পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : পাহাড় জঙ্গল সাগর নদ-নদী-খাল হ্রদ দীঘি ঝরণা উপত্যকা মিলে অপরূপ প্রকৃতির ঠিকানা ‘প্রাচ্যের রাণী’ বৃহত্তর চট্টগ্রাম। ১২০ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এখন প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। কাজকর্মের সন্ধানে সারাদেশ থেকে ছুটে আসা জনস্রোতের চাপে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির আপন নিসর্গ ও বৈশিষ্ট্যগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। ন্যাড়া ও নিধন হচ্ছে পাহাড়-টিলা। ইট-পাথর ও লোহা-লক্করের নীচে চাপা পড়েছে চাটগাঁর আদি অকৃত্রিম মোহনীয় রূপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শহর-নগরের ভূমির যেখানে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সবুজ বন-জঙ্গল গাছ-পাছালি থাকাটা জনস্বাস্থ্য, মনোজগতের সুস্থতা ও পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য অপরিহার্য সেক্ষেত্রে তা টিকে আছে অর্ধেকেরও কম। তাও বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত বেহাল দশায়। এ কারণে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে আরও ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঁচুতে থাকে। আবহাওয়া-জলবায়ু হয়ে উঠেছে চরম ভাবাপন্ন রুক্ষ ও রুদ্র।
এহেন বৈরী অবস্থায় বিরূপতা থেকে নাগরিক জীবনে সার্বিক সুস্থতা আনতে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে সবুজ প্রকৃতিকে প্রসারিত করা, অর্থাৎ বন-জঙ্গল নিধন রোধ ও বেশী বেশী করে গাছপালা লাগানো। মানুষের আগমন চাপের সাথে সাথে জমির মূল্যবৃদ্ধি আর অপরিকল্পিত শহর-নগরায়নের কারণে গাছের চারা ও বীজ বপনের মতো জায়গারও অভাব প্রকট। তবে সদিচ্ছা থাকলে তাও কোনো সমস্যা নয়। নিজেদের বাড়িঘর কিংবা ভাড়া বাসার সামনে-পেছনে আশপাশে খোলা জায়গায় এবং ভবনের ছাদে হরেক জাতের চারাগাছ, বীজ রোপন করে সবুজায়ন আজ খুব সহজ অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবনের আশপাশে অথবা ছাদে ফলদ, শাক-সবজি, ঔষধি, ফুলসহ বিচিত্র রকমের গাছ লাগিয়ে নিজেদের জন্য এক টুকরো ‘সবুজ পৃথিবী’ গড়ে তোলা সম্ভব অনায়াসেই। যা দেবে নিজেদের পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশীকে অপার্থিব আনন্দ অবগাহনে নির্মল চিত্ত-বিনোদনের খোরাক। পরিবারের সদস্যদের অলস একঘেঁয়েমী-ভরা সময়গুলো কাটবে সবুজ সুন্দরের পরিচর্যায়।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ শেরশাহ এলাকায় একটি ছয় তলা ভবনের ছাদে নজরকাড়া সবুজ বাগান গড়ে তুলেছেন নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আরিফুর রহমান। বিগত ২০১৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে অথচ নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা এই সাড়ে ১২ শ’ বর্গফুট আয়তনের ছাদ বাগান প্রায় ৭০ প্রজাতির গাছ-গাছালি শাক-সবজিতে ছেয়ে আছে। এরমধ্যে বিশেষত্ব এনে দিয়েছে বারোমাসি বারি-১১ জাতের সুমিষ্ট আম। এখনই গুটি বাঁধার অপেক্ষায়। তাছাড়া এই ফাল্গুন মাসেই গাছে গাছে আগাম ফুটেছে বারি-৫সহ বিভিন্ন জাতের আমের মুকুল (বোল)। মধু সংগ্রহে সেখানে উড়াউড়ি করছে মৌমাছির দল। খেলছে রঙিন প্রজাপতিরা। প্রকৃতিপ্রেমী আরিফের ছাদ বাগানে আরও আছে বারোমাসি মিষ্টি জাতের কমলা, আমড়া, মাল্টা। আছে হরেক জাতের দামি বনসাই বটবৃক্ষ। ৭ ধরনের সুবাসিত ফুল। মওসুমী শাক-সবজি তো হরহামেশা মিলছেই। ইনকিলাব প্রতিবেদককে গতকাল (শুক্রবার) তিনি জানান, আমার ছাদ বাগানটি করার পর থেকেই এই ভবনে তাপমাত্রায় শীতলতা অনুভব করছেন বাসিন্দারা। অধিকমাত্রায় অক্সিজেন পাচ্ছি, ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিশোধিত হচ্ছে।
কীভাবে ছাদ বাগান করতে অনুপ্রাণিত হলেন? জবাবে বললেন, আমি গ্রামের সবুজ-ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ থেকে উঠে আসা মানুষ। শহুরে জীবনে সবুজের ছোঁয়া পাইনা, হাঁপিয়ে উঠি। তাই একখন্ড গ্রামবাংলাকে শহরে তুলে এনেছি ছাদ বাগানে। প্রথমদিকে মাটি, গোবর প্রভৃতি ছয় তলার ছাদে তুলতে দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউ কেউ বলতো ‘লোকটার মাথায় গোলমাল নাকি’! আমি ছিলাম চুপচাপ। দিনে দিনে সবুজায়নে ছাদ ভরে যেতে থাকে। এখন আমার প্রতিবেশীরা বাগান দেখতে ছুটে আসেন। সাদাসিধে বিনয়ী শিক্ষক আরিফ জানান, তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কয়েকটি নার্সারি থেকে বাগানের জন্য চারা ও বীজ সংগ্রহ করে আনেন। যা আজ ফুলে ফলে সুশোভিত। নিজে দৈনিক ২ ঘণ্টা, শুক্রবার ৮ ঘণ্টা বাগান পরিচর্যায় সময় দেন। এদিকে সউদি আরব থেকে আনীত মহানবী (সাঃ)-এর প্রিয় ‘আজুয়া’ খেজুরের কয়েকটি বীজ টবের মাটিতে বপন করেন বিশিষ্ট সমাজসেবী ইউসুফ জাফর চৌধুরী শাহীন দম্পতি। ভাগ্যক্রমে ও যতেনর ফলে তাতে একাধিক খেজুর গাছ গজায় এবং সেগুলো গ্রামের বাড়িতে রোপন করা হয়। সুদূর হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে স¤প্রতি স্বদেশে বেড়াতে আসেন আশিকুল হক কুশল ও ফারহানা সুলতানা বেলী নব-দম্পতি। প্রকৃতিপ্রেমী বাবার ছাদ বাগানের জন্য সযতে নিয়ে আসেন একটি বিরল চারাগাছ। যা দেখতে ফণা তোলা বিষধর সাপের মতো!
