Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভিসির পদত্যাগ দাবিতে অচল আইইউটি

অনিয়ম, দলীয়করণ ও ফি বৃদ্ধিসহ নানা অভিযোগ

মোঃ দেলোয়ার হোসেন, গাজীপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) ভূক্ত রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন পড়াশুনা, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের এগিয়ে নিতেই গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি)।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে উচ্চশিক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে শিক্ষার গুণগত মানের কারণে প্রশংসিত হয়ে আসছে। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পাঠদান, মেধাবী ছাত্রদের অংশগ্রহণ, ছাত্র রাজনীতি মুক্ত হওয়ায় শিক্ষার পরিবেশে সন্তুষ্ট সকলেই। ভর্তির জন্য দেশে-বিদেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতাও থাকে তীব্র। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিগত দিনে আইইউটিতে ভিসিসহ অন্যান্য প্রতিনিধি নিয়োগে রাজনীতিমুক্ত ছিল। তবে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আইইউটিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ড. মুনাজ আহমেদ নূর। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতদের সাথে বেতন-ভাতা নিয়ে বৈষম্য, স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি সার্কুলারে অযৌক্তিক ও বিতর্কিত বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করায় আপত্তি তোলেন শিক্ষার্থীরা। ভর্তি সাথে ১০০ মার্কিন ডলার ফি বৃদ্ধি করায় সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা মুনাজ আহমেদকে দায়ি করে আন্দোলন করেন। কিন্তু আন্দোলনের কোন উত্তর না পাওয়ায় সেসময় তারা সমাবর্তন বর্জন করে ¯œাতক শেষ করা শিক্ষার্থীরা। আগে যেখানে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে আইইউটির সমাবর্তন হতো সেখানে মুনাজ আহমেদ ভিসি হওয়ার পর এই ধারা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু বন্ধ হয়নি ভিসির অনিয়ম। ফলে এবার ভিসির অনিয়মের বিরুদ্ধে ফের আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মুনাজ আহমেদকে অপসারণ না করা পর্যন্ত তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এজন্য দিন-রাত লাগাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে আন্দোলনকারীরা। তাদের যৌক্তিক দাবি না মেনে নিলে আন্দোলন বন্ধ করবেন না বলে ওআইসির মহাসচিব ড. ইউসেফ বিন আহমাদ আল -ওথাইমিনকে চিঠিতে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষর্থীদের আন্দোলনে ৭ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশ পথ। বন্ধ আছে ক্লাস-পরীক্ষাসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম। গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যান ভিসি মুনাজ আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, গাজীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি (আইইউটি) ভিসি ছাড়াই চলছে। গত ২৩ জানুয়ারি সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যায়টির ফ্যাকাল্টি অ্যান্ড স্টাফ মেম্বার ও শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। চলমান এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৭ দিন ধরে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালটির মূল ফটক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গত মঙ্গলবার আন্দোলনকারীরা ভিসি ড.মুনাজ আহমেদ নূরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়নি। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে ফিরে যান। এরপর থেকে তাঁকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। আন্দোলনকারীরা মূল ফটকের ভেতরে বিশাল সামিয়ানা টানিয়েছে। ভিসির প্রবেশ ঠেকাতে তারা সেখানে দিনরাত বসে পাহারা দিচ্ছেন। গভীর রাতেও শিক্ষার্থীদের মূল ফটক পাহারা দিতে দেখা গেছে। ভিসি বিহীন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঠদান ও দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
আন্দোলনরতরা জানান, আইইউটির ভিসি পদে প্রফেসর ড. মুনাজ আহমেদ নুর ২০১৬ সালে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম করে আসছেন। এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভিসির অপসারণের দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে মঙ্গলবার হতে আন্দোলন শুরু করে। তবে ১৩ দফা দাবিতে তাদের আন্দোলন শুরু হলেও বর্তমানে এক দফা আন্দোলন ভিসি হটাও চলছে। ভিসি মুনাজ আহমেদের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ করে বলেন, মুনাজ আহমেদ যোগ দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রে মানের অবনতি হয়েছে। আসনের চেয়ে বেশি ছাত্র ভর্তি, হলের সিট বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম, খালি থাকা সত্তে¡ও সিট না দেওয়া, অপর্যাপ্ত শিক্ষক, ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের সংকট, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই টিউশন ফি বাড়ানো, অবাস্তব যাতায়াত ব্যবস্থা চালু এবং হঠাৎ তা বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছেন তিনি। তারা জানায়, এসব সমস্যা ও ভিসির অনিয়মের বিষয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ওআইসির মহাসচিব