Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার গান

প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবারক হোসেন খান
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশর জনগণের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ পরতে পরতে শেষ ধাপে পৌঁছেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের শুরু। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা ভাষার সূত্র ধরে ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ। পাকিস্তান নামের এক নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব। নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। ফলে বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষার দাবিতে স্লোগান তুলল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদাদানের দাবিতে রচিত হলো গণসঙ্গীত,
ভুলবো না, ভুলবো না, এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না,
লাঠি, গুলি আর টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি আর মিলিটারি
ভুলবো না।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ দাবিতে ধর্মঘট
বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথÑ
ভুলবো না।...
রাষ্ট্রভাষার দাবিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে নির্যাতন আর অত্যাচারের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হলো বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মাথানত করল না। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল। এলো ১৯৫২ সাল। বাংলা ভাষার দাবি আরো ক্ষুরধার হলো। এলো একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন ছাত্র জনতা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিল বের করল। সেই মিছিলে গুলি করে খুন করা হলো অস্ত্রহীন ছাত্র-জনতাকে। তরুণ প্রাণ শহীদ হলো। সেই আত্মঘাতী তরুণ শহীদদের নিয়ে রচিত হলো এক অমর গানÑ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি!
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবস এলেই স্মরণ করিয়ে দেয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা। কারণ মুক্তিযুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলন এক সূত্রে গাথা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে জীবনদান, একুশের চেতনা। আর মার্চ-ডিসেম্বরের মুক্তিযুদ্ধ দেশমাতৃকার মুক্তির চেতনা। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদ থেকে ভাষা আন্দোলনের শুরু। আর সেই আন্দোলনই জোরদার হয়ে কালের গতিতে একাত্তরে এসে রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলো জনগণের আন্দোলন। জনগণের আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রচিত হয় অসংখ্য দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো সঙ্গীত। বিশেষভাবে গণসঙ্গীত। গণসঙ্গীত হলো জনগণের গান। জনগণকে যে গান উদ্দীপনা জোগায় সে গান। গানের ভেতর দিয়ে জনগণের দাবি আদায়ের গান, বৃহত্তর অর্থে গণসঙ্গীত। এই গান জনগণের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। গণসঙ্গীত প্রচলনের কার্যকরণ আছে। আর সেই কারণটা হলো জনমানুষ বা জনগণ। জনগণকে বলা হয় শক্তির উৎস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে নয় মাস এ গানেরই প্রতিধ্বনী জনগণ শুনতে পেয়েছে।
দেশমাতৃকার বন্দনার জন্য যে গান সে গান দেশাত্মবোধক গান। এ গানের অনেক রূপ। উদ্দীপনা গান, জাগরণী গান, দেশপ্রেমমূলক গান, দেশের গান এমনি নামে এ গান বিশেষায়িত। দেশের প্রতি ভালোবাসা মানুষের জন্মগত অধিকার। এই অধিকার খর্ব হতে দেখলে দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রই বিদ্রোহ করে। তারা সমবেতভাবে সেই অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দেশের জন্য তখন তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। তারা এদেশেই জন্মেছে। এ দেশের আলো বাতাসেই বড় হয়েছে। তাই তারা জীবনে মরণে এ দেশের অকৃপণ দানের কথা ভুলতে পারে না। তাদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়,
ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে
আমার জীবন মরণে তোমায় চাই না ভুলিতে।
আমি তোমার তরে স্বপ্নে রচি আমার যত গান
তোমার কারণেই দেবো জীবন বলিদান।
ওগো জন্মভূমি মাগো মা!
