সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি ১ দশমিক ৬ শতাংশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল
আ ব্দু স সা লা ম
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়। দেশের সবখানে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। হানাদার বাহিনী একের পর এক দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। তাদের হাত থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এমনকি তাদের হাতে গ্রাম ও শহরের মা-বোনরাও নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই তাদের অপহরণ করা হচ্ছে। হানাদার বাহিনীর এসব ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতা করছে এ দেশের কিছু বিপথগামী লোকজন যারা তাদের দোসর। তারা হলো রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্য। তারা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। কারা দেশ স্বাধীনের পক্ষে কাজ করছে, তাদেরকে কারা সহযোগিতা করছে, কোথায় তাদের ঠিকানা, কী তাদের পরিচয়Ñ এসব গোপন তথ্য পাকবাহিনীর কাছে ওই দোসররা পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের সহযোগিতা পেয়ে পাকসেনারা গ্রাম-শহরে একের পর হামলা করছে, নারী-শিশু অপহরণ করছে, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। তাদের সবার অত্যাচারে গ্রাম-শহরের লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তারা যে যার মতো প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
শিবনগর গ্রামের মহসিন আলী বেশ প্রভাবশালী লোক। গ্রামে তার অনেক জমি-জায়গা আছে। অনেকেই তার জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। সবাই তাকে এক নামে চেনেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধ তার খুব অপছন্দ। সে কোনোভাবেই চায় না যে দেশ স্বাধীন হোক। শিবনগরের পাশের গ্রামের নাম নাটুদা। নাটুদা গ্রামে পাকসেনারা ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছে। ক্যাম্পের পাকসেনাদের সাথে মহসিন আলীর খুব সখ্য। মহসিন আলী জানে যে, শিবনগর গ্রামে কারা কারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, কী তাদের পরিচয়। সব খবর সে পাকসেনাদের জানিয়ে দিয়েছে। সে কারণে ক্যাম্পের পাকবাহিনীরা মহসিনকে খুব পছন্দ করে।
গ্রামে মহসিন আলীর বাড়িটিই একমাত্র দোতলা বাড়ি। এ বাড়িটি বেশ বড়সড়। বাড়িতে অনেকগুলো কক্ষ রয়েছে। দোতলাতে তাদের শোয়ার ঘর। আর নিচতলার কয়েকটি কক্ষ মহসিন আলী ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। বিভিন্ন গ্রামে তার অনেক সহযোগী রয়েছে। তারা সবাই মহসিন আলীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় তারা এই বাড়িতে গোপন বৈঠক করে। মহসিন আলীর স্ত্রী করিমন বিবি দেশ স্বাধীনের পক্ষে। সে স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে তা বুঝতে পারত। তাই সব কথা স্ত্রীর সাথে আলোচনা করত না। স্ত্রীর প্রতি তার কড়া নিষেধ ছিলÑ কেউ যেন ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে না পারে যে, কারা আমার বাড়িতে যাতায়াত করে। পাকবাহিনীর সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো মহসিন আলীকে খুব ভয় পায়। এটি মহসিনের স্ত্রী করিমন বিবিও জানত।
বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায়ই যুবতী মেয়েদের অপহরণ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রামের অনেক বধূকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকে সন্দেহ করছে এ কাজে মহসিন আলীর হাত রয়েছে। তারা কেউই ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। মহসিন আলীর স্ত্রীও একই রকম সন্দেহ করে। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। কয়েক দিন পর হঠাৎ একদিন রাতের বেলায় করিমন বিবি নিচতলার একটি কক্ষ হতে একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেল। করিমন বিবি বুঝতে পারল যে, এই মেয়েটিকে তার স্বামীর দোসররা ধরে নিয়ে এসেছে। তাকে সুযোগ মতো পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। নানা রকম চিন্তায় সেই রাতে করিমন বিবির ঘুম এলো না। সারারাত জেগে থাকল। কিন্তু তার সাহস হলো না যে, ওই মেয়েটির বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার। কিছুক্ষণ পর অবশ্য ওই মেয়েটির আর কান্নার শব্দ শোনা যায়নি। তাছাড়া সকালেও তাকে আর দেখা যায়নি।
পরের দিন সকালে মহসিন আলীর কাছে করিমন বিবি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল, ‘গত রাতে নিচতলার কোনো একটি ঘর থেকে একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনেছি। মেয়েটি কে? এখানে এলো কীভাবে?’
Ñ‘এসব তোমাকে শুনতে হবে না।’
Ñ‘এসব ঘৃণ্য কাজ করতে আপনার লজ্জা করে না? আপনার মেয়েকে যদি কেউ এভাবে ধরে নিয়ে আসত, তাহলে আপনার কেমন লাগত বলুন? বলুন কেমন লাগত?’
