হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মাত্র ৩ দিন আগে অর্থাৎ গত ১৬ ডিসেম্বর শনিবার বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ সাড়ম্বরে বিজয় দিবস উদযাপন করেছে। বিজয় দিবস কোটি কোটি বাংলাদেশীর অহংকার। কিন্তু দেখা যায় প্রতি বছরই বিজয় দিবসের ২/৪ দিন আগে অথবা ২/৪ মাস আগে ভারতের একটি শ্রেণী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবমাননাকর ও অসম্মনজনক উক্তি করে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে ভারত থেকে বার বার বিভিন্ন ক্ষমতাশালী মহল যেসব উক্তি করে সেগুলি আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি রীতিমত কটাক্ষজনক এবং অবমাননাকর। পাঠক ভাইদের হয়তো স্মরণ আছে, কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত তথ্য পরিবেশন করলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এই বিতর্কিত মন্তব্য করার জন্য বাংলাদেশের কাছে মাফ চাওয়ার জন্যও পাকিস্তানকে বলা হয়। পাকিস্তানও বাংলাদেশের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে ঐ মন্তব্য সরিয়ে ফেলে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই কঠোর ভ‚মিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে একজনও প্রতিবাদ করেনি। বরং তারাও পাকিস্তানের এই বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে, কেউ অন্তরে, কেউ প্রকাশ্যে।
কিন্তু এর চেয়ে বড় ‘অপরাধ’ যখন ভারত করে তখন বাংলাদেশ সরকারের এই কঠোরতা যায় কোথায়? ভারতের ব্যাপারে কঠোর ভ‚মিকা নেওয়া তো দূরের কথা, কোনো প্রতিবাদ করার কোনো নজির আমাদের সামনে নাই। ভারতের ব্যাপারে এমনকি মিউ মিউ করাও হয় না। ভারতের এমন অবমাননাকর ভ‚মিকার অনেক নজির পাওয়া যায়। ঐসব নজির একটার পর একটা দিতে গেলে এই কলামের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই আমরা তিনটি নজিরের মধ্যে আজ সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
প্রথমেই শুরু করছি ভারতের একটি বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা নিয়ে। ছবিটির নাম ‘গুন্ডে’। এই ছবিটি বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী মানুষ ইউটিউবে সরাসরি দেখেছেন, অথবা সেখান থেকে ডাউনলোড করে টেলিভিশনের ওয়াইড স্ক্রীনে দেখেছেন অথবা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে দেখেছেন। এই ছবির একটি গান এত বেশি হিট করেছিল যে সেটি বাংলাদেশের আনাচে কানাচে পর্যন্ত উঠতি বয়সের কিশোর থেকে যুবক ও মধ্য বয়সীদের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল। গানটির প্রথম লাইন, ‘তুনে মারি এন্ট্রি আর / দিলমে বাজি ঘন্টি আর’। গানটির সাথে নেচেছিলেন রণবীর সিং ও প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। সিনেমাটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছেন যশরাজ ফিল্ম, লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন আলী আব্বাস জাফর, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সোহেল সেন, ধারাবর্ণনা করেছেন ইরফান খান, অভিনয় করেছেন রণবীর সিং, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, অর্জুন কাপুর ও ইরফান খান।
ছবিটির প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এরপর ভারী কামান ও ট্যাংক থেকে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। আরো দেখা যায়, কয়েকটি জঙ্গি বিমান উড়ছে। এগুলি ভারতীয় জঙ্গি বিমান। তারপর ধারাবর্ণনা। বিখ্যাত অভিনেতা ইরফান খানের কণ্ঠে হিন্দির বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এই যুদ্ধে পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের এই যুদ্ধের পরিণতিতে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।’ প্রিয় পাঠক ভাইয়েরা, এরপর আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। প্রথমইে তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘঠিত হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছে। এর থেকে স্পষ্ট যে, এটিকে তারা পাক-ভারত যুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ সংঘঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। সেটি হয় কাশ্মীর নিয়ে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাত্মক যুদ্ধ সংঘঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। সেটিও হয় কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় ১৯৭১ সালে। এটি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধে মুখ্যত জড়িত ছিল আরেকটি তৃতীয় দেশ। সঠিকভাবে যদি বর্ণনা করতে হয় তাহলে এই তৃতীয় দেশটিই ছিল প্রথম বা প্রধান দেশ। আর এই প্রথম বা প্রধান দেশকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই প্রধান দেশটি ছিল বাংলাদেশ। আর প্রধান পক্ষ ছিল মুক্তি বাহিনী। যুদ্ধে ছিল দুইটি পক্ষ। একদিকে ছিল পাকিস্তান, অপরদিকে ছিল ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীতে শুধুমাত্র গেরিলা যোদ্ধারাই অন্তর্ভুক্ত ছিল না, পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর একটি অংশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর (পরবর্তীতে প্রথমে যার নাম হয় বিডিআর এবং সর্বশেষে বিজিবি) এবং পুলিশ ও আনসার বাহিনী। এভাবে যশরাজ ফিল্ম এবং আদিত্য চোপড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাদের বিরাট ত্যাগকে এই যুদ্ধে একেবারে গায়েব করে দিলেন, আর বাংলাদেশ সরকার নীরব দর্শকের ভ‚মিকা গ্রহণ করল। এই যুদ্ধের কেন্দ্রীয় চরিত্রে বাংলাদেশ ছিল বলেই তো এই যুদ্ধের নাম হয়েছিল বাংলাদেশ যুদ্ধ। সুতরাং এটিকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করার অর্থই হলো বাংলাদেশের তৎকালীন সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং ৩ লক্ষ মুক্তি বাহিনীকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা।
