ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
জুবাইদা গুলশান আরা
স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচলে আমাদের দিনগুলো সময়কে সাথী করে চলছে। কবে কোথায় যাত্রা শুরু করেছিলাম তা মনে পড়ে না। অথচ চলেছি তো বিশাল ¯্রােতে ভেসে। জীবনের ¯্রােত। জটিল তত্ত্ব নিয়ে মানুষ সারা জীবন সাধনা করে। জীবনের ছেলেবেলার সরল-সুন্দর জীবন একসময় বদলে যায়। মানুষও বদলায়। যেমন ছিল আমাদের জীবন কথার প্রারম্ভিক দিনগুলোয়। দেশ ভাগ হলো ’৪৭ সালে। স্বাধীনতা তখনো সেটাই ছিল স্বাধীন দেশের আনন্দ। তারপরেই দিনগুলো বদলে যেতে শুরু করল। প্রথম ধাক্কা এলো ভাষা আন্দোলনে। ঈশ্বর সাক্ষী সেই সময়ের বাংলাদেশেও আউল বাউল, কিষাণ-মজুর সবার জীবন ঘেঁষা, নদীনালা, খাল-বিল নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতি ঘেঁষা জীবন ছিল ভালোবাসার মূল আকর্ষণ। সবার ভাষা ছিল বাংলা। একমাত্র বাংলা। বাংলা ভাষা গড়ে উঠেছে প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর নানা ভাষার সংমিশ্রণে। যে ভাষায় আছে আন্তর্জাতিকতা, আর দয়াময় মানব জীবনের মাধুর্য। অতঃপর মাতৃভাষার লড়াইটা সফল হয়ে ওঠে। রক্ত ¯্রােতে ভাসে ঢাকা শহর। মানুষের আবেগ নয়, অস্তিত্বের লড়াইটা শেষ অবধি মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে যায়।
আমাদের কিশোর কালের দুশ্চিন্তাবিহীন নিরুদ্বেগ জীবনে এক সময় ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্ত¯œাত দাবি আদায়ের যুদ্ধে। নৈতিক চিন্তাধারা জগতে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের তারুণ্যে, যৌবন্যে, জীবনাচরণে সৃষ্টি করেছিল চেতনার বিপ্লব। যার ফলশ্রুতিতে আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীনতা মনে হলেও প্রকৃত স্বাধীন সত্তার প্রশ্ন তখন থেকেই বাংলাদেশের জনজীবনকে তাড়িত করেছে।
আসলে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই চোখে পড়ে প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশ বারবার বহিরাগতদের হাতে পরাধীন হয়েছে। শোষিত ও শাসিত হয়েছে। লোকজীবন, রাজনৈতিক জীবন ধরায়, পাঠান মোগল ও সর্বোপরি পাশ্চাত্যের ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ জাতি কখনো ব্যবসায়ী কখনো শাসক হয়ে এদেশের জীবন চর্যাকে নানাভাবে বিব্রত ও বিভ্রান্ত করেছে। বহিরাগত মোগলদের সঙ্গে পাঠনদের যুদ্ধ। ঈসা খাঁ, মুসা খাঁর ঝঞ্জাসংকুল শাসনকালের পাট চুকে যাবার পরপরই ইংরেজদের দীর্ঘ শাসনকালে বাংলাদেশের মানুষ বারবার নানা ধরনের বিদ্রোহ করেছে। এসব বিদ্রোহই স্বাধীন সত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের বাঁচার আকাক্সক্ষা। বিশাল জনযুদ্ধ না হলেও তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা অথবা সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যাই বলি, অথবা সিপাহি বিদ্রোহ, সব কিছুর মূলেই ছিল স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা শৃঙ্খলিত জীবনের এক অনিঃশেষ এবং পীড়াদায়ক জীবন ধারার অভ্যস্ততা মানুষের বিশাল জাগরণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। জীবন বা সত্তার মুক্তির পথে তখন ছিল নিরন্তর বাধা।
তবে মানুষ এক সময়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে এটাই শাশ্বত সত্য। আমি অনুভব করি, এ দেশের মানুষ দীর্ঘকাল পরাধীনতার গ্লানির মধ্যে বাস করেছে, কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতার তৃষ্ণা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তার ছায়া ফেলে গেছে। বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারায়ও সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে বারবার। বৃহৎ ভারতবর্ষের জনজীবনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। রাজনৈতিকভাবে