ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
ম. মীজানুর রহমান
নজরুলের কাব্য-সাহিত্য ও গান বিশ্লেষণ করে দেখলে নজরুলকে দলগত কিংবা ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো রাজনৈতিক বিদ্রোহী দল গঠন করেননি। অথবা কোনো বিদ্রোহী কিংবা সন্ত্রাসী দলে যোগ দেননি। এমন কি তার সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মুজফর আহমদের সংস্পর্শে থেকেও তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি।
যদিও নজরুল তাত্ত্বিক বা দার্শনিক হিসেবে গণ্য নন, কিন্তু তার সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, বারাঙ্গনা, নারী, কুলি-মজুর প্রভৃতি কবিতায় সুস্পষ্টভাবে অভেদ মানবতত্ত্ব এবং সাম্যবাদী চৈতন্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মানবিক সংশোধনের প্রাচুর্যই বড় বেশি চোখে মেলে। তার নান্দনিক কাব্যিক শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে প্রচ- অভিমান ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে তাকেই সম্ভবত বিদ্রোহ বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু তার রচনাসমগ্র বিশ্লেষণ করলে যে জিনিসটি চোখে পড়ে তা হচ্ছে একাধারে তার বিদ্রোহের উন্মাদনা তৎসঙ্গে অন্যধারে প্রেমের অবাধ্য আকুতি। আর এই প্রত্যয়ে তাকে বিদ্রোহী বলার চেয়ে প্রচ- আত্মাভিমানী বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। এই যে পরস্পরবিরোধী দ্বৈত অবস্থানের চৌম্বিকতা একপর্যায়ে একই বলয়ে অগ্রসরমান তা লক্ষ্যণীয় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। যেমন,
আমি চির দুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!...
আমি দুর্বার/আমি ভেঙে করি সব চুরমার।/আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,/ আমি দলে যাই যত বন্ধন,/ যত নিয়মকানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি না’ক কোন আইন...
বৃটিশরাজের আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় রাজা-প্রজার এতই ব্যবধান যে সাধারণত রাজার সম্মান ছিল ঈশ্বরেরই সমকক্ষ তৎসঙ্গে রাজকর্মচারীরা নিজেদেরকে রাজার প্রতিভূ অর্থাৎ জনগণের তথা প্রজার প্রভু বলে মনে করত নিজেদের আর তাদের আচার-আচরণও ছিল রাজন্যবর্গসুলভ। নজরুল এই অবস্থানকে কটাক্ষ করে লিখেছেন সেই কথাগুলো এবং উপসংহারে ঘোষণা করেছেন গণতন্ত্রের জয়,Ñ
বন্ধু, এমনি হয়-/ জনগণ হ’ল যুদ্ধে বিজয়ী রাজার গাহিল জয়!
প্রজারা যোগায় খোরাক- পোশাক, কি বিচার বলিহারি,
প্রজার কর্মচারী নন তাঁরা রাজার কর্মচারী!
মোদেরি বেতনভোগী চাকরেরে সালাম করিব মোরা,
ওরে পাবলিক সার্ভেন্টদের আয় দেখে যাবি তোরা!...”
অতঃপর নজরুল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন,
“-এ আশা মোদের দুরাশাও নয়,
সেদিন সুদূরও নয়,
সমবেত রাজ-কণ্ঠে যেদিন শুনিব প্রজার জয়।”
মূলত নজরুল বিদ্রোহী কবি। তার বিদ্রোহ ছিল সমাজের ও রাষ্ট্রের সব অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আর সেই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই তার স্বাধীনচেতা হৃদয়ের আগুন প্রজ্বলিত হয়েছিল আপন পরাধীন দেশের স্বাধীনতা কামনায়। এমন সরাসরি স্বাধীনতার প্রবক্তা হওয়া তার আমলের আর কোনো কবির পক্ষে সেকালে সম্ভব হয়নি। জমিদার-নন্দন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সাহস করেননি প্রভু ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হবেন এমন কোনো কথা উচ্চারণ করার। অথচ বিশের দশকে যখন নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা বের করেছেন তখন সংবাদপত্রে “স্বাধীনতা”র কথা বলা রীতিমতো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে কংগ্রেসের জাঁদরেল নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে অটোনমি বা স্বায়ত্তশাসন আর সেলফ গভর্নমেন্টের কথা বললেন, অরবিন্দও তাই বলেছিলেন, আর স্বয়ং এম, কে, গান্ধীও বলেছিলেন, ডোমিনিয়ন স্টেটাস পেলেই তিনি বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক উড়াবেন (১৯২২), অথচ ১৯২১ সালের শেষ সপ্তাহে আহমেদাবাদে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে প্রখ্যাত ঊর্দু কবি ফজলুল হাসান হসরৎ মোহানী তার বক্তব্যে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু করা হয়। একটি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২৪-এ ধারা রাজোদ্রোহের আর অন্যটি ১২১ ধারা মতে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। প্রথমটার শাস্তির মেয়াদ যাবজ্জীবন কারাদ- আর পরেরটার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-। এ মামলার রায় বেরিয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ই জুলাই। এসব জেনেশুনেও নজরুল ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর তার সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার ১ম বর্ষ ১৩শ সংখ্যায় “ধূমকেতুর পথ” প্রবন্ধে লিখলেন,
“সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বোঁচকা পুটুলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষে করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।”
