে পারত।
সিরিয়ানরা মার্কিন সৈন্যদের ইরাকে প্রবেশের জন্য স্থান দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। তার বিনিময়ে অর্থনৈতিক অকাঠামো উন্নয়নে মার্কিন সাহায্যের জন্য দামেস্ক সরকার অনুরোধ করেছিল।
সাদ্দাম হোসেন ইরাকি তেলে মার্কিন সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানা এবং জাতিসংঘের তত্তাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি অন্য কোনো দেশে , খুব সম্ভবত সউদী আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। উলফউইজ বলেছিলেন, ইরাকি তেল বিক্রির টাকায় মার্কিন আগ্রাসনের ব্যয় মিটানো হবে। তবে তা কখনো হয়নি।
পেন্টাগনের নীতি প্রণেতারা সাদ্দামের সকল নিঃশর্ত চুক্তির প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন। কিন্তু কেন?
আসলে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, ইরাকে শাসক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এর আগে সাদ্দামের বিরুদ্ধে ইরাকিদের সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। সে কারণে সামরিক হামলা চালানো অনিবার্য ছিল।
ব্যাক চ্যানেল স›ন্ধান করা সিরিয়ানরা বলেছিল, তাদের কাছে থাকা তথ্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে চায়, তবে তা প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না। এ চ্যানেলের প্রাথমিক পরীক্ষা হিসেবে সিরিয়ানদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে মার্কিন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে ইরাকি ডব্লিউএমডি সিরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল কিনা।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের শীর্ষ উপদেষ্টাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ নাসিফ লেবানিজ-আমেরিকান মধ্যস্থতাকারীর কাছে তার জবাব পাঠিয়েছিলেন যা আমাকে জানানো হয়। তা ছিল এই যে সিরিয়া প্রকাশ্যে তাদের দেশে সেগুলোর উপস্থিতির কথা স্বীকার করবে না। যাহোক, ব্যাক চ্যানেল যদি তৈরি করা হত তাহলে আরো বহু বিষয়ে কথা বলা যেত।
বুশ প্রশাসন এ প্রস্তাবের প্রতি গুরুর¦ দেয়নি। পরিবর্তে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল ২০০৩ সালের মে মাসে সিরিয়া সফর করেন এবং প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ও তাকে হুঁশিযার করে দেন। কলিন পাওয়েল সাদ্দাম হোসেনের পলাতক নেতাদের আশ্রয় দান ও ইরাকের ডব্লিউএমডি রাখার জন্য বাশারকে অভিযুক্ত করেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন নীতি প্রণেতারা সে সময় ইরাকে মার্কিন ব্যবস্থায় নেতৃত¦ দিচ্ছিলেন। পেের তারা সিরয়ার ব্যাপারে সিআইএকে দায়িত্ব দেন। সিআইএ ঈর্ষাবশত সিরিয়ায় নিজস্ব ব্যাক চ্যানেল খোলে। তাই তারা পেন্টাগনে মার্কিন নীতি প্রণেতাদের সাথে সিরিয়ানরা যাতে ব্যাক চ্যানেল খুলতে না পারে তার জন্য সকল ব্যবস্থা নেয়।
এ বিষয়টি বোঝা যায় তখন যখন ইরাকে মার্কিন পদক্ষেপ নেয়ার কয়েক মাস আগে অনুরূপ ধরনের শর্তহীন সিরীয় উদ্যোগ সিআইএ প্রত্যাখ্যান করে। প্রত্যাখ্যানের পর সিআইএ আমার অফিসের মাধ্যমে পেন্টাগন নীতি প্রণেতাদের কাছে শেষ মুহূর্তের সিরীয় উদ্যোগটি নিজেদের বলে উপস্থাপন করে।
এ ঘটনায় সিরিয়া সিআইএ-র সাথে উপস্থাপনের জন্যাদের নিজস্ব চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। ২০০৩-এর অক্টোবরে সিরিয়া-সিআইএ চ্যানেল গোছাতে টেনেট সিরিয়ায় যান। তবে তিনি সফল হননি।
ইরাকে ৮ বছরের অব্যাহত যুদ্ধে কযেক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েেেছ, সাড়ে ৪ হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে এবং বহু হাজার মার্কিন সৈন্য বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। আর ইরাকি মারা গেছে লক্ষ লক্ষ। এতে মার্কিন বাহাদুরি কিছুই নেই, ঐ অঞ্চলে তাদের প্রভাবও বৃদ্ধি পায়নি।
তারপরও যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করেছে, সিরিয়ার বাশার সরকারকে হটানোর চেষ্টায় জিহাদি সালাফিদের সাহায্য করেছে। শুধুু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানেও শাসক পরিবর্তনে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্র কি কখনো শিক্ষা নেবে?
* এফ.মাইকেল মালুফ সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, আরটি-র নিবন্ধকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