বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া এবং রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা কর্মীদের প্রবেশাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব পাস হয়েছে।
প্রস্তাবে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।
আজ নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা(ওআইসি) উত্থাপিত প্রস্তাবটি ভোটাভুটির মাধ্যমে পাস হয়েছে। প্রস্তাবের পক্ষে ১২২ ভোট ও বিপক্ষে ১০ ভোট পরেছে। এছাড়া ২৪টি দেশ ভোট দানে বিরত ছিল।
প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার ছাড়াও রয়েছে চীন, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, লাউস, ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, বেলারুস, সিরিয়া ও জিম্বাবুয়ে।
এর আগে প্রস্তাবটি জাতিসঙ্ঘ সাধারন পরিষদের থার্ড কমিটিতে পাস হয়েছিল। এতেও বিপুল ভোটে তা পাস হয়। সাধারন পরিষদের বাজেট কমিটির কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ থামছেই না। বিভিন্ন সীমান্ত ছাড়াও রাতের অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া নোম্যান্স ল্যান্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।
শুক্রবার রাখাইন থেকে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফের হারিয়াখালী ত্রাণকেন্দ্রে আসেন রাখাইনের মংডু শহরের নলবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন। তিনিসহ কয়েকজন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাহাড়ে লুকিয়েছিলেন। কিন্তু খাওয়ার মতো কিছু ছিল না। পানি ছাড়া কোনো খাদ্যসামগ্রী নেই রাখাইনে।
মোহাম্মদ আমিন বলেন, দংখালী চরে তাঁবু টাঙিয়ে প্রায় ১৫ দিন মানবেতর জীবন-যাপন করেছি। বুধবার রাতে নৌকায় করে টেকনাফের খোরেরমুখ খাল দিয়ে সাগরপথে ঢুকে পড়ি। বেড়িবাঁধের পাশে এক দিন অবস্থান করার পর গত শুক্রবার এই ত্রাণকেন্দ্রে চলে এসেছি। আমাদের নৌকায় শিশু, নারীসহ ১৪ জন ছিল। একই গ্রামের আমান উল্লাহ বলেন, এত দিন রাখাইনেই আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু এখন আর সেখানে থাকার সুযোগ নেই। পাশের পুকুরের পানিও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলে আসতে হলো।
গত শুক্রবার ৩২টি পরিবারের ১৩০ জন রোহিঙ্গা টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের হারিয়াখালীতে সেনাবাহিনীর ত্রাণকেন্দ্রে আসে। এ ছাড়া বিগত এক সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে।
আমিনা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, যেসব রোহিঙ্গা সে দেশে রয়ে গেছে তাদের দেশ ছাড়ার জন্য হুমকি ধমকি দেয়া হচ্ছে। সেখানে এখনো নির্যাতন থামেনি। তিনি আরো জানান, তার বাড়ি বুচিডং বাঘগুনা পাড়া গ্রামে। তার স্বামীর তিন একর জমি ছিল। সেই জমিতে ধান চাষ ও পানের বরজ করে সুখের সংসার চলত। কিন্তু এখন সেনারা রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। কেউ খাবারের সন্ধানে বের হলে তাদের হত্যা করছে। অবরুদ্ধ করে রাখায় তাদের মজুদ খাবার শেষ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
সাবরাং হারিয়াখালীতে সেনাবাহিনীর ত্রাণকেন্দ্রে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি মো: দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিগত এক সপ্তাহে নাফ নদী পেরিয়ে ও বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নতুন করে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে।
৮ লাখ ৯১ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন : উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনকার্যক্রম চলছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আট লাখ ৯১ হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরসি) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আসা মিয়ানমার নাগরিক ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ জন। গত ২৫ আগস্টের আগে এখানে অবস্থান করা মিয়ানমার নাগরিক সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৬০ জন। তিনি বলেন, প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত থাকায় এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি নিবন্ধনের কাজও দ্রুত চলছে।
বাংলাদেশ পাসপোর্ট অ্যান্ড ইমিগ্রেশনের উপপরিচালক আবু নোমান মোহাম্মদ জাকের হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আট লাখ ৯১ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে।
এনভিসি না নেয়ায় নির্যাতন ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ অব্যাহত : নির্যাতন-নিপীড়নে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে সমঝোতা চুক্তি ও যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পরও রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে আগুন দিচ্ছে সেনাবাহিনী। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে শুরু হওয়া সেনা তাণ্ডব এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে আগের মতো রোহিঙ্গাদের গণহত্যা না করলেও আটক বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, অবরোধ ও শারীরিক নির্যাতন থামায়নি সেনারা।
গত চার মাসে রাখাইনে লক্ষাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
সূত্র জানিয়েছে, সেনা তাণ্ডবের মুখেও যেসব রোহিঙ্গা আরাকানে রয়ে গেছে, তাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে সৈন্যরা। বিশেষ করে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নামের অভিবাসন পরিচয়পত্র না নেয়ার অজুহাতে তাদের মারধর, জীবিকার পথ রুদ্ধ করা, যৌন হেনস্থা, ধর্মীয় ব্যাপারে মানহানিকর কথা বলা এবং পবিত্র কুরআন ও মসজিদের অবমাননা করছে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মীরা।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনীর বুচিডং জেলার ৫৫১ নম্বর ব্যাটালিয়ানের সদস্যরা প্রতিদিন আগুন দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে। এনভিসি না নেয়া, দাবিকৃত চাঁদা না দেয়া, হাটবাজারে যাতায়াতসহ বিভিন্ন কারণে দোষারোপ করে রোহিঙ্গা বাড়িতে আগুন দেয় সেনারা।এ ছাড়া প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনও করছে।
গত বুধবার রাতে রাচিডং এলাকার সিন্দকের পুঁইছড়িতে একটি বড় বাড়িতে আগুন দেয় সৈন্যরা। বাড়ির মালিক হামিদ হোসাইন বিন এজাহার বলেন, এনভিসি না নেয়ার অভিযোগে আমার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সেনারা। কিন্তু আমি এত টাকা দিতে না পারায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা আমার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
রোহিঙ্গা সূত্র আরো জানিয়েছে, প্রতিদিনই বুচিডং, মংডু ও রাচিডংয়ের উপকূলীয় এলাকার রোহিঙ্গা জেলেদের নৌকা জব্দ ও ঘাট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। জেলেরা এনভিসি নিলে পরিস্থিতি আবারো স্বাভাবিক করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা।
এদিকে বুচিডংয়ের বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রামে নিয়মিত তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ, বিজিপি ও সেনাবাহিনী। এনভিসি না নিলে মংডুর চেয়ে অবস্থা খারাপ হবে বলে রোহিঙ্গাদের হুমকি দেয় পুলিশের এক কর্মকর্তা। এ ছাড়া বারিজাপাড়া এলাকায় তিনজন রোহিঙ্গা এনভিসি নিতে না চাইলে তাদের ধরে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে সৈন্যরা।
এনভিসিতে রোহিঙ্গাদের বাঙালি এবং বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসী হিসেবে পরিচিতি লিপিবদ্ধ করার কারণে রোহিঙ্গারা তা নিচ্ছে না। ফলে প্রশাসন তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।