পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
টেবিলে টেবিলে অনেক গ্রাহক খাবারের অপেক্ষায়। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। গতকাল (সোমবার) বন্দরনগরীর একটি তারকা হোটেলের দৃশ্যপট এটি। ত্যক্ত-বিরক্ত গ্রাহকদের অবস্থা বুঝতে পেরে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজোর এগিয়ে এসে আরও ৩০/৪০ মিনিট সময় চেয়ে সবিনয়ে বলছিলেন, ‘স্যার গ্যাস তো নেই। গত ক’দিন ধরে এলপি সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না করতে হচ্ছে। তবে তা দিয়ে সামলে উঠতে পারছি না। আপনাদের কষ্টের জন্য দুঃখিত’। নগরীর চকবাজারের গৃহবধূ মনজুরা খানম জানালেন, ‘প্রায় দিনভর গ্যাস থাকেনা। মাঝরাতের দিকে অল্পস্বল্প গ্যাস আসে। তখন মিটিমিটি চুলা জ্বলে। শেষ রাতে কিছুক্ষণ গ্যাস থাকলেও সকাল না হতেই আর চুলা জ্বলে না। শেষরাতে অসময়েই তীব্র শীতের কষ্ট সহ্য করে ঘুম বাদ দিয়ে উঠে যেতে হয়। পরিবারের ৬ জন সদস্যের জন্য তাড়াহুড়া করে কিছু রান্না-বান্না সারি। আবার কখনও হোটেল কিংবা বেকারি থেকে খাবার কিনে আনি। যদি ঘরে মেহমান আসে তখন আরেক বিড়ম্বনা’। নগরীর জনবহুল এলাকা জামাল খান আসকার দীঘির পাড়ের বাসিন্দা নীহারিকা বড়–য়া সীমা সখেদে বললেন, ‘আজ (গতকাল) আমি ৫৫০ টাকায় একটি কেরোসিনের স্টোভ কিনলাম। অনেকদিন গ্যাস পাচ্ছি না। যখন আসে তাও হঠাৎ। থাকে অল্পক্ষণ। তাই কী আর উপায়। উপোস তো আর থাকা যায় না’!
এমননিভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের আবাস, ১২০ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সবখানেই তীব্র গ্যাসের সঙ্কটে বলতে গেলে হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। চট্টগ্রামের গ্যাস সঙ্কট একটি পুরনো ‘ক্রনিক’ সমস্যা। এরমধ্যে গতকালসহ গত তিন-চারদিন যাবত গ্যাসের সমস্যা আরও তীব্রতর হয়েছে। বেশিরভাগ এলাকায় মধ্যরাতের সময় কিংবা এর পরে অল্পক্ষণ সময় ধরে থাকে গ্যাসের চাপ। সারাদিন গ্যাস পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার পর কোথাও রাতের যে কোনো সময় লাইনে গ্যাস আসা শুরু হয়ে স্বল্প চাপে চা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু রান্না-বান্না চলেনা। অনেক গৃহবধূ প্রেসার কুকার দিয়ে ভাত রান্না করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু তরকারি, মাছ, গোশত রান্নার উপায় নেই অনেকেরই। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এই মহানগরীজুড়ে বাড়িঘর, তারকা ও অভিজাত হোটেল-রেস্তোঁরা থেকে শুরু করে সাধারণ হোটেল-রেস্তোঁরা, খাবারের দোকান, বেকারি ও কনফেকশনারি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, ফাস্টফুডের দোকান সর্বত্রই এখন গ্যাসের সমস্যায় নাকাল অবস্থা। শিল্প-প্রধান অঞ্চল হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের শত শত বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা ধুঁকছে গ্যাসের অব্যাহত সঙ্কটে। সার্বিকভাবে উৎপাদনশীলতায় নেমেছে ধস। ক্রমবর্ধমান গ্যাসের অভাবে গৃহবধূ-গৃহস্থী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা পর্যন্ত সবার মাঝে ক্ষোভ-অসন্তোষ, হতাশা বিরাজ করছে।
অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাসের ঘাটতি পূরণে সরকার আন্তরিক ও সচেষ্ট উল্লেখ করে জানায়, আগামী মার্চ কিংবা এপ্রিল নাগাদ মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম ‘এনার্জি হাবে’ এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের ব্যাপারে আশাবাদী। এলএনজি টার্মিনাল, এনার্জি হাব থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। এই গ্যাস চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিড লাইনের সাথে সংযুক্ত হবে। এরপর ধাপে ধাপে চট্টগ্রামে শিল্প এবং গৃহস্থালী খাতে গ্যাসের ঘাটতি নিরসন হবে। সম্প্রতি জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কক্সবাজারের মহেশখালী মাতারবাড়ীতে এলএনজি, বিদ্যুৎকেন্দ্র সমেত এনার্জি হাব এবং বহুমুখী সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতের বড়সড় বিনিয়োগে মহেশখালীতে জ্বালানি সেক্টরে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প-মহাপ্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে। যার মূল রূপকার জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা- জাইকা। সরকার আশা করছে মাতারবাড়ী এনার্জি হাব