পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘আদার বেপারীর জাহাজের খবর’! এটি বহু পুরনো প্রবাদ-প্রবচন। কথাটার মানে হলো- জাহাজের বড়সড় কাজ-কারবার সম্পর্কে ছোটখাট আমজনতার খবর নেওয়াটা মানায় না! সত্যিই তাই। জাহাজের জগৎ সুবিশাল। হরেক রকম পণ্যসামগ্রী বোঝাই করে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশ-মহাদেশে ছুটে চলে জাহাজবহর। যুদ্ধ জাহাজবহর সাগর-মহাসাগরকে করে তুলেছে রণক্ষেত্র অথবা মহড়ার ক্ষেত্র। আবার নিজ দেশের এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে নোঙর ফেলে অভ্যন্তরীণ কার্গোজাহাজ, লাইটার, ফিডার, ট্যাংকার, ট্রলার, বার্জ, টাগ প্রভৃতি। আরও আছে ফেরি, পল্টুন, ফ্লোটিং জেটি-বার্থ। পৃথিবীর এক ভাগ মাত্র স্থল। আর তিন ভাগই পানিসীমা। বিশাল বিস্তীর্ণ পানির মহারাজ্য আজও বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে এক অপার বিস্ময় ও অনেকটাই অজানা রহস্য। নদ-নদী, সাগর-মহাসাগরকে জীবনধারণ তথা অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে মানুষ কাজে লাগানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে সেই প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকেই।
পণ্যসামগ্রী বিনিময়, সংস্কৃতি-সভ্যতা ও শিক্ষার আদান-প্রদান, জনবসতি, পরিভ্রমণ ইত্যাদি অনেক প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই মানবজাতি এক দেশ থেকে ভিন দেশে পাড়ি জমিয়েছে ‘কিস্তি’, নৌযান, জাহাজযোগে। আজকের বাংলাদেশসহ সমগ্র এই অঞ্চলে সভ্যতা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে সুদূর অতীতকালে প্রধান নিয়ামক শক্তি ও বাহন হিসেবে কাজ করেছে সেই পালতোলা জাহাজবহর যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের আগমন আর মেলবন্ধনে। খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে ১১তম শতক অবধি এই উপমহাদেশে আরবের সুফি-আউলিয়া-দরবেশ, পরিব্রাজক ও বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করে। তারা আগমন করেন পালতোলা সামুদ্রিক জাহাজবহরে। ফলে সমুদ্রপথ এবং সমুদ্রগামী জাহাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বসভ্যতা, অর্থনৈতিক উন্নতি, কর্মসংস্থান ও মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাসক্রম।
আবহমানকালের নদীমেখলা সাগরকুন্তলা বাংলাদেশের রূপ-নিসর্গ চিরায়ত। এদেশে মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখÑদুঃখ, সৌভাগ্য কিংবা ভাগ্য বিপর্যয়ের অনেককিছুই তার এই স্বতন্ত্র ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথেই মিশে আছে। সঙ্কটে অথবা আনন্দে মানুষের সাথে নদ-নদী ও সাগরের মিতালী হাজার বছরের। বাংলাদেশ শুধুই নয়। সারাবিশ্বে ৯৪ শতাংশ মানুষের অর্থনীতি, জীবিকাসহ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মূল নিয়ামক উপাদান সাগর-উপসাগর, মহাসাগর এবং তাদের সাথে যুক্ত হাজার হাজার নদ-নদী ও হ্রদ। মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, আয়-রোজগার, পুষ্টির উৎস, পরিভ্রমন-পর্যটন, পণ্যসামগ্রী পরিবহন ছাড়াও গোটা অর্থনীতির বিরাট অংশ দখল করে নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর ও তার অবারিত অববাহিকা। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরকে এক পাশে কোলে ঘেঁষে রেখে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য নদ-নদীঘেরা বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক ভৌগোলিক এবং ভূ-কৌশলগত অবস্থানে আছে। এই বহুমুখী সম্ভাবনাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি কখনোই। অনেক দেশের সফল মডেল অনুসরণ এবং উপকূলবাসীর বাস্তব কঠিন জীবন থেকে নেয়া হাজারো অভিজ্ঞতাকে যদি কাজে লাগানো হয়, তাহলে কক্সবাজারের টেকনাফ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ‘এলিফেন্ট পয়েন্ট’ থেকে শুরু করে খুলনার ‘হীরণপয়েন্ট’ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র উপকূল তটরেখা এবং দেশের ভাটি অঞ্চলের দক্ষিণভাগ জুড়ে ১৮শ’৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদ-নদী অববাহিকা কোটি কোটি মানুষের জীবিকার সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে প্রান্তিক জনগণের বেকারত্ব, জীবনযাত্রার টানাপড়েন ও পশ্চাৎপদতা ঘুচে যেতে পারে। ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কর্মমুখী কোটি মানুষ ও তাদের পরিবার।