চট্টগ্রামে সবুজায়নের প্রতি নাগরিকদের ঝোঁক বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, বন ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম গতকাল ইনকিলাবকে জানান, ইট-পাথরের কঠিন জীবন যন্ত্রণা থেকে বিনোদন ও স্বস্তি খুঁজতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সৌখিন বাগান। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় নগরীতে আরও প্রয়োজন এ ধরনের ‘অক্সিজেনের উৎস বা ভান্ডার’। এরজন্য নগরবাসীকে উৎসাহিত করতে হবে। বিল্ডিং কোড অমান্য করে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে খোলামেলা জায়গা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সবুজ গাছপালাও কমে যাচ্ছে। পরিবেশগত সুরক্ষার প্রয়োজনে অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ গাছপালা থাকতে হবে। অথচ এখন তা কমতে কমতে ১০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। তাই বিকল্প হিসেবে বাড়িঘরের ছাদের খালি জায়গায় সবুজায়ন প্রয়োজন। এরফলে পরিবেশ-প্রকৃতিরর ভারসাম্য রক্ষা এবং পারিবারিকভাবে চিত্ত বিনোদনের সুবিধা অনেক প্রসারিত হবে। তাছাড়া নির্মল বায়ু সেবন, বিষমুক্ত বিশুদ্ধ ফলমূল আবাদ করে নগরবাসী লাভবান হতে পারেন।
এদিকে ইট-পাথরের চট্টগ্রাম মহানগরীতে সারি সারি অট্টালিকার ছাদ, বারান্দা-ব্যালকনি রয়েছে অনেক জায়গাতেই খালি। আবার কোথাও কোথাও সবুজায়ন তথা শখের ছাদ বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। যেসব বাড়িঘরের ছাদে কিংবা আশপাশের খালি জায়গা সদ্ব্যবহার করে মিশ্র বাগান গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে শোভা পাচ্ছে- বিষমুক্ত আবাদে ফলনকৃত বেগুন, টমেটো, বরবটি, ক্যাপসিকাম, ঝিঙা, ধুন্দল, ঢেঁড়স, হরেক ধরনের শাক, চিচিঙ্গা, মরিচ, ধনেপাতা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, শিম, লেটুসপাতা, পুদিনাপাতা, লাউ, করলা, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন জাতের সবজি। ফলমূলের মধ্যে আছে- পেয়ারা, আম, কলা, লেবু, মাল্টা, আঙুর, কমলা, জলপাই, বরই, আতাফল, কামরাঙ্গা, স্ট্রবেরি, লটকন, জাম, পেঁপে, লিচু, শরিফা, সফেদা, কদবেল, ডালিম, আমড়াসহ কতকিছুই। হরেক রঙ, ঘ্রাণ ও জাতের ফুল সুবাস ছাড়াচ্ছে। তাছাড়া নানাবিধ ওষধি গাছ ও গুল্ম ফলানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেকে শখের বশে বাগানের একপাশে কোয়েল, কবুতরের মিনি খামার গড়ে তুলছেন। বাজার থেকে কিনতে হয় এমন অনেক কিছুই ছাদের বাগানে মিলছে।
গত বছরের ২৪ মে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে মহানগরীতে বাড়িঘরের আশপাশের খালি জায়গায় এবং ছাদ বাগান সৃজন কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ‘গ্রিন সিটি ক্লিন সিটি’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার এ কার্যক্রমে বাগানের উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। এরজন্য ৪১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে চিঠি দিয়ে সবুজায়ন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নগরীর মোড় ও আইল্যান্ডসমূহকে সবুজায়নের আওতায় আনার কাজ এগিয়ে চলেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের তৈরি একটি ‘মডেল ছাদ বাগান’ অনুসারে বাগানের মোট আয়তনের ১৫ ভাগ রাস্তা, ১০ ভাগ বসার জায়গা, ৪০ ভাগ শাকসবজি, ১০ ভাগ ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ-গুল্ম, ২০ ভাগ ফল, মসলা ও ঔষধি এবং অবশিষ্ট ৫ ভাগ অন্যান্য গাছের জন্য বরাদ্দ রাখা দরকার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২৫০টি বিশ্বমানের ছাদ বাগান সৃজনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।