সম্পন্ন হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস এবং বিদ্যুতের সঙ্কট থাকবে না। বরং জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য জেলায় ঘাটতি মেটাতে জোগান দেয়া সম্ভব হবে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামে গত এক সপ্তাহে গড় চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের সরবরাহ মিলছে প্রায় অর্ধেক। বৃহত্তর চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ন্যুনতম সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায় সাধারণত গড়ে মাত্র ১৯০ থেকে ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। শিল্প-কারখানা, আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে। তবে জোগান মিলছে না। এ মুহূর্তে গ্যাসের সঙ্কট প্রকট হওয়ার কারণে ঘরে ঘরে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী। কল-কারখানায় থমকে গেছে উৎপাদন। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দাদশা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশিরভাগ সময়েই গ্যাসের চাপ থাকে সর্বনিম্নে। নগরবাসীর গা-সওয়া হয়ে গেছে গ্যাস সঙ্কট। কেননা অনেকেরই রান্নাঘরে গ্যাসের চুলার পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে কেরোসিনের চুলা! চট্টগ্রামবাসী দিনে-রাতে গ্যাসের অপেক্ষায় কাটিয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছেন। নাগরিকরা একে বলছেন ‘গ্যাসের লোডশেডিং’। সময় গণনা করছেন কখন আসবে গ্যাস নামের সোনার হরিণ।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে ও স্বল্প চাপে নগরীর হোটেল-রেস্তোঁরা, বেকারি ও খাবারের দোকানগুলোতে খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা এখন কঠিন। সেই সুবাদে অতি মুনাফালোভী এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট যোগে ক্রেতাদের পকেট কাটছে। উপযুক্ত দামের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগ থেকে দ্বিগুণ বেশি দাম উসুল করছে। গ্যাস সঙ্কট পুঁজি করে সিন্ডিকেটটি নগরীর বিভিন্ন স্থানে ও শহরতলীতে এমনকি গ্রামেও সিলিন্ডারেরও কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ফায়দা লুটছে দেদারসে।
গ্যাসের ঘাটতি বেড়ে গিয়ে চট্টগ্রামের কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষত গার্মেন্টস খাতসহ রফতানিমুখী শিল্প পরিচালনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গৃহস্থালী খাতে গ্যাসের সঙ্কট সবচেয়ে শোচনীয়। নগরীর সিএনজি স্টেশনগুলো গ্যাস সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকছে। গ্যাস সংগ্রহেরর জন্য যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গ্যাসের নতুন সংযোগ অঘোষিতভাবে বন্ধ। গ্যাস সংযোগের অভাবে আবাসন শিল্পখাত মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এদিকে গ্যাস চুরিও চলছে সমানতালে। সেই সাথে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) নিয়মিতভাবেই বিশেষ স্কোয়াড দিয়ে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
চট্টগ্রামের পুরনো ও নতুন শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ অনিয়মিত এবং তাও খুব সীমিত। এ কারণে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না কোন কল-কারখানা। উৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত। প্রতিদিন গচ্ছা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। শিল্প-কারখানা স্থাপনে ব্যাংকঋণের দায়-দেনা বেড়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন গ্যাস সমস্যায় ভুগছে। তা নিরসন করতে হবে। আমরা ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে এ সমস্যা অনেকবার তুলে ধরেছি। গ্যাস প্রাপ্তি ও গ্যাস সংযোগের অভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রফতানিমুখী গার্মেন্টস, সিএনজি ফিলিং স্টেশন, আবাসন, স্টীল ও রি-রোলিং মিলসমূহে উৎপাদনে বিপর্যয় হচ্ছে। এসব খাতের উদ্যোক্তারা হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। মূলধনী যন্ত্রপাতি বিনষ্ট, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের গতিধারা তথা দেশের অর্থনীতিকে বেগবান রাখতে হলে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চান শিল্প-মালিক ও রফতানিকারকগণ। তাছাড়া গৃহস্থালী গ্যাসের অভাবে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।