চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের অসভ্য সমাজকে নতুন করে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করেন। মানুষকে স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালবাসা, করুণা দিয়ে মানুষ করেছেন স্বীয় তত্ত¡াবধানে রেখে। মাত্র ৬৩ বছর বয়সের মধ্যে এমন এক সমাজ নির্মাণ করলেন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের কাছে অনুসরণীয় হয়ে আছে। তার গড়া সমাজের প্রতিটি মানুষই ছিল নীতি ও আদর্শের এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এসব সোনার মানুষ তার প্রস্থানের পরে যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন তাদের চরিত্র, আদর্শ, মহানুভবতা, জীবনবোধ, মার্জিত সংস্কৃতি ও উন্নত রুচিবোধে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। দয়াল নবী (দঃ)’র আগমন ছিল গোটা মানবজাতির জন্য বিধাতার পক্ষ থেকে রহমত বরকত ও নাজাতের গাইড লাইন স্বরূপ। তিনি এসেছিলেন বলেই আমরা জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে নতুন এক জীবনবোধ, সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হয়েছি। তার আগমনে পৃথিবীর অশান্তির কালো ধোঁয়া আসমান ও জমিনে মিলিয়ে গেছে। তার আগমনের প্রয়োজনীয়তা স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ তিনি মানুষের ভূলুন্ঠিত মর্যাদা ও অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন। সব বর্ণের মানুষকে এক সারিতে দাঁড় করিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা সামাজিক বৈষম্যের পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। আজকের এই অশান্ত পৃথিবী তাঁর মতো আদর্শ মানুষ খুঁজে খুঁজে হয়রান। শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান নতুন নতুন আবিষ্কার ও মানুষের মাঝে শান্তি দিতে আজ ব্যর্থ। মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সব উন্নত রাষ্ট্র পৃথিবীর মোড়ল সাজার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। মানুষের প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে উন্নত প্রযুক্তিসম্পদ রাষ্ট্রগুলো অধিক শক্তিশালী বোমা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। পুরো বিশ্বকে কয়েক হাজারবার ধ্বংস করা যাবে এমন অস্ত্র আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। অথচ এই অশান্ত বিশ্বকে শান্ত করতে পারে এমন কোন কৌশল কেউ উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে না। প্রিয় নবী (দঃ) মানুষের মাঝে গিয়ে তাঁদের সমস্যা জেনেছেন, দূর করেছেন, নিজে না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় গরিবদের সঙ্গে ভাগীদার হয়েছেন। তার মানবোচিত গুণাবলি তাকে মহামানবের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। ধনী-গরিব, সাদা-কালো এমনকি বিধর্মীদের প্রতি ও তার করুণা ছিল অবারিত। যার ফলে তিনি শুধু মুসলমানদের দ্বারাই নয় বরং যুগে যুগে বিভিন্ন অমুসলিম মণীষী দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছেন।সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা,সহমর্মিতাও মানুষের মাঝে তার নেতৃত্বের গ্রহনযোগ্যতার প্রশংসায় বিখ্যাত ব্রিটিশ মনীষী জর্জ র্বানার্ড শ বলেছেনঃ “ওভ ধষষ ঃযব ড়িৎষফ ধিং ঁহরঃবফ ঁহফবৎ ড়হব ষবধফবৎ, ঃযবহ গঁযধসসধফ (ংস.) ড়িঁষফ যধাব নববহ ঃযব নবংঃ ভরঃঃবফ সধহ ঃড় ষবধফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং ড়ভ াধৎরড়ঁং পৎববফং, ফড়মসধং ধহফ রফবধং ঃড় ঢ়বধপয ধহফ যধঢ়ঢ়রহবংং”। আজকের এই যুদ্ধোন্মূখ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে আমাদেরকে হযরত নূরনবী (দঃ)’র আদর্শের কাছে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোন ব্যক্তির মত ও পথে