চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
“তাঁর গুণাবলী চরম উৎকর্ষে লাভ করেছে
তাঁর সৌন্দর্যে সব অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে,
তাঁর সমস্ত আচরণ সর্বাঙ্গ সুন্দর;
তাঁর ও তাঁর আওলাদের প্রতি পাঠ কর দরুদ।”
এদেশের অন্যতম প্রবীণ কবি ব-নজীর আহমদ (জন্ম: ১৯২৩ ঈসায়ী) কবি সা’দীর উপরোক্ত না’ত অনুসরণে রচনা করেন নি¤েœাক্ত প্রশস্তিমালা-
“আপন কামালিয়ত আর বুযর্গীর বদৌলতে
গিয়ে পৌছেছেন তিনি ইয্যতের সে উচ্চাসনে।
আর আপন নূর সে সৌন্দর্য জ্যোতির বদৌলতে
দূর করে দিয়েছেন আঁধার ছিলো সেসব স্থানে।
নবীর আচার ব্যবহার সবই ছিলো সুন্দর।
ছিলো উৎকৃষ্ট ও উত্তম স্বভাব-চরিত্র তাঁর।
দরুদ পড়ো তাই তোমরা সকলে তাঁর ওপর
আরো পড়ো আওলাদের ওপর যতো আছে তাঁর।”
পল্লী বাংলার গ্রামীণ ভাষার কবি ছিলেন রওশন ইজদানী (১৯১৭-৬৭ ঈ:) তাঁর খাতামূন নবীঈন কাব্য গ্রন্থটি নবী জীবনের সরস রচনা। সেখানে তিনি “বালাগাল উলা” কাব্যটির পদ্যানুবাদ করেছেন এভাবে-
“পূর্ণতা দ্বারা তিনি শীর্ষে পৌছিয়াছেন-
সৌন্দর্য দ্বারা তিনি আলোকিত করিয়াছেন অন্ধকারকে-সৌন্দর্যমন্ডিত হইয়াছিল তাঁহার চরিত্রের প্রতিটি দিক (সুতরাং) দরুদ পড় তাঁহার এবং তাঁহার বংশদরদের উপর।”
দেশের অন্যতম প্রবীণ সাহিত্যিক, কবি ও গবেষক ছিলেন আবু ফাতেমা মোঃ ইসহাক। (১৯২৮-৯২ ঈ:)। তিনি অমর কাব্যটির বাংলা রূপ দেন এভাবে:
“সম্পূর্ণতায় হয়েছেন মোহাম্মদ (দ.)
অধিকারী উচ্চ মর্যাদার, সৌন্দর্যে দূর করেছেন তিনি এ জগতের ঘোর আঁধার।
সৌন্দর্যমন্ডিত ছিল তাঁর সমুদয় চরিত্র আচার-আচরণ
তাঁর ও তাঁর বংশধরদের পর পাঠ কর।
দরূদ ও সালাম হে মানবগণ।”
দেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সুসাহিত্যিক ছিলেন মোহাম্মদ আলী আজম (১৯০৮-৭৪ ঈ:)। তিনি বাক্য চতুষ্টয়ের ভাষান্তর করেন-
“তিনি নিজ কামালিয়াতের দ্বারা-
বুলন্দ মোরতবায় পৌছেছেন।
তিনি আপন জামালের রৌশনী দ্বারা অন্ধকার দূর করেছেন।
তার সমস্ত আচার ব্যবহার সৌন্দর্যময় ছিল। তোমরা তাহাঁর উপর ও তাঁহার আওলাদের উপর- দরূদ পড়।
বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে অমর স্বাক্ষর রেখেছেন যেসব সাহিত্যসেবী তাঁদের মধ্যে মাওলানা নূরউদ্দীন আহমদ (১৯০৮-৮৬) ঈ:) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এ আরবী নাতের বংগানুবাদ করেছেন এভাবে-
তাঁহার পূর্ণতা উন্নতির চরম শিখরে উঠিয়াছে-
তাঁহার রূপের ছটায় আঁধার বিদুরিত হইয়াছে,
চরিত্র তাঁহার সৌন্দর্যে বিভূষিত হইয়াছে-
সকলে তাঁহার প্রতি এবং
তাঁহার বংশধরগণের প্রতি দরুদ পাঠ করি।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত সীরাতবিদ ছিলেন মাওলানা আবদুল খালেক (মৃ: ১৯৫৫ ঈ:)। তাঁর “ছাইয়েদুল মুরছালীন” (১৯৫১) গ্রন্থটি এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। তিনি শেখ সা’দীর অমর কাব্যের গদ্যানুবাদ করেছেন সাবলীলভাবে- হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কামালিয়তের দ্বারা বুলন্দ মরতবায় পৌছিয়াছেন। তিনি আপন জামালে রৌশনী দ্বারা অন্ধকারকে দূর করিয়াছেন। তাঁহার সমস্ত আচার ব্যবহার সৌন্দর্যময় ছিল। হে মানবগণ! তোমরা তাঁহার উপর এবং তাঁহার আওলাদ ও আছহাবের উপর দরুদ শরীফ পড়িতে থাক।”
