Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভূমিকম্প হুমকির মুখে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া

| প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আবু তাহের আনসারী, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে: কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না ড্রেজার মেশিনে পাথর উত্তোলন। জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ চরম হুমকির মুখে। মরুভুমিতে পরিনত হতে চলেছে দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়া। মরুভুমির রুপ নিচ্ছে পাথরখ্যাত এ জনপদ। দেশের অন্যতম ব্যাবসা- বানিজ্য ও পর্যটন শিল্পের সম্ভবনা থাকলেও এক শ্রেণীর প্রভাবশালী অর্থলোভী ব্যক্তি বারবার উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে ড্রেজার বা বোমা মেশিনে তুলে যাচ্ছেন পাথর। এদের সাথে পেরে উঠছে না প্রশাসন।
প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথাও কোথাও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে এমন বুলি আওরাচ্ছেন পুলিশ প্রশাসন। এতে করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র চরম বিপর্যয়ের মূখে। গভীর মাটি খুড়ে ড্রেজার মেশিনে পাথর উত্তোলনে মরুভুমির রুপ নিতে যাচ্ছে নিবির শান্ত পরিবেশ সীমান্ত জনপদ। প্রতি মেশিন থেকে হচ্ছে কমিশন বানিজ্য। চলে যাচ্ছে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার কাছে। যার ফলে বার বার মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও বন্ধ হচ্ছে না পাথর উত্তোলন। এতে করে সরকার যেমন বঞ্চিত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার জাতীয় রাজস্ব। অন্য দিকে বোমা মেশিনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। মরে যাচ্ছে ছোট ছোট নদী। ড্রেজার ধ্বংসলীলায় মহা বিপর্যয় ঘটার যথেষ্ঠ শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। সরেজমিনে দেখা যায় তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমি ও নদীতে পাইপ বসিয়ে বিশাল গর্ত করে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। রাতের অন্ধকারে উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের করতোয়া নদীসহ গোনাগছ, ভদ্রেশ^র, কুকুরমোহা, দেবনগড় ইউপির কালিয়ামনি, জয়গুনজোত, শিবচন্ডি এলাকায় এবং শালবাহান ইউনিয়নের ডাহুক নদীতে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করে আসছে।
জানা যায় সবচেয়ে বেশী পাথর উত্তোলন করা হয় তেঁতুলিয়া উপজেলায়। তেঁতুলিয়ার গোবরা নদী, বাগানবাড়ি, শালবাহান বালাবাড়ি, ডাহুক নদীর লোহাকাচি, ধারাগছ, গেটকো কোম্পানী ও তার আশপাশে নিয়মিত উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর। নদীগুলোর মধ্যে করতোয়া ডাহুক, গবরা, ভেরসা বেরং নদীর গতিরোধ করে বিভিন্ন পয়েন্টে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের চলছে মহোৎসব। নদীর বুকে বালি ফেলার পাশাপাশি অসাধু চক্রটি দখল করে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পাথর উত্তোলন করছে। এতে নদীগুলো মৃতপ্রায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই চক্রটি ছড়িয়ে পড়ে নদীগুলোতে। এ ছাড়াও রয়েছে আরও অর্ধ শতাধিক পাথর উত্তোলন স্পট। এসব এলাকা ঘুরে লক্ষ করা যায় সমতল ভূমি ও নদীর বুকে বিশাল গর্ত। আর বালি ট্রলিতে বিক্রির ফলে বিশাল বিশাল গর্তে যে কোন দূর্ঘটনা ঘটার আশংকা রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা য়ায়, মেশিন ঘিরে গড়ে উঠেছে এক শ্রেণীর দালাল চক্র। তারা বিভিন্ন মেশিন থেকে চাঁদা তুলে প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করছে। আর প্রশাসনের লোকজন ম্যানেজ করার নাম দেয়া হয়েছে লাইন দেয়া। লাইন দেয়ার নাম করে চলছে চাঁদাবাজি। চক্রটি নিয়ন্ত্রন করছে কলবাহিনী। কলবাহিনী বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রশাসনের অভিযানের আলামত দেখলেই তারা মেশিন মালিকদের খবর দেয়। খবর পেয়েই মালিকরা মেশিন লুকিয়ে ফেলে। কলবাহিনীর প্রতি সদস্যকে প্রতিদিন দেয়া হয় ১ হাজার করে টাকা। অনেক সময় পুলিশ নিজেরাই তাদের অভিযানের আগাম বার্তা জানিয়ে দেয় কলবাহিনীকে। প্রতি রাতে বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বোমা মেশিন বসিয়ে একেকটি মেশিনে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার পাথর উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে পুলিশ প্রশাসনসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মেশিন প্রতি দিতে হয় ডোনেশন। মাসে বিপুল অংকের টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয় এই ড্রেজার মেশিনে পাথর উত্তোলন বানিজ্য কেন্দ্র করে। অবশ্য জেলা ও তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন গত দেড় বছরে ভ্রাম্যমান অভিযান চালিয়ে ২ শতাধিক মেশিন জব্দ করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে সচেতন মহল মনে করছেন প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে পাথর উত্তোলন করা অসম্ভব। প্রশাসন যদি এর মধ্যে সম্পৃক্ত না-ই থাকে তাহলে এখনো পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে কিভাবে।
এর সাথে পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন পুলিশের জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এ ছাড়া যে সব প্রত্যন্ত এলাকায় এসব কাজ করা হয়, সেখানে আমরা যাওয়ার আগেই হোতারা পালিয়ে যায়। তবে আমরা এ ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থানে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বোমা মেশিনে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ব্যাপারে পরিবেশবিদরা বলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী ভূমিকম্প প্রবন এলাকা হচ্ছে পঞ্চগড়। বোমা মেশিনে পাথর তোলার কারনে হাজার হাজার একর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। জানা যায়, ২০১৫ সালে পরপর কয়েকবার ভূমিকম্প হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল পঞ্চগড় থেকে ১শ কিলোমিটারের মধ্যে নেপাল ও ভারতে। পরিবেশবিদদের আশংকা নেপালের মতো ৭.৯ মাত্রা ভুমিকম্প হলেই তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমি ধ্বসের সৃষ্টি হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, বোমা মেশিন বন্ধের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে। সাধ্যমত চেষ্টা করছি। কিন্তু সবাই এগিয়ে না আসলে প্রশাসনের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সামাজিকভাবে সবার প্রকাশ্যে ঘৃনা প্রকাশ করা উচিত। তবে সম্প্রতি বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনকারী ব্যবসায়ীদের নামের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। তালিকা ধরেই আইনগত ব্যাবস্থা নেয়া হবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন সচেতন মহল।
পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারি বলেন বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলায় গভীরে বিশাল শুন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা রয়েছে। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে কয়েকবার বিভিন্ন মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভুত হয়েছে। তবে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা না হলে মাঝারি ভূ-কম্পন হলেই পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ায় ভূমিধসের আশংকা রয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ড্রেজার বা বোমা মেশিন বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভূমিকম্প

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