এত যুগান্তকারী পদক্ষেপ পরিদৃষ্ট হয় না। তাই তাকে আমাদের বার বার স্মরণ করা উচিত। তার আদর্শ সমাজের সব ঘনীভূত সমস্যার সমাধানে কার্যকর। তাকে আল্লাহ একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রেরণ করার এখানেই হিকমত, দৃঢ় রহস্য যে, তিনি আমাদের এই ধরিত্রীতেই বসবাস করেছেন, এখানেই লালিত-পালিত, আমাদের মাঝেই বিকশিত, আমাদের সমাজ দ্বারাই মহামানব হিসেবে স্বীকৃত। তিনি সমাজে বসবাস করে মানুষের সমস্যার নিজের থেকে অনুভব করে তার সমাধান দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে একজন ফেরেশতা হিসেবে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে লোভÑলালসা, ক্রোধ, তথা মানবোচিত চাহিদা নেই। তাই তারা একচেটিয়া শুধুু আল্লাহর ইবাদতই করে থাকেন। কিন্তু মহানবী (দঃ), যার স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালবাসা, ক্রোধ, ক্ষুধা ইত্যাকার সবই ছিল। কিন্তু তিনি আমাদের মতো অনিয়ন্ত্রিত ছিলেন না। তার প্রতিটি আচরণই ছিল মার্জিত, প্রশংসিত, পরিশীলিত। তার চরিত্র মাধুর্য ছিল অনুপম। তার নন্দিত চরিত্রের প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। (আলÑকোরআন )।
তিনি ছিলেন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রজ্ঞাবান ও সংস্কৃতিবান। যার ফলে তাকে আমরা যেভাবেই মূল্যায়ন করি তার আসন সবার ঊর্ধ্বে। তিনি বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার জীবনের সব দিকই ছিল মানুষকে প্রভাবিত করার মতো আকর্ষণপুষ্ট আচরণ, সংস্কৃতি দ্বারা পরির্পূণ। এমন অসভ্য সমাজে এসেও তিনি তার আদর্শে অটল রয়েছেন। নিজের আদর্শকে কখনও বিলীন করে সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে যাননি। বরং নিজের আদর্শ, সভ্যতা সংস্কৃতি, জীবনবোধ মানুষের মাঝে বিলিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সত্যের সুবাতাস ছড়িয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। তার কাছ থেকে কখনও অন্যায়, অসভ্যতা প্রকাশ পায়নি, যার কারণে ছোটবেলাতেই তিনি সমালোচকদের দ্বারা আল-আমীন খেতাবে ভুুষিত হয়। ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সফল বণিক। ব্যবসায় তার সফলতা দেখে হযরত খাদিজা (রাঃ) তার সব সম্পদ মুহাম্মদের পায়ে উৎসর্গ করে বিয়ের প্রস্তাব দেন।বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর তিনি মুরুব্বীদের অনুমতি ও গ্রহণ করেছেন। এভাবে তার নবুয়ত পূর্ববর্তীও পরবর্তী সব ঘটনা তাকে আদর্শ সংস্কৃতির পথিকৃৎ হিসেবে প্রমাণ করে। পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার জীবনের শিশুকাল থেকে আমরণ ঘটে যাওয়ার সব ঘটনা অবিকৃত ইতিহাসের পাতায়। আল্লাহ তার জীবনের এসব দিক অবিকৃত করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তার অনুপস্থিতিতে আমরা আদর্শ খুঁজতে গিয়ে হয়রান, পেরেশান না হই। বরং তার মাঝেই সব আদর্শ, সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাই। তাই তার জীবন সর্ম্পকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা দরকার। তাকে ঘিরে আমাদের পড়াশুনা, চর্চা, মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তার জীবনচরিত্র অর্ন্তভূক্ত করা প্রয়োজন।
আমাদের মাঝে প্রতি বছর রবিউল আউয়াল আসে আবার শূণ্য হাতেই ফিরে যায়। এই মহান মাস আমাদের সমস্যা বিক্ষুব্ধ বিশ্বের মানব-সমাজে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। অথচ এই দিনের মধ্যেই রয়েছে আমাদের প্রভূত কল্যাণ। দয়াল নবী (দঃ)’র মার্জিত জীবনবোধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষমুক্ত করতে পারি। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে আমাদেরকে মহানবীর (দঃ) আদর্শের কাছে ফিরে যেতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।