ড. ইউসাফ বিন আহমদ আল ওথাইমেনের বরাবর অভিযোগ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওআইসি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত করে গেলেও এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। এক মাসের খাবার নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেশ ও ভিসির অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা শিক্ষকরা জানান ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে আইইউটিতে যোগ দেন বর্তমান ভিসি ড. মুনাজ আহমেদ নূর। যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি ফ্যাকাল্টি ও স্টাফ মেম্বারদের প্রতি অপেশাদর আচরণ শুরু করেন। তিনি কারণ দর্শানো ছাড়াই শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তা প্রহরীদের (সিকিউরিটি গার্ড) চাকরি থেকে অপসারণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে বৈষম্যমূলক কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছেন; তাঁর অনুসারীদের অতিরিক্ত সুবিধা দিচ্ছেন; চুক্তিভিত্তিক অভিজ্ঞ ও প্রবীণ শিক্ষকদের চুক্তি বাতিল করেছেন। তাঁর খামখেয়ালি ভতিপ্রক্রিয়ার কারণে শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবরেটরির পরিবেশের অবনতি হয়েছে। বর্তমান বেতন কাঠামো সংস্কারের জন্য ওআইসির নির্দেশনা মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
আইইউটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার মনির হোসেন অভিযোগ করেন, যোগ দেওয়ার পরই ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি শতভাগ আবাসিক ছিল। তাঁর যোগ দেওয়ার আগে আসন ছিল ২৫০। যোগ দিয়েই তিনি আবাসন ব্যবস্থা, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা না করেই আসন ৬৫০টিতে উন্নীত করেন। যার প্রভাবে যেখানে আগে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করত, এখন সেখানে করে দেড় শতাধিক। আগে যেখানে একসঙ্গে ২৫ জন ল্যাব সুবিধা পেত, এখন দ্বিগুণ শিক্ষার্থী ল্যাবে যায়। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ২১ শতাংশ বাড়িয়েছেন, কিন্তু সেবার মান বাড়েনি বরং কমেছে। তাঁর দুর্ব্যবহার ও একের পর এক অনিয়ম শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. তসলিম রেজা বলেন, ২৩ জানুয়ারি ভিসি আন্দোলনের মুখে পুলিশ ও স্থানীয় কয়েকজন নেতার সহায্যে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ২৪ জানুুয়ারি আইইউটির প্রো-ভিসি ড.ওমর ঝা আন্দোলনরতদের পক্ষ থেকে ৫ জন শিক্ষক ও দুইজন ছাত্র (বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রো-ভিসি প্রতিনিধিদের জানান, ওআইসি থেকে ভিসিকে অফিসিয়ালি আদেশ দেয়া হয়েছে যাতে তিনি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মচারি এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলটি প্রো-ভিসির মাধ্যমে ওআইসির মহাসচিব ড.ইউসেফ বিন আহমাদ আল-ওথাইমিনকে একটি চিঠি পাঠান যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল শিক্ষক, কর্মচারি ও স্টাফ মেম্বাররা একাত্মতা প্রকাশ করেন। ওআইসির পক্ষ থেকে ভিসিকে অব্যাহতি না দেয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সকল ক্লাস বর্জন করবে বলে জানিয়েছে। ভিসির পদত্যাগের দাবি যৌক্তিক। এ ব্যাপারে ওআইসির পক্ষ থেকে লিখিত কোন সিদ্ধান্ত না জানানো পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আইইউটির প্রটোকল অফিসার নাহিদুল ইসলাম প্রধান বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভিসির বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সম্ভাবনা নেই। ভিসির বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, আন্দোলনের ব্যাপারে ওআইসিকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। ভিসি ওআইসির দিক নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন।
এ ব্যাপারে আইইউটির ভিসি প্রফেসর ড. মুনাজ আহমেদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বহির্বিশ্বের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করতেই কিছু সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থীরা বিশেষ মহলের মদদে আমার বিরুদ্ধে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে তাদের আনা কোনো অভিযোগ সঠিক নয় এবং সবগুলোই ভিত্তিহীন। যে ইস্যু নিয়ে তারা আন্দোলন করছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। এ ছাড়া আন্দোলনকারীরা তাদের যৌক্তিক কোনো দাবি নিয়ে আমার কাছে কখনো আসেননি। উপরন্তু তারা ওআইসির ড. ইউসেফ বিন আহমাদ আল-ওথাইমিনের কাছে নানা অভিযোগ উল্লেখ করে আমাকে অপসারণের আবেদন করেন।
বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম দেশের ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) আইইউটি পরিচালনা করছে। বিশ্বের ২০টি মুসলিম দেশের শিক্ষার্থীরা আইইউটিতে অধ্যয়ন করছে। আইইউটি দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে একই সঙ্গে টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল কোর্সের পাঠদান করা হয় এবং কোর্স শেষে ওই দুটি বিষয়ের ওপর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। আইইউটি’র প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম ভিসির অপসারণের জন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভিসি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