Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সোনারগাঁওয়ে চলছে লুটপাট বদনাম কুড়াচ্ছে সরকার

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথা

মোক্তার হোসেন মোল্লা, সোনারগাঁও থেকে | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত ২ ডিসেম্বর শনিবার, বিকেল ৪টা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার বৈদ্দ্যেরবাজারের মাছ ও লঞ্চঘাট এলাকা। এলাকাটিতে প্রবেশ করতে কাঠপট্টি পার হওয়ার পর হাতের ডানে লোহার অ্যাঙ্গেলের সাথে রঙ্গিন টিন দিয়ে নির্মাণ করা বিশাল এলাকাজুড়ে সীমানা প্রাচীর (বেড়া)। প্রাচীরের ভেতর সারিবদ্ধভাবে বন্ধ রয়েছে বেশ কিছু (প্রায় শ’খানেক) দোকান। দোকানগুলোর পেছনে বিশাল বালুর মাঠ। প্রাচীরের মাঝেমাঝে টিন ছুটানো। প্রাচীরের ভেতর থেকেই ছুটানো টিনের ফাঁক দিয়ে ব্যবসায়ীদের মাল বিক্রির প্রাণপণ চেষ্টা। বিশাল বালুর মাঠের পাশে বহমান মেঘনা নদীর তীরে ছয়টি আনলোড ড্রেজার। এর মধ্যে আমানত-আক্তার ও সামান্তা-আঁখি-রিতুসহ মোট চারটি শক্তিশালী ড্রেজারের হোসপাইপ থেকে সরাসরি বালু ফেলছে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত লঞ্চঘাটের পাশে পানিতে। উৎসুক জনতা লঞ্চঘাটের সিড়িতে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। আর বেশ কয়েকটি মাল বোঝাই নৌকার মাঝি বালুতে আটকে থাকা নৌকা গতরের জোরে ঠেলে (ধাক্কা) পানিতে নেয়ার চেষ্টা করছে। আর লঞ্চঘাটের সিড়ির নিচে দাঁড়িয়ে দুইজন যুবক সিগারেট টানছেন আপন মনে। জানা গেছে, তারা আল-মোস্তফা গ্রুপের লোকজন। বালু ভরাটের তত্ত¡াবধানেও রয়েছে ওই যুবকরাই।
একটু দূরে সরে এসে কথা হয় একাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ীর সাথে। তারা জানান, লোহার অ্যাঙ্গেল আর টিন দিয়ে দেয়া সীমানা প্রাচীর আল-মোস্তফা ওরফে জামাই মোস্তফার মালিকানাধীন হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড সেমি-টিউবস লিমিডের পক্ষে কাজ করা স্থানীয় দালালরা করেছেন। সম্প্রতি এই সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময়ই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী প্রাচীরটি উপড়ে ফেলেছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু নদী বা সরকারি খাস জমিই নয়, প্রভাব আর অর্থের জোরে গ্রুপটি জবরদখল করে নিচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি আর সড়ক ও জনপথের জমি। এমনকি আদালতের আদেশও প্রতিষ্ঠান ও তার লোকজনদের কাছে অর্থহীন। ব্যবসায়ীদের দাবি, এমনই উন্মুক্ত দখল উৎসব চলছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। এক কথায় লুটপাট চলছে জনপদটিতে। আর এসব বিষয় যাদের দেখভাল করার কথা, তারা যেন চোখে কাঠের চশমা এঁটেছেন! তবে অনেকের মতে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা প্রভাব আর অর্থের কাছে পরাজিত হয়ে বিসর্জন দিয়েছেন নিয়ম-নীতি, আদর্শ আর কর্তব্যকে। ফলে এসব কর্মকান্ডে সাধারণ জনগণ আর ভুক্তভোগীরা সরাসরি দায়ী করছেন বর্তমান সরকারকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পরিষদের একটি সূত্র দাবি করে, আল-মোস্তফা গ্রুপের মালিকানাধীন ‘হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড সেমি-টিউবস লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানের বালু ভরাট নিয়ে খোদ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শুরু হয়েছে অন্তর্দ্ব›দ্ব। সরকারি খাস জমি ও নদী ভরাটের বিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। সংবাদ প্রকাশের সূত্র ধরে গত ১৫ নভেম্বর সরেজমিন গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) বি এম রুহুল আমিন রিমন। আদালত পরিচালনার সময় কাদির হোসেন (৩৫) ও সেলিম (৩০) নামে দুই ড্রেজার মালিককে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানাও করেন। কিন্তু বালু ভরাট বিষয়ে নাক না গলাতে কোনো এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিষেধ ছিল। নিষেধ সত্তে¡ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করায় এসিল্যান্ডের সাথে দ্ব›দ্ব শুরু হয় ওই কর্মকর্তার।