Ñ‘বললাম তো, এসব শুনে তোমার কোনো কাজ নেই। তাছাড়া ক্যাম্পে যারা থাকে তারা তো দেশের জন্যই কাজ করছে। তারা চায় পাকিস্তান যেন ভাগ না হয়। তাদের পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করে। ইচ্ছা করলেই তো তারা এ অবস্থায় পরিবারের কাছে যেতে পারবে না। তাদেরকে তো আমাদেরই সহযোগিতা করতে হবে। আমরা যদি সহযোগিতা না করি, তাহলে কারা করবে?’
Ñ‘ছি! ছি! আপনি এত নিষ্ঠুর। আমি মোটেই আপনাকে এসব ঘৃণ্য কাজ করতে দেব না। প্রয়োজনে গ্রামের সবাইকে আপনার এই কুকর্মের কথা আমি জানিয়ে দেব।’
Ñ‘এই কথা যদি গ্রামের কেউ জানে, তাহলে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। প্রয়োজনে তোকে হত্যা করব।’
কিছুক্ষণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া হলো। তারপর আবার ঝগড়া থেমে গেল। মহসিন আলী তার স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গেল। এখন সে খুব সতর্ক থাকে, তার স্ত্রী করিমন বিবি যেন কোনোভাবেই এসব নারীর বিষয়ে কিছু জানতে না পারে। যাহোক, দিন দশেক পর পুনরায় একদিন রাতে করিমন বিবি একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেল। দুশ্চিন্তায় তার ঘুম এলো না। সকালেও ওই মেয়েটির কান্নার শব্দ শোনা গেল। মহসিন তখন বাড়ির বাইরে ছিল। সাহস করে মহসিনের স্ত্রী দোতলা হতে নিচতলায় নেমে এলো। যে ঘর থেকে কান্নার শব্দ শোনা গেল করিমন বিবি সেই ঘরের নিকটে গেল। ঘরের দরজা খুলে দেখল যে, একটি অল্প বয়স্ক মেয়ে খাটের কোনায় বসে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে করুণ সুরে কাঁদছে। মেয়েটি বেশ সুন্দরী। তাকে করিমন বিবি জিজ্ঞাসা করলÑ ‘তোমার নাম কী? কোথায় তোমার বাড়ি?’ মেয়েটি এসব প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে মহসিনের স্ত্রীর পা জড়িয়ে ধরে বললো : ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে ছেড়ে দেন। আমি বাড়ি যাব। দয়া করে আমার সর্বনাশ করবেন না।’
Ñ‘তোমার কোনো ভয় নেই। কেউ তোমার সর্বনাশ করতে পারবে না। তুমি অবশ্যই যাবে।’
কোনো কথা না বাড়িয়ে করিমন বিবি তাকে ছেড়ে দিল। মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়ে একটা দৌড় দিল। যেন খাঁচার পাখি মুক্ত হলো। একটি মেয়ের জীবন বাঁচাতে পেরে খুশিতে করিমন বিবির চোখে জল চলে এলো।
কিছুক্ষণ পর মহসিন আলী বাড়িতে এলো। সে দেখে মেয়েটি ঘরে নেই। মেয়েটিকে না দেখে সে ভীষণ রেগে গেল। সে বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এটি তার স্ত্রীর কাজ। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল : ‘মেয়েটি কোথায় গেল?’
Ñ‘আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
Ñ‘কী! তোর এত বড় সাহস! বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’
মহসিন তাকে প্রাণে না মেরে জোরসে কয়েকটি চড়-থাপ্পড় দিল। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। শহরেই ছিল তার বাবার বাড়ি। কাঁদতে কাঁদতে করিমন বিবি তার বাবার বাড়িতে চলে গেল। মহসিন আলী এতেই ক্ষান্ত হয়নি। সে ওই দিনই করিমন বিবিকে তালাক দিয়ে দিল।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। চারদিকে তুমুল যুদ্ধ চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হচ্ছে। একে একে দেশের বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হচ্ছে। রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা লেজ গুটাতে শুরু করেছে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। চারদিকে আনন্দের বন্যা বইছে। স্বাধীন দেশে লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে। করিমন বিবির মনে একটা বড় কষ্ট ছিল। দুঃখ-বেদনায় তার বুকটা ভরা ছিল। স্বাধীন দেশের পতাকাই তার বুকের সমস্ত দুঃখ-বেদনাকে মুছে দিল। ওই লাল-সবুজের পতাকাই করিমন বিবির একমাত্র সুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।