তৎকালের সংবাদপত্রে এমন দুঃসাহসিক স্বাধীনতা ঘোষণার উচ্চারণ, বোধ করি ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তবে নজরুলের সাহিত্যে দুনিয়ার সকল বঞ্চিত ব্যথিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আপসহীন সংগ্রামে ছিল অবতীর্ণ। স্বাধীনতা বা মুক্তি প্রতিটি মানুষের অধিকার সমন্বিত। নজরুল লড়াই করেন সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়। আর তা বড়ই সহজ সরল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দ্বীপান্বিত। ধনবাদী শাসন শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার মসি ছিল অসির চেয়েও ধারালো। ইসলামে ভোগের চেয়েও ত্যাগ হচ্ছে মোক্ষম কিন্তু এখনকার ভোগবিলাসী মানুষেরা মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে, সত্য পরিহার করে ক্ষুদ্র স্বার্থে এতই প্রমত্ত যে সে মানবিক ভালোবাসার কথাও ভুলে যায়। অমানবিক ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থে এমন কোনো অপরাধ নেই যে সে স্বার্থান্ধের মতো করে না। যার জন্যে এত যুদ্ধ দ্বন্দ্ব সংঘাতে জর্জরিত বিশ্ববাসী। নজরুল নিঃস্বার্থ সাম্যবাদের আলো জ্বালিয়ে জগতে আনতে চেয়েছিলেন আলোকিত জ্ঞানবান সাম্যবাদী মানুষ যার লড়াই হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যেখানে মানুষের জ্ঞানালোকিত স্বাধীনতা থাকবে অবাধ ও পক্ষপাত বিবর্জিত। যেখানে অন্যায়ের কণাটুকুও ঠাঁই পাবে না মনুষ্যত্বের আধারে। নজরুলের সাম্যে ধর্ম-বর্ণ শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থায় সব মানুষ সমান, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য নেই, যেখানে ধর্মের ব্যবধান নেই, কোনো বিভেদ নেই বর্ণের।
গাহি সাম্যের গানÑ
বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ।
বন্ধু এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র ধনী,
হেথা পায় নাক’ কেহ খুদ ঘাঁটা, কেহ দুধ-সর-ননী।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ, নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেস্ত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাতে রেখে মিলিয়াছি ভাই ভাই।
নাইকো এখানে ধর্মের ভেদ, শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদ্রী-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা হিন্দু ও মুসলমান যদি একতাবদ্ধ হয়ে একদেহে একই স্বার্থে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাহলে বৈরী অমানবিক শক্তি নস্যাৎ হতে বাধ্য। তাই তিনি গান বাঁধলেন, “কা-ারী হুঁশিয়ার”
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীতে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার ॥
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী শান্ত্রীরা সাবধান।
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কা-ারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
(সর্বহারা-অংশবিশেষ)
বিদেশি শত্রুর মোকাবেলা করতে হলে চাই জাতির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। তাই স্বাধীনতার পক্ষে নজরুল চান সমগ্র জাতি তথা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ঐকান্তিক মিলন। ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কৃষ্ণনগরে (এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা) অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে নজরুল সামরিক কায়দায় যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন তাদের সমবেত কণ্ঠে উদ্বোধনী বৃন্দসঙ্গীত ছিল এটি।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অবধি যে মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল বাংলাদেশে তাতে নজরুলের এইরূপ যাবতীয় দেশাত্মবোধক গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জুগিয়েছিল মহাপ্রেরণা। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের এই মহাঅবদান জাতি মহাশ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রতিটি বিজয় দিবসে। আজ বিজয় দিবসে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবদানের কথা বলছি তখন তার মানবতাবাদের কথাও বলতে হয়। তাকে আমরা আমাদের জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়েছি তখন সেই মহান কবির জীবন-দর্শনের কথা কি আমরা মনে করি? মানুষ কেন আজ দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র লাঞ্ছিত শোষিত অধিকার-বঞ্চিত হতদরিদ্র অপমানিতÑ এসব দুঃখবোধ কি আমাদের মনে জাগ্রত? তার সাম্যের গান কি আমরা গাই না বুঝিÑ
গাহি সাম্যের গানÑ
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি;
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
আমাদের সুমতি হোক আমরা যেন আমাদের জাতীয় জীবনে নজরুলের সুন্দর সত্য সাম্য আদর্শ-উপজীব্য করে বাঁচতে শিখি, মানুষকে ভালোবাসতে শিখি, মানুষের অধিকারকে লাঞ্ছিত না করে যথার্থ সম্মান দিতে শিখি, তবেই আমরা স্বাধীন জাতি বলে হব গৌরবান্বিত।
লেখক : প্রবন্ধকার, কবি, অনুবাদক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।