ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
![img_img-1719405838](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1616685612_16.jpg)
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
এনায়েত রসুল
আনন ভাইয়া প্রতিদিন আমার কিছু না কিছু কেড়ে নিয়ে যায়। ভাইয়া যখন আমার খেলনা নিয়ে যায় তখন মা বলেন, ওটা আনন নিয়েছে নিক। তোকে আমি নতুন খেলনা কিনে দেব। কিন্তু নতুন খেলনা আর কেনা হয় না।
আমার অসহায় অবস্থা দেখে বাবা বলেন, আননটা আজকাল মেয়েটাকে খুব জ্বালাতন করে। ওকে শাসন করতে হবে। বাবার কথা শুনে মা বলেন, ওকে বলে লাভ নেই। আসলে তোমার মেয়েটা হয়েছে ছিঁচকাঁদুনে। পান থেকে চুন খসলেই কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তোলে। শাসন করতে হলে ওকে করো।
মায়ের কাছে এমন কথা শুনে বাবা নিজের কাজে চলে যান। ফলে আমার সমস্যা আমারই থেকে যায়।
দুই.
আপু আমাকে একটা খেলনাগাড়ি দিয়েছেন। সেই গাড়ি নিয়ে যখন খেলতে বসেছি তখন ভাইয়া বলল, গাড়িটা নিয়ে কাল সারারাত ভেবেছি। ভেবে বুঝতে পেরেছি, আপু গাড়িটা আমার জন্যই এনেছিলেন। ভুল করে তোকে দিয়েছেন। কারণ ছেলেরা গাড়ি নিয়ে খেলা করে আর মেয়েরা খেলে পুতুল নিয়ে। তাই গাড়িটা আমি নিয়ে গেলাম।
এ কথা বলে ভাইয়া সত্যি সত্যি গাড়িটা নিয়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে মাকে বললাম। সে কথা শুনে মা বললেন, পালিয়ে আর কোথায় যাবে! দু-একবার খেলে তোর গাড়ি তোকে ফিরিয়ে দেবে। আর একটা কথা তোকে মনে রাখতে হবে, ভাইয়েরা একটু এমনই হয়। বোনদের তা মেনে নিতে হয়। তোকে নিতে হবে।
মায়ের কথা শুনে আমি অবাক হলাম। কোথায় তিনি ভাইয়াকে গাড়িটাকে ফেরত দিতে বলবেন, তা না বলে আমাকে সব মেনে নেয়ার জন্যে বলছেন! না, আমি মেনে নিতে পারব না।
মায়ের ওপর আমার এতটাই অভিমান হলো যে, দুঃখে-কষ্টে আমি কেঁদে ফেললাম। তা দেখে বাবা বললেন, কাঁদিস না মা। কেঁদে কখনো অধিকার আদায় করা যায় না। অধিকার আদায় করতে হয় সংগ্রাম করে।
বললাম, বাবা! আমি কেমন করে সংগ্রাম করব, বল? ভাইয়া আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়। অথচ মা বলছেন ভাইয়ার কাড়াকাড়ি আমাকে মেনে নিতে হবে! বল বাবা, এটা অন্যায় নয়? এ অন্যায় মেনে নেয়া যায়?
বাবা বললেন, একেবারে মেনে নেয়া যায় না। সত্যি কথা বলব, আজকাল তোর মায়ের কথা শুনে আমার পাকিস্তান আমলের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় তুই যেন অসহায় পূর্ব পাকিস্তান, তোর ভাইয়া কেড়ে-টেড়ে নেয়ায় পটু পশ্চিম পাকিস্তান আর তোর মা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
: আর তুমি?
বাবা বললেন, আমি? আমার নিজেকে জাতিসংঘ মনে হয়। ক্ষমতাহীন এক নীরব দর্শক। যার কাজ শুধু বড়দের অন্যায় দেখে যাওয়া আর মাঝেমধ্যে নড়েচড়ে বসাÑ হা...হা...হা...
বাবা ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। কিন্তু আমার রাগ হলো। আমি বললাম, বাবা! তোমাকে তো নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকলে চলবে না। ন্যায়ের পক্ষ নিতে হবে।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, ন্যায়ের পক্ষই নেয়া উচিত। নইলে নিজের কাছে নিজেকে ছোট হয়ে যেতে হয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের সঙ্গে তুমি পাকিস্তান আমলের মিল খুঁজে পেলে কেমন করে? বুঝিয়ে বল।
বাবা বললেন, বলছি। তার আগে তুই বল, আমরা কোন্ দেশের নাগরিক?
