চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সৈয়দ আহসান
\ শেষ \
উল্লেখ্য যে, আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী ও মুফতী দীন মুহাম্মদ খান মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নতুন ভাবে রাজনৈতিক বলয় তৈরী করার পক্ষে জোরদার ভুমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে একটু উদাসিন ছিলেন, বিধায় সৈয়দ মুছলেহ উদ্দীন এ অভাবনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেন। এদিকে দেশব্যাপী সফরের অংশ হিসাবে হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. ঢাকায় এলেন। ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে ১৯৪৯ সালে ৯ ও ১০ ই ফেব্রুয়ারী ২ দিন ব্যাপী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে আশা ভরসা নিয়ে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিছুদিন পর দেখা গেল তা যেন পূরণ হবার নয় । সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে জমিয়ত আবার দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এছাড়া শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. সমগ্র জাতিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯৪৯ সনের ১৩ই ডিসেম্বর দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। জমিয়তের কর্মতৎপরতা ক্রমান্ব^য়ে আরো স্থবির হয়ে পড়ে। (দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট থেকে ১৯৫০ সালের ২০ শে ফেব্রæয়ারী পর্যন্ত)
ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রশ্নটি তখন অন্যান্য জাতীয় সমস্যার ন্যায় নিচে চাপা পড়ে যায়। ইসলামী রাজনীতির এ দুর্দিনে সমগ্র জাতি এটা অনুভব করেছিল যে, গোটা আলেম সমাজ ও ইসলাম দরদী জনগোষ্টীকে ঐক্যের পতাকা তলে সমবেত করে ইসলামী আন্দোলন কে গতিময় করার জন্য একজন বিজ্ঞ সংগঠক, দীন দরদী ও পরিশ্রমী যোগ্য নেতার খুবই প্রয়োজন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত মুসলিম জনসাধারণ কে উজ্জীবিত ও জাগিয়ে তুলার জন্য এগিয়ে এলেন নবী খান্দানের সিংহপুরুষ, সিলেট বিজয়ী সৈয়দ নাসিরুদ্দীন সিপাহসালারের উত্তÍরসূরী মাওলানা সৈয়দ মুছলেহউদ্দীন রহ.। প্রথমে তিনি চেষ্টা করলেন ঢাকায় একটি জাতীয় উলামা সম্মেলন করার। মুসলীম লীগ সরকারের প্রচন্ড প্রতাপ ও চাপের মুখে সব কিছু পন্ড হয়ে যায়,ব্যর্থ হয়ে যায় তার প্রথম প্রয়াস। এতসব প্রতিকূলতার মাঝেও মরহুম মাওলানা নিরাশ হলেন না। তাঁর সুযোগ্য পিতা মাওলানা শাহ সৈয়দ ইয়াকুব আলী রহ. এর স্বপ্নের ইশারায় আদিষ্ট হয়ে মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী ও মুফতি দীন মুহাম্মদ খাঁন সাহেব কে বাদ দিয়েই জমিয়তের সহ সভাপতি হিসাবে তিনি তার জন্মভূমি ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার ঐতিহ্যবাহী মাছিহাতা দরবার শরীফে জমিয়তে উলাময়ে ইসলামের ২য় কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। এগিয়ে এলেন তার বড় দুই ভাই মাওলানা শাহ সৈয়দ কুতুবুর রহমান (তৎকালিন সময়ে কুমিল্লা জেলা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি) ও মাওলানা শাহ সৈয়দ আবু আবদুল্লাহ আহম্মদ। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে এক আবেগময় আহব্বান পত্রে তিনি দীন দরদী উলামায়ে কিরাম, ইসলাম সচেতন আধুনিক শিক্ষিত সমাজ ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সকল শ্রেণী পেশার ইসলাম প্রিয় সকল মানুষ কে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত হয়ে এদেশে নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী কাফেলায় সমবেত হবার জন্য আহবান জানান। মুসলীম লীগ সরকারের বহু বাধা বিপত্তি ও চাপের মুখে দেশের প্রথম সরকার বিরোধী একটি ইসলামী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলার প্রয়াসে তিনি সফল হলেন। তবে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন, যে সম্মেলন ঢাকায় বা অন্য কোন বড় শহরে করা সম্ভব হয়নি মাছিহাতার মত একটি অজপাড়া গাঁয়ে তা কী করে সম্ভব ? কিন্তু না, মাছিহাতা দরবারের সকল সদস্য, মুরিদ, এলাকাবাসী ও বিভিন্নস্তরের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সর্বাত্মক সহযোগীতা ও সমর্থনে ১৯৫০ সালের ১৮,১৯ ও ২০ শে ফেব্রæয়ারী ৩দিন ব্যাপী এদেশে ইসলামী আন্দোলনের সূচনাকারী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক কাউন্সিল অধিবেশন সুন্দর ও সফল ভাবে শেষ হয়। তৎকালীন সময়ে বি,বি,সি ও ভয়েস অব আমেরিকা খুবই গুরুত্বে¡র সাথে এই সংবাদ পরিবেশন করে। সভার আহবায়ক ও অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক মাওলানা সৈয়দ মুছলেহ উদ্দিন রহ. তার বাড়ীর চত্বরে এক বিশাল প্যান্ডেল তৈরী করেন। যার নাম দেয়া হয় শাব্বির ময়দান। প্রথম দিন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কালামেপাক থেকে তিলাওয়াত করেন নেত্রকোণার মাওলানা মনযুরুল হক রহ.। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা আব্দুর রহীমকে সভার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর সভার আহবায়ক ও অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক মাওলানা সৈয়দ মুছলেহ উদ্দিন রহ. এবং অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি মাওলানা আতাহার আলী রহ. তাদের স্বাগতিক ও উদ্বোধনী ভাষণে জমিয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মুসলীম লীগের সাথে জমিয়তের সম্পর্ক, পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, কাশ্মীর ও মুহাজির সমস্যা ও পাকিস্তানে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আলোকপাত করে বক্তব্য রাখেন।
দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং জমিয়তের পুনঃর্গঠনকল্পে মাছিহাতার এ ঐতিহাসিক সম্মেলন এদেশে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম সক্রিয় উদ্যোগ ছিল। এই সম্মেলন থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নতুন প্রত্যয় ও অঙ্গিকার নিয়ে এদেশে ইসলামী নেজাম ও নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৫০ সালের সম্মেলনে যে সমস্ত বীর মুজাহিদের নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তারা হচ্ছেন.