পরাধীন ভারতবর্ষকে জাতিগত বিদ্বেষ ও মানবিক অধিকার বঞ্চিত অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য দাবি উচ্চারিত হয় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক সমাজ সংগঠনও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়ো’ এই স্লোগান থেকে ক্রমশ স্বাধীনতার আহ্বান সারা ভারতবর্ষে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দীর্ঘদিনের আন্দেলন, লাহোর প্রস্তাব ও সবশেষে দুটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭, ১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পায় পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ।
প্রথম কয়েক বছর স্বাধীনতার আনন্দে বিহ্বল মানুষ। অতীতের সব ব্যর্থতা মুছে ফেলে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে জীবনকে উজ্জ্বল সম্ভাবনায় গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলে। গভীর মমতায় মানুষ কাজে নামে। শিক্ষা, প্রযুক্তি, তথ্য, স্বাস্থ্য সব বিষয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।
এই গড়ে তোলার আনন্দে প্রথম ধাক্কা আসে ভাষার লড়াইয়ের মধ্যে। সে বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসে নিষ্ঠুর সত্য। ভাষার স্বাধীনতায় এই দেশটির জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। রক্তের দামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাতৃভাষার দাবি।
ক্রমশ বৈষম্য ও মতভেদ বেড়ে ওঠে দেশের দুই অংশের মধ্যে। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কি? বিষয়টি সমস্ত বিভেদকে স্পষ্ট করে তোলে। ক্ষোভ ও বিতর্ক বেড়ে ওঠে। গভীর বেদনায় মানুষ নিমজ্জিত হয় জটিল দ্বন্দ্ব বিক্ষোভে। ব্যক্তি ও সমষ্টির অসম ব্যবহার, নানা আন্দোলন পেরিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি এবার প্রবল হয়ে ওঠে। গ্রামগঞ্জ থেকে রাজপথ, কলকারখানা, বিদ্যালয়, অফিস-আদালত জুড়ে একই গণ-জাগরণ সৃষ্টি হয়। মওলানা ভাষানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত নেতা। জাতির আকাক্সক্ষা ‘স্বাধীনতা চাই’।
ইতিহাসের যুদ্ধ কণ্টকিত, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ঈর্ষা কলঙ্কিত সময় অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষ মুখোমুখি দাঁড়ালো এক অভাবিত ভয়াবহ সংগ্রামের।
আজ প্রতিটি দিন ও রাতের সেই ইতিহাস মনে করে শিহরিত হই।
এমন যুদ্ধ এর আগে কেউ দেখেছে কিনা জানি না। ২৬ শে মার্চ একাত্তর রাত ছিল ভয়াবহতম মরণযজ্ঞের আয়োজন। ঘুমন্ত মানুষ, পুলিশ ব্যারাক, রিকশাচালক, ছাত্রাবাসের ছেলেরা কেউ রেহাই পায়নি তার লেলিহান শিখা থেকে। অবশ্যই দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথ কদিন ধরেই উত্তপ্ত ছিল সে কথা ঠিক। কিন্তু আক্রমণ হলো সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে যা কেউ কল্পনাও করেনি। রক্তাক্ত, মূর্ছাহত নগর জীবন কারফিউয়ের বেড়াজালে বন্দী। ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপ থেকে সরানো হলো মানুষ। শহীদ মিনারের কামান বিধ্বস্তকারীর, শহরের প্রতি রাস্তায়, মোড়ে মোড়ে আগ্রাসী সৈন্যদের প্রহরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কামানের ক্ষত, মধুর ক্যান্টিনের মধুদা ও বেশ কিছু সম্মানিত শিক্ষক নিহত হন আগ্রাসী সৈন্যদের হাতে। রক্ত¯্রােত দেখে শিহরিত হয়ে মানুষ সরে আসে। এই আকস্মিক মারণযজ্ঞ কেন, বুঝতে পারে না। কারফিউয়ের দখলে খাঁ খাঁ করে রাজপথ। (ঝঢ়ধপব)