একেবারে সহজ প্রশ্ন। তাই আমিও ঝটপট জবাব দিলাম, বাংলাদেশের।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন এই দেশটি চিরদিন স্বাধীন ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশটি তুর্র্কি, পাঠান, মোগল আর ইংরেজদের হাতে শাসিত হয়েছে। শেষমেশ শাসন করেছে পাঞ্জাবিরা। তখন আমাদের দেশটাকে বলা হতো পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ। আমাদের এই অংশটিকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান আর অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব ছিল দুই হাজার বিশ কিলোমিটার। এই বিশাল দূরত্বের জন্যে অনেক সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন ধর আমাদের ভাষা, আচার-ব্যবহার, সামাজিক রীতিনীতি আর খাবারদাবারের সাথে ওদের কোনো মিল ছিল না। এমনকি দৈহিক গঠনেও নয়। আমরা হালকা-পাতলা আর ওরা লম্বা-চওড়া বিশালদেহী। আমরা খাই মাছ-ভাত আর ওরা খায় রুটি-ডাল। এমন অনেক অমিল থাকার পরও ওরা মুসলমান আমরাও মুসলমানÑ এই ধর্মীয় বন্ধনের টানে ওদেরকে আমরা ভাই বলে মেনে নিয়েছিলাম। একসঙ্গে থাকব বলে কথা দিয়েছিলাম। তবে তার ফল হয়েছিল উল্টো। জানিস তো, আমাদের নদ-নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জমিগুলোতে হাজারো রকম ফসল ফলে। মাটির নিচে তেল, গ্যাস, পাথর-কয়লা আর সমুদ্র সৈকতে ইউরেনিয়ামের মতো সম্পদ রয়েছেÑ পশ্চিম পাকিস্তানে এসব ছিল না। তার ওপর চা আর পাট রফতানী করে ডলার-পাউন্ড রোজগার করতাম আমরাÑ ওরা তা পারত না। কারণ বিদেশে রফতানী করার মতো ওদের তেমন সম্পদ ছিল না, তাই ওরা আমাদের হিংসা করত। অফিস-আদালত আর সেনাবাহিনীতে ওরা বেশি লোকজন ঢুকিয়ে রেখে ছিল, সেই জোর খাটিয়ে আমাদের সবকিছু কেড়ে নিত। এ নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিযোগ করতাম। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হতো না। ওরা বলত, বাঙালিরা খেয়ে-পরে ভালো থাকবে আর আমরা না খেয়ে মরব, তোমাদের পকেটে ডলার-পাউন্ড ঝনঝন করবে আর আমাদের পকেট শূন্য থাকবেÑ তা হবে না। তোমরা-আমরা একই দেশের অধিবাসী। তাই তোমাদের সবকিছুর ওপর আমাদের অধিকার আছে। পাকিস্তানের দুই অংশকে মিলেমিশে থাকতে হবে।
: মিলেমিশে থাকার কথা বলত ওরা?
জিজ্ঞেস করলেন মা। বাবা বললেন, বলত। তবে কথাটা বলত শুধু নিজেদের স্বার্থ আদায় করার জন্য। স্বার্থ আদায় হয়ে গেলেই ওরা সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে শত্রুতা শুরু করত। ওদের শত্রুতা সইতে সইতে আমাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে গেছে, তখন আমরা অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছি। আমাদের সম্পদ আর পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে দেয়া হবে না, সে কথাটি জানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। উনিশশো সত্তর সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার পরও ওরা আমাদের হাতে শাসনভার তুলে দেয়নি। আজ দেব কাল দেব বলে ভুলিয়ে রেখে নিজেরা তৈরি হয়েছে আর একাত্তরের পঁচিশ মার্চ রাতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তখন আমরা বুঝতে পেরেছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে হবে। হয় দেশকে স্বাধীন করব নয়তো দেশের জন্য জীবন দেব। বাঙালিরা তাদের কথা রেখেছে। হাজারে হাজারে মরেছে, শত্রুদের মেরেছে আর একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
আমি বললাম, জানি বাবা। তাই ষোলই ডিসেম্বর আমরা বিজয় দিবস পালন করি। আর ছাব্বিশ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তাই ছাব্বিশে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস, তাই না বাবা?
বাবা বললেন, ঠিক তাই। তো মা, এ ইতিহাস থেকে তুই কি শিখেছিস, এবার সে কথা বল।
আমি বললাম, আমি শিখেছি, নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়, যেমন আমরা আদায় করে নিয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। পেয়েছি বাংলাদেশ।
আমার জবাব শুনে বাবা কিছু বললেন না। পরম মমতায় কাছে টেনে নিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।