Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গোপসাগরে দস্যুতা দমনে সাফল্য

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইলিশ রক্ষার চেষ্টায় অন্যান্য অর্থকরী প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের প্রজনন বিচরণ মজুদ বেড়েছে : বন্ধ হয়নি ভারতীয় ট্রলার নৌযানের চুরি
মিঠাপানির মাছের তুলনায় মানবদেহের জন্য কয়েকগুণ বেশি খাদ্যমান ও উঁচু পুষ্টিগুণের ধারক হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপক‚লভাগের কিনারা ঘেঁষে সুবিশাল বঙ্গোপসাগরকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বিজ্ঞানীরা ষাটের দশক থেকেই বলে আসছেন ‘মৎস্য খনি’ হিসেবে। বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র সীমায়, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) উপর বাংলাদেশের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের মালিকানা-প্রতিষ্ঠিত অংশজুড়ে ৩৬ প্রজাতির চিংড়িসহ ৪৭৬ প্রজাতির মৎস্যরাজি বিচরণশীল রয়েছে। এই বিশাল মৎস্য সম্পদের আধার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমা বয়ে এনেছে এবার সুখবর। আর তা হচ্ছে এক. ইতোমধ্যে সাগরে নৌ-দস্যুদের তান্ডব অনেকাংশেই কার্যকরভাবে দমন করার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা ও জওয়ানদের নিরলস শ্রম, নিয়মিত টহল অভিযান ও পানিসীমায় সার্বক্ষণিক নজরদারির ফলে সাগরে এবং মোহনায় নৌ-দস্যুদের আখড়াগুলো এখন প্রায় দস্যুমুক্ত হয়েছে। নৌবাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশ কোস্টগার্ডেরও নিয়মিত অভিযানে নৌদস্যুরা জেলেদের উপর হামলে পড়ছে না। সচরাচর প্রতিবছর মাছ শিকারের ভরা মওসুম এলেই টেকনাফ থেকে দুবলার চর পর্যন্ত সমুদ্র উপক‚লজুড়ে বিভিন্ন স্থানে নৌদস্যুরা জেলেদের ছদ্মবেশে দেশীয় নিরীহ জেলেদের নৌযান ট্রলারে অতর্কিত হামলা চালায় এবং সর্বস্ব লুটপাট করে। খুন রাহাজানি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়েরও ঘটনাও ঘটে। এবার মাছ শিকারের অনুক‚ল মওসুমের গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখা যাচ্ছে সমুদ্র উপক‚লের সর্বত্র। গতকাল (শুক্রবার) চট্টগ্রাম ফিরিঙ্গি বাজারের ফিশারিঘাটে কয়েকজন জেলের সাথে আলাপকালে তারা নৌবাহিনীর টহলের ফলে স্বস্তির কথা জানান।
দুই. গত কয়েক বছরের মতো এবারও সাগর উপক‚লে মা ও জাটকা ইলিশ শিকারের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞার পশাপাশি এলাকাওয়ারি মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর সুফল এসেছে ইলিশ ছাড়াও সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন, বিচরণ, বর্ধনশীলতা এবং সার্বিকভাবে মজুদের ক্ষেত্রেও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় চিংড়ি, ইলিশসহ হরেক প্রজাতির মাছের প্রজনন ও বিচরণের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। কেননা মাছের খাদ্য-শৃঙ্খল এবং বিচরণ ও বংশ বিস্তারের উপযোগী পরিবেশ ব্যাহত হলে মূল্যবান সামুদ্রিক সম্পদের মজুদ, আহরণ হ্রাস পাবে। প্রজনন মওসুমে মাছ শিকার রোধ করা সম্ভব হলে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ থেকে আমরা আরও লাভবান হতে পারি। এরজন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং নিবিড় জরিপ ও গবেষণা প্রয়োজন।
এদিকে দেশের সমুদ্র উপক‚লভাগের ৭১৫ কিলোমিটার ব্যাপী তটরেখা থেকে ৪০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে ৩২ হাজার ৪৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৬৮ হাজার যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক ছোট আকৃতির দেশীয় ট্রলার-নৌযান এবং জেলে নৌকা নিয়মিত মাছ শিকার করে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এবার বর্ষা শেষে সামুদ্রিক মাছ শিকারের ভর মওসুম শুরু হওয়ার বেশ আগেভাগেই নৌবাহিনী এবং কেস্টগার্ড সমুদ্রসীমায় বিশেষত মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা ও নৌদস্যুতা দমনে নিয়মিত টহল অভিযান জোরদার করেছে। আর মিলেছে এর সুফল। দেশীয় জেলেরা নির্বিঘেœ সাগর উপক‚লে নৌযান ট্রলার নিয়ে মাছ শিকার করে ফিরছে। নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের বহরে ইতোমধ্যে সংযুক্ত হওয়া অত্যাধুনিক জাহাজকে টহল তৎপরতায় লাগসই ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে জেলে সাধারণের মাঝে ফিরে এসেছে নিরাপত্তাবোধ। কেটে গেছে সশস্ত্র নৌ-দস্যুদের আতঙ্ক। তারা নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সময়োচিত প্রয়াসের প্রশংসাও করছেন।
