চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। দুনিয়ার সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আলকুরআনের ভাষায় : ‘‘নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করিয়াছি; স্থলে ও সমুদ্রে উহাদের চলাচলের বাহন করে দিয়াছি; উহাদিগকে উত্তম রিজিক দান করিয়াছি এবং আমি যাহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছি তাহাদের অনেকের উপর উহাদিগকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছি।’’ [সূরা বনি ইসরাঈল : ৭০]
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো ওপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন, যদিও মজলুম অমুসলিম হয় : হযরত আনাস বিন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘তোমরা মজলুমের বদদু’আ থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফের হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদু’আ দ্রæত কবুল হয়ে যায়)।’’ [মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২৫৭৭, ১২৫৪৯]
ইসলাম পাঁচটি বিষয় (বিশ্বাস, সম্মান, চিন্তা/মন/মস্তিষ্ক, সম্পদ ও জীবন) সংরক্ষণ করে যা জিম্মিদের (অমুসলিম নাগরিক) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে কোন জিম্মির ক্ষতি করলো, সে যেন আমারই ক্ষতি করলো।” তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে সকল নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং এক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য বৈধ নয়।
ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা তথা দÐবিধি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়ার প্রমাণ এবং ইসলামের সৌন্দর্য্য। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাস্তবায়িত করেছেন। একজন মুসলিম (পুরুষ বা নারী) তার প্রত্যেকটি কাজের জন্যই দায়িত্বশীল। শরীয়াহতে যে সকল অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে তা রাষ্ট্র কার্যকর করবে। সমাজকে রক্ষা করে শুধুমাত্র এই কারণেই এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শরীয়াহ্ আদালতের মাধ্যমে কোন অপরাধের শাস্তি হয়ে গেলে ঐ একই অপরাধের জন্য আখিরাত তথা পরকালের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কারণ দুনিয়ার তুলনায় আখিরাত বা জাহান্নামের শাস্তি বহুগুণ কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় অনেক মুসলিম তাদের নিজেদের অপরাধ নিজেরাই স্বীকার করতো, কারণ শেষ বিচারের দিন তাদের ঐ অপরাধ আমলনামায় গণ্য হোক তা তারা চাইতো না। আবু দাউদ হতে বর্ণিত, যখন একজন লোক নিজের অবৈধ যৌনাচার নিজে স্বীকার করল এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “কস্তুরীর সুগন্ধির চেয়ে সে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দীয়”। অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একজন মহিলা আসলো এবং বললো, ‘আমি জেনা করেছি’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘চলে যাও’। সে ফিরে গেল এবং পরের দিন আবার আসলো এবং বললো “সম্ভবতঃ আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিতে চান যেমনি দিয়েছিলেন মা ইয বিন মালিককে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি গর্ভবতী।” তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘চলে যাও’, এবং শিশুর জন্মের পর আস, সে শিশুর জন্মের পর আসলো এবং বললো, “এইতো সে। আমিই তাকে জন্ম দিয়েছি।” তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘চলে যাও এবং তাকে পান করাও যে পর্যন্ত না স্তন না ছাড়াও’। যখন মহিলাটি শিশুটিকে স্তন ছাড়াল তখন সে তাকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলো। এই সময় শিশুটির হাতে কিছু ছিল যা সে খাচ্ছিল। তখন শিশুটিকে মুসলিমদের মধ্যে একজনকে দেয়া হল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাটির বিষয়ে নির্দেশ দিলেন- অতঃপর তার জন্য একটি গর্ত খোড়া হল এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিষয়ে নির্দেশ দিলেন এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাথর নিক্ষেপ করা হল। যারা পাথর ছুড়েছিল তাদের মধ্যে একজন খালিদ। সে তাকে একটি পাথর নিক্ষেপ করলো। যখন মহিলাটির এক ফোঁটা রক্ত তার গালে পড়ল, তখন সে মহিলাটিকে গালি দিল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “হে খালিদ, বিনীতভাবে। সেই স্বত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, সে এতবেশি অনুতপ্ত হয়েছে যে, যদি কোন বড় জালেমও এই ধরণের তওবা করত তবে সেও মাফ পেয়ে যেত।” এরপর তার বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হল, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দু‘আ করলেন এবং তাকে কবর দেওয়া হল। [মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ইনসাফপূর্ণ যে সমাজ কায়েম করেন, তার ভিত্তি ছিল নৈতিকতা ও মানবজাতির সার্বজনীনতা। মানুষ যদি রিপুর তাড়নার নিকট পরাভ‚ত হয় তা হলে সুস্থ সমাজের বিকাশধারায় সে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না। মদ্যপান, জুয়া যাবতীয় অমার্জিত, নীচ স্বভাবের অনিষ্ট কার্যকলাপ। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘৃণার চোখে দেখতেন। সুদ-ঘুষ সমাজকে কলুষিত করে। ইসলামে ঘুষের উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পদস্থ কর্মচারী ও শাসকদের প্রদত্ত উপঢৌকনকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করোনা এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ [সূরা বাকারা : ১৮৮] আবদুল্লাহ্ ইবন আমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা এবং গ্রহীতার উপর লা’নত করেছেন।’ [মোসনাদে আহমাদ : ৩৫৪২] এছাড়া ঘুষ গ্রহণের কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম ।’ [বুখারী, মিশকাত/৩৯৯৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য ভক্ষণ করা শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ [মিশকাত/২৭৮৭] মনুষ্যত্বের উজ্জীবন, চারিত্রিক উৎকর্ষ ও নৈতিক উপলব্ধি সুস্থ সমাজ বিকাশের সহায়ক আর ইন্দ্রিয়জাত প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অনিষ্টকর প্রথা সমাজের সুস্থতার ভিত্তিমূলকে একেবারে নড়বড়ে করে দেয়, জন্ম হয় জুলুম ও বেইনসাফির। এই উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়া খেলা, মদ্যপান, নেশাগ্রহণ, কুসিদপ্রথা, জিনা-সমকামিতা ও অহেতুক রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দেন। [জালালউদ্দীন সায়ুতি, দুর আল মানসুর, ১ খ., পৃ. ৩৯১; ইবনে কাসির, সিরাতুন নবুবিয়াহ, ৪ খ, ১৯৭৮, পৃ.৩৯২] ফলে সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ভয়াবহতার হাত হতে মানুষ রেহাই পায়।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদীনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোতে যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে তার নজির পাওয়া মুশকিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে খুলাফায়ে রাশেদিন যে সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন, তা ছিল পুরাপুরি সুবিচার ও ন্যায়-ইনসাফ নির্ভর। মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের যে নজির ইসলামের মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার বুকে স্থাপন করে গেছেন, তার আলোক শিখা এখনো পৃথিবীতে অনির্বাণ। আজকের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণ করতে হবে এবং মনে রাখতে হবে মহান আল্লাহর বাণী, “কল্যাণ করো তোমাদের বাবা-মা, নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, যারা অসহায় প্রতিবেশী এবং চলার পথে যাদের সামনে পাবে।” [সূরা আননিসা : ৩৬]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।