সভাপতি:- মাওলানা শাহ নেসার উদ্দিন (পীর সাহেব শর্ষিনা),
কার্যকরী সভাপতি:- মাওলানা আতহার আলী (কিশোরগঞ্জ) সহ সভাপতিবৃন্দ:- মাওলানা সৈয়দ মুছলেহ উদ্দিন (প্রিন্সিপাল হয়বতনগর কামেল মাদ্রাসা), হযরত মাওলানা আল্লামা রাগেব আহছান (ঢাকা), হযরত মাওলানা আ. আজিজ সাহেব (খলীফা থানবী রহ. নোয়াখালী), হযরত মাওলানা শাহ ফজলুল হক সাহেব (পাকুরিয়া শরীফ, রংপুর), হযরত মাওলানা রমিজ উদ্দিন সাহেব (সিলেট), সাধারণ সম্পাদক:- হযরত মাওলানা শেখ আবদুর রহিম সাহেব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যুগ্ম সম্পাদকবৃন্দ:- হযরত মাওলানা জালালউদ্দিন সাহেব (মোমেনশাহী), হযরত মাওলানা নুরুদ্দীন সাহেব (বরিশাল), সাইদুর রহমান সাহেব (কিশোরগঞ্জ), ড. সৈয়দ নোমান যায়দী (ঢাকা), মাওলানা মো. ইয়াকুব শরীফ সাহেব (ঢাকা), মৌলভী মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন সাহেব (ঢাকা), হাকীম সিরাজ উদ্দিন খান সাহেব (ঢাকা), মৌলভী হাফেজ আবুল বারাকাত মজিদ হুসাইন সাহেব (রংপুর), মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহীম নগরী সাহেব (বগুড়া), মৌলভী হাকীম আহমদুর রহমান সাহেব (রংপুর), মৌলভী মোহাম্মদ আরেফ সাহেব (বংশাল ঢাকা), মৌলভী জমসেদ হোসেন সাহেব (ঢাকা)। উক্ত কমিটিতে ৩১ জন কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
মাওলানা সৈয়দ মুছলেহ উদ্দিন সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনুষ্ঠিত জমিয়তের এই সম্মেলনের বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই সম্মেলনে সকল দলের প্রতিনিধি ছিল (১) শরীয়ত ও তরীকতের উলামা ও মাশায়েখ (২) দেওবন্দ, সাহারানপুর, থানাভন, রামপুর ব্রেলী, টাংক ফুলবাড়ীয়া, ফিরিঙ্গি মহল প্রভৃতি বিভিন্ন মাসলাকের উলামাদের অংশগ্রহণ (৩) আহ্লে সুন্নত উলামা (৪) সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. এর সিলসিলার মুজাহিদ জামাত (৫) আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইংরেজী শিক্ষিত দীনদার জামাত (৬) সাধারণ দীনদার ও পরহেজগার জামাতের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রত্যয়ে এদেশের জমিনে আল্লাহর দীন তথা নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে মাছিহাতার এই ঐতিহাসিক সম্মেলন সমাপ্ত হয়।
শুধু ১৯৫০ সালের সম্মেলনই নয়, ৫০ সালে মাছিহাতায় ৫২ সালে হয়বতনগর (নিজ বাড়িতে) ও আবার ৫৩ সালে মাছিহাতায় পরপর নিজ দায়িত্বে তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে ইসলামী আন্দোলনের যে ভিত তিনি রচনা করে ছিলেন আজও তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে প্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে। তবে ১৯৫০ সালের ঐতিহাসিক সম্মেলনকে নির্দ্বিধায় এদেশের সকল ইসলামী আন্দোলনের মাইলফলক হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই নব উদ্দীপনায় নেজামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পথ চলা শুরু হল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।