একদিকে অনুক‚ল আবহাওয়ায় ভর মওসুম অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তার ফলে জেলেরা সাগরে আগের বছরের এমনি সময়ের তুলনায় বেশিহারে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরছে। বাংলাদেশ সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগর, গভীর সমুদ্র ও উপক‚লভাগে অগ্রহায়ণ মাসের বর্তমান আবহাওয়ায় বিভিন্ন জাতের চিংড়ি-লবস্টার, রূপচান্দা, লাক্ষ্যা, কোরাল, সুরমা, ছুরি, টুনা, পোয়া, লটিয়াসহ হরেক প্রজাতির অর্থকরী সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ছে। বঙ্গোপসাগরের ‘এলিফেন্ট পয়েন্ট’ টেকনাফ-সেন্টমার্টিন থেকে মহেশখালী কুতুবদিয়া চ্যানেল, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, নোয়াখালীর হাতিয়া, রামগতি নিঝুমদ্বীপ, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা হয়ে খুলনার কাছে ‘হিরণ পয়েন্ট’ দুবলার চর, রায়মঙ্গল হয়ে সীমান্ত পয়েন্ট পর্যন্ত প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য বিচরণ অঞ্চলে এবার মাছও আহরণ করা হচ্ছে বেশিহারে। অভিজ্ঞ জেলেরা বলছেন, এ বছর ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র পর সাগরে মাছ কিছুটা বেশি ধরা পড়ছে। যে বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস সংঘটিত হয় তার আগে বা পরে সাগরে মাছ শিকার হয় বেশিহারে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসলে ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে সাগর যখন উত্তাল থাকে সেই পরিবেশে মাছের নাড়াচড়া, ছোটাছুটি বেশিই হবে। আর তাতে প্রাকৃতিক নিয়মে বিচরণশীলতা এবং প্রজননও বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়।
জেলেরা জানান, এবার বেশ কিছুদিন ধরে টেকনাফ সেন্টমার্টিন শাহপরীর দ্বীপসহ কক্সবাজার উপক‚ল, কুতুবদিয়া মহেশখালী, চট্টগ্রামের বহির্নোঙ্গর থেকে শুরু করে আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ চ্যানেল, হাতিয়া, রামগতি, রাঙ্গাবালি, নিঝুমদ্বীপ, ভোলা, চরফ্যাশন, বরগুনা, পাথরঘাটা, চরকুকরি মুকরি, সুন্দরবন, দুবলার চরাঞ্চল, রায়মঙ্গল এবং এর সংলগ্ন সমুদ্র উপক‚লের আশপাশ, খাঁড়িগুলোতে মাছ শিকারের জন্য নিরাপদ পরিবেশ পাচ্ছেন জেলেরা। অতীতে ছিল ভয়াল অবস্থা। ছিলনা জানমালের নিরাপত্তাটুকু। বর্তমানে স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে প্রায় সবখানে।
এদিকে নৌ-দস্যুদের লুটপাট তান্ডব রোধ হলেও চোরাপথে বা চুপিসারে বাংলাদেশের পানিসীমায় অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় ট্রলার নৌযানে ইলিশ, চিংড়িসহ মূল্যবান বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চুরি, লোপাট এবং চেরাচালান বন্ধ হয়নি। সুযোগ বুঝে ভারতীয় ক্ষিপ্রগতির ট্রলার নৌযানগুলো সাগরে অনুপ্রবেশ করে ইলিশ, চিংড়ি, রূপচান্দা, লাক্ষা, কোরাল, সুরমা, পোয়াসহ হরেক মাছ লুটে নিয়ে যাচ্ছে। মৎস্যসমৃদ্ধ একেকটি এলাকায় সেসব অনুপ্রবেশকারী ট্রলার মাছ চুরি করে সটকে পড়ছে। দেশীয় জেলেদের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশকারী প্রতিবেশী দেশের নাবিক বা জেলেদের খুব সহজে শনাক্তও করা যায় না। যদিও বিক্ষিপ্তভাবে মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ছে।



 

Show all comments
  • M Jasimuddin Khan ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:৪৬ এএম says : 0
    জলদস্যুদের কঠৌরহাতে দমন করতে হবে। জেলে ভাইদের নিরাপত্তা বিধান করুন। এই সাফল্য ধরে রাখা দরকার।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গোপসাগর

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