এদিকে, মেঘনা নদীতে বালু ভরাট বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট ভ‚মি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, আমার জানামতে যে স্থানটিতে বালু ভারট করা হচ্ছে, সেই জমির একটি অংশ (৮ থেকে ১০ হাত) জনৈক মতিনের রয়েছে। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে মতিনের জমি অতিক্রম করে সরাসরি নদীর বড় একটি অংশই ভরাট করা হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন। তা ছাড়া, আইন অনুযায়ী নদীগর্ভে চলে যাওয়া সম্পত্তি কোনো ব্যক্তির হলেও তা ব্যক্তিমালিকানাধীন দাবি করা বেআইনি। কোনো স্থান বা জমি নদীগর্ভে চলে গেলে সেই জমি বিআইডবিøউটিএ’র জমি হিসেবে গণ্য হয় বলে তিনি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বালু ভরাট কাজের সাথে জড়িত স্থানীয় এক যুবক এ প্রতিবেদককে জানান, যে স্থানটি দিয়ে বালু ভরাট করা হচ্ছে সেই স্থানে প্রায় ৮৫ হাত গভীর। এ পর্যন্ত (২ ডিসেম্বর, শনিবার) ২০ লাখ বালু ভরাট করা হয়েছে। মোট বালু ফেলা হবে দুই কোটি ঘনফুট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা অফিসের এক কর্মচারী জানান, নদী ভরাট কাজের অগ্রগতি দেখতে সম্প্রতি খোদ সরকারের কোনো এক প্রভাবশালী মন্ত্রীও নাকি রাতের আঁধারে সরেজমিন দেখে যান। ওই সূত্রটি দাবি করে- জেলা, উপজেলা ও সরকারের উচ্চমহল পর্যন্ত অনেক কর্তাব্যক্তিই এই কাজ থেকে সুবিধা পেয়ে চোখে কাঠের চশমা ও কানে উচ্চস্বরের গান শুনছেন। তাই এ কাজ কেউ দেখেও না দেখার, আর শুনেও না শোনার ভান করছেন।
অপরদিকে, বৈদ্দ্যেরবাজার লঞ্চঘাট এলাকায় বালু ভরাটের ঠিক উল্টো দিকে এমএস নামে একটি মুরগি ও মাছের খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক সরকারি খাস জমিতে থাকা সবজি ও মাছবাজার জোর করে উঠিয়ে সড়ক ও জনপথের জায়গায় বালু ভরাট করে প্রতিষ্ঠানটির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে। সেই স্থান দিয়ে ইতোমধ্যে চলাচল করছে ওই প্রতিষ্ঠানের যানবাহন। আর প্রাচীরের ভেতর চলছে ওই প্রতিষ্ঠানের ফিড জাতীয় পণ্য (ফার্মের মুরগি ও মাছের খাবার) উৎপাদনের জন্য অবকাঠামোর কাজ। অথচ একটি আবাসিক এলাকার মধ্যে ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিভাবে পরিবেশ ছাড়পত্র পেল বা আদৌ কি পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে কি-না তা ও কারোর জানা নেই। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে স্থানীয় একাধিক গ্রামবাসী জানান, প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে তিনটি গ্রামের কয়েক হাজার ব্যক্তির চলাচলের রাস্তা। আর এসব গ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা (হিন্দু) বসবাস করায় কেউ ভয়ে মুখ খুলছে না। আর ইতোপূর্বে যে দু-একজন খুলেছে, তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এসব কাজ কিভাবে হচ্ছে স্থানীয় বসবাসকারী ও ব্যবসায়ীদের এমন প্রশ্ন করলে তারা সরাসরি সরকারকেই দায়ী করে বলেন, সরকারি বিভিন্ন দফতরের যেসব কর্তাব্যক্তিরা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এসব বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা না থাকলে এমন কাজ করা কখনোই সম্ভব নয়। তবে এ সকল কাজে মদদ দিতে স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকেই দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মো: মশিউর রহমান বলেন, সহকারী কমিশনার ভ‚মি’র নির্দেশে সরেজমিন গিয়ে নদীর সীমানা শনাক্ত করে লাল নিশান টাঙিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু শুনতে পেয়েছি, কে বা কারা রাতের আঁধারে তা উপড়ে ফেলেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) বি এম রুহুল আমিন বলেন, ইতোপূর্বে বালু দিয়ে নদী ভরাটের কথা শুনেছি এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রমাণসাপেক্ষে দুইজনকে আটক করে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। তারা যদি পূণরায় এ ধরনের ঘটনা ঘটায়ম তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আবারো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করব। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনুর ইসলাম বলেন, নদী ভরাটের বিষয়টি আপনার কাছ থেকে শুনলাম। আমি এসিল্যান্ডকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছি।
এ ব্যাপারে বিআইডবিøউটিএ নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিচালক মো: গোলজার হোসেন নদী ভরাটের বিষয়ে শুনে অনেকটা আশ্চর্যজনক ভঙ্গিতে ইনকিলাবকে জানান, তিনি এ বিষয়টি কারো কাছে শুনেননি। এই প্রথম কেউ তাকে এ বিষয়ে অবগত করেছে। ঘটনা সত্য হলে দ্রæততম সময়ের মধ্যেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো: রাব্বি মিয়ার সাথে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সোনারগাঁওয়ে


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