এভাবেই সংগ্রাম শুরু হয়। মানুষ ক্রমে ধাতস্থ হয়। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত একটি জাতি ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয় স্বাধীনতার লড়াই করার জন্য। বর্ডার পেরিয়ে প্রাণভয়ে ভীত শরণার্থীদের সাথে আমাদের বাহিনীর সদস্যরা, সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা দেশ ছেড়ে যুদ্ধে চলে যান। প্রতিবেশী দেশের সহায়তা ও সহানুভূতির সাহায্যে ছাত্র, যুবক ও অসামরিক মানুষেরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য দেশ ছেড়ে যায়।
নয়টি মাসের দুঃস্বপ্ন ভরা জীবন ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী, যারা দেশের ভেতরে আটকা পড়েছিল তারা জানত, প্রতি পাড়ে পাড়ে মৃত্যু তাদের জন্য ওত পেতে আছে। প্রতিটি ঘর থেকে কেউ না কেউ, ঘর ছেড়ে যুদ্ধে গেছে। সবাই কত চাতুরির সঙ্গে প্রতিদিনের দায়িত্ব পালন করতেন, আবার গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন তা ভাবতে আজও হৃদকম্প হয়। সেই করুণ মৃত্যু ছায়ায় কালো, দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কী করে যেন আমরা হয়ে উঠলাম যোদ্ধার জাতি।
আজ আমরা পৃথিবীর বুকে নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। আমাদের জীবনদৃষ্টি হয়েছে উদার। বিরাট বিশ্বের সদস্য হয়ে আমরা গর্বিত। ৪৫টি বছর ধরে এক ব্যাপক বিপুল কর্মযজ্ঞ রচনা করেছে এই দেশ।
আজ স্বাধীন দেশের গৌরব গাথা লেখার স্বপ্ন বুকে নিয়ে যখন আরও ভালো, আরও উন্নত জীবন ব্যবস্থার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন বিস্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে কার নিরবচ্ছিন্ন কান্নার ধ্বনি আমাকে চকিত করেছে? সেই প্রশ্নই আজ আমাকে তাড়িত করছে। বিগত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি মারাত্মক আকার নিয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি হত্যা, পিলখানা ধ্বংসযজ্ঞ, শিশুর প্রতি অমানুষিক অত্যাচার, গণধর্ষণ, শিশু হত্যার এমন সব ঘটনা ঘটছে যাতে মানুষ চমকিত ও আতঙ্কিত। গার্মেন্ট সেক্টরে দুর্ঘটনা প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। একের পর এক হত্যাকা- ঘটে চলছে যার সমাধান সহসা হতে পারছে না। মনে করছি একটি বিকাশমান সমাজে কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অনিয়ম লক্ষ্য করে আতঙ্কগ্রস্ত দেশের সাধারণ মানুষ। লক্ষ করে মনে হয় নৈতিক অবক্ষয় ও দায়বদ্ধতার অভাব আকস্মিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলছে। একদিকে দুর্যোগে, অত্যাচারে, পীড়িত মানুষকে একদল মানুষ চিকিৎসা ও সহায়তা দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে। অন্যদিকে হিংসা ও আক্রমন থেকে উপাসনালয়গুলোও রেহাই পাচ্ছে না। মাৎস্যন্যায় যেভাবে সমাজকে আক্রান্ত করে চলছে তেমনই নিষ্ঠুরতার চর্চাও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
অথচ একাত্তরের নিদ্রাহীন রাতগুলোয় সারা দেশে, পথে-প্রান্তরে কেবল রক্ত¯্রােত আর মৃত্যুর গন্ধ। আমাদের অপেক্ষা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের শব্দ কখন নৈঃশব্দ ছিঁড়ে জীবনের মুুক্তির গান শোনার জন্য। ভেবে দেখলে বিস্ময় জাগে, একাত্তর তো শুধু একটি যুদ্ধ নয়, সে ছিল আমাদের বিশ্বাস ও আশার প্রতীক। স্বাধীনতার জন্য সে ত্যাগ ছিল গোটা জাতির।
ইতিহাসের দীর্ঘ পথ চলতে চলতে এখন আমি দাঁড়িয়েছি। নিজেদের প্রতিবিম্বকে দেখছি। যত কঠিন বেদনাই হোক, একাত্তরকে সত্য বলে গ্রহণ করে হতে হবে এক জাতি, এক প্রাণ। সজাগ থাকতে হবে আমাদের। রক্তের প্লাবনে পাওয়া সবুজ বদ্বীপ, আমার মাতৃভূমি। বলতে হবেÑ
‘ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি?
এ তোমার এ আমার পাপ।’
এ থেকে মুক্তি পেতে হলে নতুন করে সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে তুলতে হবে পারস্পরিক সহনশীলতা, আশা ও সততার সঙ্গে। এই হোক স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।