আরেকটি কথা রয়েছে। বলা হয়েছে যে পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশীদের কাছে সেটি তো ভারতীয় বাহিনী ছিল না। সেটি ছিল মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয় গঠিত যৌথ বাহিনী। যৌথ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান এবং আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয় সেই অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে ছিলেন জেঃ অরোরা এবং বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। এতগুলো প্রতিষ্ঠিত, ঐতিহাসিক এবং অমোঘ সত্যকে ওরা চেপে গেছেন। অথচ তার প্রতিবাদ করেনি সরকার।
এই ছবিতে দেখানো হয় যে, অস্ত্রের চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে বাংলাদেশীরা জড়িত। ছবিতে আরো দেখানো হয় যে, বাংলাদেশ থেকে দুইটি বালক ভারতে পালিয়ে যায় এবং সেখানে তারা বড় হয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতি কটাক্ষ করে বলা হয়েছে যে, তারা নিজেদেরকে ভারতীয় হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। সেই সময় একটি ইংরেজী পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, There is also insinuation that Bangladeshis prefer identifying themselves as Indians. গুন্ডে সিনেমার ধারাবর্ণনা মোতাবেক, বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্ম ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ১৩ দিনের ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের ফলশ্রæতি। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ৮ মাস ধরে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো এবং যে ৮ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী শহীদ হয়েছেন সে যুদ্ধের কথা ছবিটিতে বিন্দু মাত্র উল্লেখ নাই।
\দুই\
এখন আমরা দ্বিতীয় একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে। তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন মনোহর পারিকার। এখন তিনি ভারতের অঙ্গরাজ্য গোয়া’র মুখ্যমন্ত্রী। চার অক্টোবর ২০১৬ ইন্ডিয়া টুডে/টাইমস অব ইন্ডিয়া/এনডিটিভি/এবং টাইমসের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে রামের লঙ্কা বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার। তিনি বলেন, লঙ্কা বিজয় করে রাম যেমন তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ভারত তাই করেছে। সোজা কথায়, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের দয়ার দান। এই কথা বলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে চরম অপমান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ কারো দয়ার দান নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ শাহাদৎ বরন করে, লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়ে, ১ কোটি লোক নয় মাসের জন্য বিদেশে আশ্রয় নিয়ে তারপর স্বাধীনতা হাসিল করেছে। সেটিকে তিনি বিভীষণকে দেয়া রামের দানের সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি আগরতলা এবং কলকাতার ক্যাম্পে ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের কষ্ট এবং যন্ত্রণা আমি আজও উপলব্ধি করি। তাই আমি এই মন্তব্যের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি এবং ধিক্কার জানাচ্ছি। সেই সাথে আপনাদের সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারাও অযুত কন্ঠে এই বক্তব্যের প্রতি ধিক্কার জানান।
\তিন\
এবার তৃতীয় ঘটনা। এডিজিপিআই ইন্ডিয়ান আর্মি তাদের ভেরিফাইড অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে যা বলেছে তার স্ক্রীন শট ইনসেটে তুলে দেওয়া হলো।
অনুবাদ: এডিজিপিআই- ইন্ডিয়ান আর্মি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে এই দিনে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য সাদা পতাকা উড়িয়েছিল এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। হ্যাস ট্যাগ দিয়ে হাইলাইটস করা #ইন্দো পাক যুদ্ধ ৭১ #বিজয় দিবস #ঐ বছরের এই দিন।
এবার প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তোলেন। সরকারি দল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ইনুপন্থী জাসদ, বাসদ, ছায়ানট, উদিচীসহ সব ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্ট তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের এই কটাক্ষ এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যে মুখে লাগাম লাগিয়ে থাকেন কেন? ভারতের প্রভূত্বের মুখে আপনারা চুপসে যান কেন? বাংলাদেশের কোনো কোনো কেন্দ্রে হিন্দু ভাইদের ওপর নির্যাতনে আপনারা প্রতিবাদে মূখর হন। কিন্তু যেই খবর বের হয় যে, ঐ নির্যাতন করেছে সেক্যুলার গোষ্ঠি তখনি আপনারা খামোশ হয়ে যান কেন? ভারতে বিজেপি এবং যোগী আদিত্যনাথরা যখন গো-মাংস নিয়ে তুলকালাম কান্ড করেন তখনও আপনারা স্পিকটি নট থাকেন কেন? আসলে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ-এইসব কিছুই কি ভারত কেন্দ্রিক?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।