অথচ হাজার বছর আগে এদেশের মানুষের সমুদ্র ও নদ-নদী উপকূল আর অববাহিকাকে ঘিরে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ছিল। মানুষ কেউই গরীব ছিল না। ঘরে ঘরে আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। বঙ্গোপসাগর উপকূল ও নদী অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল হরেক হরেক কৃষি-খামার, শিল্প, নির্মাণ ও মেরামতি কাজের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, আমদানি-রফতানি, সওদাগরী বাণিজ্য। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কাগজ শিল্প, চিংড়ি, লবণ, পান, জাহাজ ও নৌযান নির্মাণ, মেরামত শিল্প, সামুদ্রিক মৎস্য ও শুঁটকি মহাল ইত্যাদি। বঙ্গোপসাগরের প্রায় সোয়া ১ লাখ বর্গ কিমি আয়তনের বিশাল এলাকাটি বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক জোন (ইইজেড)। এর কিনারভাগে কোটি কোটি মানুষের আয়-রোজগারের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ অতীতে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল মসৃণ, সমৃদ্ধ। কিন্তু আজ অনাদরে-অবহেলায়, অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশ ও জাতি সমুদ্র এবং উপকূলের বিশাল স্থলভাগে ছড়িয়ে থাকা সম্পদরাজি ও তার প্রাকৃতিক অবকাঠামো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। বরং পিছিয়ে পড়েছে দিনের পর দিন।
বঙ্গোপসাগর উপকূল, নদ-নদীমালা, বিস্তীর্ণ অববাহিকা এবং সাগরবিধৌত উপত্যাকা, টিলা-পাহাড়ঘেরা সবুজ শ্যামল আদি চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, খুলনা অবধি অঞ্চলটি প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল সমৃদ্ধশালী। ‘ইরাইথ্রিয়িন-সি’ তে চট্টগ্রামের বর্ণনা মতে, একটি নিরাপদ, সুবিন্যস্ত, শান্তিপূর্ণ ও ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় তথা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে চট্টগ্রামের গোড়াপত্তন হয় দুই হাজার বছর পূর্বে। আজকের স›দ্বীপ-হাতিয়া পর্যন্ত তা ক্রমবিকাশ লাভ করে। ব্যাবিলিয়ন সাম্রাজ্য, ইয়েমেনীয় এবং আরব্য বণিকেরা, গ্রীস, মেসিডোনিয়াসহ পূর্বের জাভা, সুমাত্রা, মালয়, চীন থেকে বণিকরা বাণিজ্যতরী নিয়ে নিয়মিতই আসতেন। তারা খুব স্বাচ্ছন্দ সহকারে এই উপমহাদেশের সুরাট, কোচিন, তাম্রলিপ্ত ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সাথে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। বিখ্যাত মিশরীয় ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী চট্টগ্রামকে নিকট প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জন্য সর্বাপেক্ষা সুন্দর শহর হিসেবে বর্ণনা করেন।
মালয়ী ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে ‘দারুচিনি, লবঙ্গের দেশ’ খ্যাত মালয়-অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের ছিল সেতুবন্ধন। ফাহিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইব্নে বতুতার মতো প্রাচীনযুগের বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজকদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চল পৃথিবীর সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সওদাগরী বাণিজ্যের ছিল খুবই আকর্ষণীয় কেন্দ্রস্থল। চীন, তুর্কীস্থান, আরব এবং পর্তুুগীজ ও ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকেই পছন্দ করতেন। এই বন্দরের খ্যাতি ও কদর ছিল সুদূর অতীতেও দুনিয়াজোড়া। চট্টগ্রাম নামটির আরবী শব্দ ‘সেৎগান’। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ- গঙ্গা অববাহিকা থেকে যে অঞ্চলটির উৎপন্ন। আরবের মুসলমান বণিকেরা চট্টগ্রামকে তাদের মুখ্য বন্দর হিসেবে বিবেচনা করতেন।
অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে ও দেশের উপকূলের অনেক জায়গায় বাণিজ্যতরী তথা পালতোলা জাহাজ ভিড়িয়েছেন। নবম শতাব্দীতে এ বন্দরের নাম দেন ‘সামুন্দা’। ১৫২৮ সালে পুর্তগীজ নাবিকেরা সঠিকভাবেই এটাকে ‘পোর্তে গ্রান্ডে’ রূপে চিহ্নিত করে। যার অর্থ ‘মহাবন্দর’। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের শুরুতেই চট্টগ্রাম বন্দর ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দরের মর্যদায় অধিষ্ঠিত হয়। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতা বন্দরকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল। কালক্রমে উপমহাদেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রিটিশ ভারতের সিংহভাগ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধার ফলে চট্টগ্রামকে ঘিরে হাজারো ব্যবসায়িক কর্মকান্ড প্রসারিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে জাহাজ-শিল্প ভিত্তিক হরেক ব্যবসায় একই সাথে জাহাজ নির্মাণের ব্যবসা-বাণিজ্য ধাপে ধাপে জমজমাট রূপ লাভ করে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই। যা আজ কোনোমতে টিকে আছে ঐতিহ্যের পথ ধরে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।