ভাষা আন্দোলনের চেতনা মুক্তি-আন্দোলনে রূপান্তরের বাণী শুনিয়েছে। গান তাই সব আন্দোলনের প্রেরণা শক্তি। ভাষা আন্দোলনের মতোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্দীপ্ত রেখেছিল দেশের গান। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল দেশাত্মবোধক গান। গানের বাণী আর সুর যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের মন্ত্রে করেছিল উদ্বুদ্ধ। গেরিলা যোদ্ধাদের শত্রু নিধনে জুগিয়েছিল অপ্রতিরোধ্য শক্তি।
একাত্তরের পঁচিশ মার্চের রাত। বাংলার মানুষ তখন নিদ্রায় মগ্ন। হঠাৎ দেশজুড়ে শুরু হলো মৃত্যুর তা-বলীলা। গুলির গর্জনে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা জাগরিত হলো। মানুষের মৃত্যু চিৎকারে ভরে উঠল আকাশ-বাতাস। হঠাৎ মৃত্যুর ঝলকানি এলেও বাংলার মানুষকে ঘায়েল করতে পারল না হত্যাকারী পাক-বাহিনীর সেনারা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার একটা কঠিন অঙ্গীকার আগে থেকেই তৈরি ছিল মানুষের মনে। তাই মুহূর্তে ঘুড়ে দাঁড়াল জাতি। দুশমনের আঘাতের পাল্টা আঘাত হানলো বাঙালি সেনারা। প্রতিরোধ গড়ে তুলল দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। পরের দিনই গোপন বেতার থেকে ভেসে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা। শুরু হলো স্বাধীনতার যুদ্ধ। কোনো আপস নেই এই সংগ্রামে। মৃত্যুপণের যুদ্ধ। দেশকে স্বাধীন করার পণ সবার মনে। সমগ্র জাতির অন্তরে। যুদ্ধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ মুক্তি সেনাদের জন্য রচিত হলো গান। দেশ- মাতৃকার প্রতি নিবেদন হলো তাদের প্রাণ মন। স্বাধীনতার সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনার। সংগ্রামের রূপ পেল গানের বাণীতে ও সুরেÑ
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।
বাঁধন ছেঁড়া হয়েছে কাল
হয়েছে কাল হয়েছে কাল
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।
বাঙালি জাতির মনে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলছিল তাতে শত্রুর আগুনের ছোঁয়া লাগতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বাঙালি জাতি যে এক প্রাণ এক মন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তা প্রমাণ করল। একটাই মাত্র লক্ষ্য সংগ্রাম আর স্বাধীনতা। জনতার সংগ্রামই যে যুদ্ধজয়ের শক্তিশালী হাতিয়ার বাঙালি জাতি তা প্রমাণ করল মুক্তিযুদ্ধে। জনতার সেই শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রচিত হলো জনতার গানÑ
মুক্তির একই পথ সংগ্রাম
অনাচার-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, ঝঙ্কার হুঙ্কার
আমরণ সংগ্রাম প্রচ- উদ্দাম
সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম।
বায়ান্নর মূলমন্ত্রে দীক্ষিত এ দেশের মানুষ একাত্তরের নির্যাতন, অত্যাচার আর শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিল। আর নয়, এবার বিজয়ের যুদ্ধ। যুদ্ধ করেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায় করা হয়েছিল, তেমনি সংগ্রাম করেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তি এনেছিল। বাংলাদেশ পেলো একটি দেশ একটি ভাষা।
সব বাধা-বিপদ অতিক্রম করার দৃঢ়তা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে বাংলার মানুষ। হয় মৃত্যু, নয় জয়। যুদ্ধের মহাসমুদ্র যত উত্তাল হোক না কেন সেই উত্তরঙ্গ সাগর পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার বিজয় তারা আনবেই। তাই তাদের কণ্ঠে যুদ্ধরূপ সাগর পাড়ি দেওয়ার সংকল্পের গানে তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হলোÑ
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দেব রে।
আমরা কজন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি শক্ত করে রে।
শত্রুসেনার ব্যূহ ভেঙে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাক-সেনাদের শিবির শতধা বিছিন্ন। তাদের মনোবল ধূলায় লুণ্ঠিত। শেষ আঘাত হানার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত। তারা মুক্তির দুয়ার খোলার জন্য অগ্রযাত্রার আহ্বানে কণ্ঠে সুর তুললÑ
নোঙ্গর তোলো তোলো
সময় যে হলো হলো
নোঙ্গর তোলো তোলো।
শত্রু পরাজিত। বিজয় মুষ্ঠিবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের অবসান। মনে আনন্দের হিল্লোল। বিজয়ের নিশান উড়ছে। স্বাধীনতার সূর্যটা নিশানের মাঝখানে আলোর ছটা ছড়াচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিজয়ের গান জোয়ারে ভেসে এলো,
বিজয় নিশান উড়ছে ঐ
খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে
বাংলার ঘরে ঘরে
মুক্তির আলো ঝরছে।
মুক্তিযুদ্ধের যে গান যোদ্ধাদের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদ্দীপিত করেছে, বাংলার মানুষের নৈতিক বলকে সমুন্নত রেখেছে, সে গান দেশমাতৃকার গান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আকাশের তরঙ্গে সে গান ভেসে গেছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, সে গানের সুর সমগ্র জাতিকে গেঁথে রেখেছিল এক সূত্রে। সে গান দেশকে ভালোবাসার মন্ত্র। সে গান স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেল। সে গান বাংলার জনগণের হৃদয়ের গান, সে গান দেশকে ভালোবাসার গান, সে গান জনগণের ‘সোনার বাংলা’র গান ও মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার গান, আমাদের স্বাধীনতার গানÑ
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।।
ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায় হায় রেÑ
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার গান
আরও পড়ুন