উক্ত আরবী নাতের সুন্দর গদ্যানুবাদ করেছে সাহিত্যিক সাংবাদিক মুজীবুর রহমান খাঁ (১৯৭১-৮৪ ঈ:), তাঁর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (১৯৮০) গ্রন্থে। ইসলামী চিন্তাবিদ সাহিত্যিক গবেষক ড: কাজী দীন মোহাম্মদ (জ: ১৯২৭ ঈ:), না’তটির গদ্যানুবাদ করেছেন এভাবে “তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের পূর্ণ বিকাশ, তাঁর সৌন্দর্যে দূরীভূত হয়েছে সব আঁধার, তাঁর চরিত্রগুণ সুন্দরতম, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সকলের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যাঁর অবদান অপরিসীম তাঁর প্রশংসায় রচিত উক্ত অমরবাণীর ভাষান্তর করেছেন মাওলানা মোঃ আমিনুল ইসলাম (জন্ম ১৯৩২ ঈ:) এভাবে-
“তাঁর গুলাবলী চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে
তার সৌন্দর্যে সব অন্ধকার বিদূরিত হইয়াছে।
তাঁর সমস্ত আচরণ সর্বাঙ্গ সুন্দর-
তাঁর ও তাঁর আওলাদের প্রতি পাঠ কর দরুদ।”
প্রবীণ কবি, সাহিত্যিক ও অনুবাদক গবেষক আবদুস সাত্তার (জ: ১৯২৮ ঈ:) মহাকবি সা’দীর বাক্য চারটি কাব্যে অনুবাদ করেছেন-
“কর্মই দিয়েছে তাঁকে সুউচ্চ সম্মান,
সৌন্দর্য আলোকে তাঁর তমঃ অবসান
সমস্ত স্বভাব তাঁর সুন্দর মহান-
সবাই দরূদ পড়ে চাওহে কল্যাণ।
“ওসওয়াতুল হাসানা” বা সুন্দরের শ্রেষ্ঠ আদর্শ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিবেদিত অমর না’তটির ছন্দোবদ্ধ অনুবাদ করেছেন এক আলেম কবি এভাবে-
‘পৌছলো নবীর পূর্ণতা আর- গুণ গরিমা উচ্চ সীমায়
ঘুচলো ধারায় তিমির রাশি-তাঁহার উজ্জ্বল রূপের আভায়
স্বভাব তাঁহার পরম শোভন-পূর্ণ তাঁহার চরিতমালা-
তাঁর পরে তাঁর বংশ পরে-পড় সবাই ছাল্লিআলা’।
আইনজীবী বিদগ্ধ সাহিত্যিক গবেষক এ, এফ, এম, আবদুল জলিল (১৯১৬-৭৯ ঈ:) তাঁর “ইরানের বুলবুল” গ্রন্থে উল্লেখিত বাক্যগুলোর বংগানুবাদ করেছেন-
“অতি উচ্চ তব মহিমা মহান পূর্ণ গুণ-গ্রামে হে নবী,
তব মাধুরীতে অমর আঁধার বিদূরিত আজিরে সবি।
অতীব সুন্দর অতীব সুন্দর তোমার সকল স্বভাবই।
সহস্র দরূদ উপরে তোমার হে নবী, রসূলে আরবী”।
প্রবীণ সাহিত্যিক মোহাম্মদ শাহজাহান আলী সে কাব্যের ভাষান্তর করেছেন :
পরিপূর্ণতা দানিয়াছেন প্রজ্ঞা ও জ্ঞান
তাই তিনি উপনীত যথা উচ্চাসন।
আপন সৌন্দর্য জ্যোতি করে বিদুরিত
জগৎ মাঝারে ছিল অন্ধকার যত।
স্বভাব চরিত্র আরো আচার ব্যবহার
ছিল অতি উত্তম উপরে সবার।
পড় দরূদ তাই তাঁহার উপর
আরো পড় তাঁর যত আছে বংশধর।
বহু গ্রন্থপ্রণেতা সুসাহিত্যিক জনাব ফজলুর রহমান (১৯২৩ ঈ:) তাঁর “আল্লার রসূল মোহাম্মদ (সা:)” গ্রন্থে আলোচ্য না’তটির বংগানুবাদ করেন এভাবে-
“পূর্ণতা তাঁর পৌছেছিল সর্বোচ্চ শিখর
রূপের আভায় তাঁর-দূর হল অন্ধকার,
সুষমামন্ডিত তাঁর চরিত্র সুন্দর।
সালাত তাঁকে ও তাঁর পরিজন পর।”
দেশের অন্যতম কথাশিল্পী, কবি, গবেষক ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ (জ: ১৯৪৩ ঈ:) না’তটি রুপান্তর করেছেন এভাবে-
“ তাবৎ পূর্ণতা নিয়ে শীর্ষে হয়েছেন উপনীত
অপার সৌন্দর্যে তিনি আলো করেছেন তমসাকে
আশ্চর্য চরিত্র তাঁর অতুলন সৌন্দর্যে মন্ডিত।
রাহমাতুল্লিল আ’লামীন- হাজার সালাম তাঁকে।”
মহাকবি শেখ সা’দীর এই অমর না’তটি আশেকে রসূলদের অতি প্রিয়, তাই শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে কন্ঠে কন্ঠে ধ্বনিত-রণিত হয়ে আসছে। এর অনুবাদে ও চর্চায় নতুন নতুন রূপ ও আঙ্গিক গৃহীত হচ্ছে। ইদানীং শেষ নবীর সীরাত আলোচনায় নিবেদিত প্রতিটি সাময়িকী বা পত্র পত্রিকাতে এই না’তটি মৌলিকভাবে বা রূপান্তরিত হয়ে অপূর্ব শব্দসম্ভারে শোভা পাচ্ছে। অনেক বিদগ্ধ নবী প্রেমিকের রচনার প্রথমে বা শেষে এই না’ত সংযোজিত হচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।