Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালিয়াজুরীর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ভর্তুকি সুবিধা থেকে বঞ্চিত

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ

| প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ : দু’দফা আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বছরের একমাত্র বোরো ফসলের ক্ষতি হওয়ার পর সরকারী পর্যায়ে কৃষকদের সহায়তা দেয়ার জন্য ত্রাণ ও কৃষি ভতুর্কি কার্ড বিতরণ কঠোর ভাবে মনিটরিং না করায় নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় করণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এবং মে মাসের প্রথম দিকে অব্যাহত বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ হাওর তলিয়ে আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের কৃষকের সারা বছরের একমাত্র বোরো ফসল সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। এরপর পাকা ধান পচে পানি দুষিত হয়ে মাছের মড়ক দেখা দেয়। ফসল ও মৎস্য সম্পদ হারিয়ে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা সারা বছর পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে তা নিয়ে হাহাকার শুরু হয়। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের মানুষকে দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ সচিবরা গত ১৮ই মে খালিয়াজুরীতে ছুটে আসেন। সে সময়ে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এই উপজেলার মোট ক্ষতিগ্রস্ত ২৪ হাজার ৯শ ৪৫ জন কৃষকের মধ্যে ১৯ হাজার কৃষককে প্রান্তিক কৃষক ঘোষণা করেন। সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, আগামী ফসল না উঠা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫ শত টাকা করে বিতরণের পাশাপাশি কৃষি পূণর্বাসনের লক্ষ্যে কৃষি ভর্তুকি দেয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর মনিটরিং না থাকায় কতিপয় সুবিধাভোগী ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণ ও কৃষি ভর্তুকির কার্ড বিতরণে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি ও দলীয় করণের কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা এই সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠলেও সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সেই সব অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে দৃশ্যমান কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে বঞ্চিত কৃষকদের অভিযোগ।
সময়ের পরিক্রমায় আবারো বোরো ফসল চাষাবাদের সময় চলে এসেছে। ক্ষতিগ্রস্থ অনেক কৃষক পরিবার দুবেলা দুমুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য এরই মধ্যে হালের গবাদিপশু সহ অন্যান্য সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এত কিছুর পরও ক্ষতিগ্রস্থ হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘরে খাবার ও চাষাবাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা হাতে না থাকলেও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ আর সরকারের কৃষি ভর্তুকি নিয়ে আবারো কৃষি কাজ করে সংসারের চাকা সচল রাখতে চায় তারা। হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কৃষি ভর্তুকির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও তারা প্রয়োজনীয় কৃষি ভর্তুকি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। অর্থ আর দলীয় করণে কারণে কৃষি ভর্তুকির কার্ড চলে যাচ্ছে সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে। অন্যদিকে বোরো ধানের কৃত্রিম বীজ সঙ্কটের কারণে সময়মত বীজ বপণ করতে পারছেন না প্রান্তিক চাষীরা। এছাড়াও সরকার নির্ধারিত বোরো ধানের ডিলারের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কারসাজির মাধ্যমে চড়া দামে বীজ বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। হাওরাঞ্চলে একদিকে চরম খাদ্য সংকট অন্যদিকে কৃষি উপকরণ কিনতে চড়া সুদেও ঋণ পাচ্ছেন না কৃষকরা। তবুও শেষ সম্ভল বিক্রি করে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে ব্যস্ত হচ্ছেন তারা।
খালিয়াজুরীর উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের ইছাপুর গ্রামের কৃষক বাবুল সরকার জানান, ‘৪ আড়া (৬৪ কাটা) জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলাম, বন্যায় এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারিনি। সহায় সম্বল সব বিক্রি করে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। এখন আর সংসার চলাতে পারছি না। সরকারি সহযোগীতা আসলেও কোনও ত্রাণের কার্ড পাইনি। পাইনি কৃষি ভুর্তুকির কার্ডও। নেত্রকোনা জেলা সার বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য জেলা কৃষকলীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার জানান, ‘জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কৃষকদের কাছ থেকে জেনেছি ডিলাররা অতিরিক্ত দামে বীজ বিক্রি করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিলাশ চন্দ্র পাল এসব অনিয়ম জেনেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি স্বাগত সরকার শুভ জানান, সরকারী তদারকি বাড়ালে কৃষকরা বঞ্চিত হবে না। মনিটরিং বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক ভাবে ভর্তুকি বিতরণেরও দাবী জানান তিনি।
খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের সার-বীজ ডিলার এবং ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি যতীন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে কৃত্রিম বীজ সংকট দেখিয়ে অতিরিক্ত দামে বীজ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের পর স্থানীয় প্রশাসন দাঁড়িয়ে থেকে বীজ বিক্রি করেছেন। তবে এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন সীলা বীজ ডিলারের স্বত্তাধিকারী যতীন্দ্র সরকার। খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লোকমান হাকিম জানান, মেন্দিপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য চন্দন সরকারের বিরুদ্ধে কৃষি ভর্তুকি কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি, তাকে ডেকে সর্তক করে দেয়া হয়েছে। খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি অফিসে কৃষি ভর্তুকি নিতে আসা চাকুয়া ইউনিয়নের চাকুয়া গ্রামের কৃষক লতিফ মিয়া জানান, এই সার দিয়ে পানি পড়ে। এই সার ভালো না বার বার বললেও কৃষি কর্মকর্তারা তা শুনছেন না। জেলা কৃষক সমিতির আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ বহু কৃষক রাজনৈতিক ভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ায় এবং ত্রাণ ও কৃষি ভর্তুকি কার্ড বিতরণে ব্যাপক দলীয় করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা কৃষি ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, আঠারো হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরণের প্রান্তিক চাষিকে কৃষি ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। সার অত্যন্ত নিম্নমানের এবং তা মেয়াদোর্ত্তীণ কৃষকদের এ ধরণের অভিযোগ সত্য নয়, সারের মান ভালো আছে, সার নিয়ে কোনও ভয় নেই। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. মোঃ মুশফিকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে কালো বাজারের বীজ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