হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
দু’সপ্তাহ ধরে জল্পনা-কল্পনা এমন ছিল, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করবে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার মুখে প্রস্তাব গ্রহণ সম্ভব হয়নি। তার পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ইতালীর স্থায়ী প্রতিনিধির দেয়া একটি বিবৃতি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাব গ্রহণের পথ অবশ্য বন্ধ হয়নি। ভষ্যিতে চীন-রাশিয়া অমত না করলে হয়তো প্রত্যাশিত প্রস্তাবটি নেয়া সম্ভব হতে পারে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীরা যেভাবে রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা করছে, নির্যাতন চালাচ্ছে এবং বিতাড়ন করছে তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে এই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন চালানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল ইতোমধ্যেই একে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ‘নিধন ও অপরাধ’ বন্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অবশ্যই করণীয় রয়েছে। দায়িত্ববোধের এই জায়গা থেকেই আশা করা হয়েছিল, নিরাপত্তা পরিষদ হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধে এবং ইতোমধ্যে গৃহহারা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে, স্বমর্যাদায় ও নিরাপত্তাসহ প্রত্যাবর্তন-পুনর্বাসনের তাগিদ দিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত একটা প্রস্তাব গ্রহণ করবে। বাস্তবে সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিরোধিতাকারী বিশ্বের তাবৎ মানবতাবাদী বিবেকশাসিত মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছে। তারপরও বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিবৃতিটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো। প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া অসম্মতি জানালেও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তারাও বিবৃতি সমর্থন করেছে। কূটনীতির ভাষায়, এটাও এক ধরনের অগ্রগতি।
নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির যে বিবৃতিটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে তাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আরসার হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি রাখাইনে ব্যাপক সন্ত্রাসের ঘটনার ফলে ৬ লাখ ৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক গৃহচ্যুৎ হওয়ায় সেনাবাহিনীকে দায়ী করে কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে। এই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের যে মারাত্মক লংঘন হয়েছে, তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রাখাইনে এরপর যাতে আর অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ না হয় সে জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি বিবৃতিতে আহŸান জানানো হয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক তৎপরতার ফলে রাখাইনে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে দ্রæত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য রয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুযায়ী, এই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সহিংসতা বন্ধ, উপদ্রæত এলাকায় ত্রাণ প্রেরণ এবং বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। এছাড়া জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতৈক্য রয়েছে। বিবৃতিতে এই সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের ওপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
রাখাইনে নির্বিচারে গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া, অভিমত ও সুপারিশের প্রতিফলন রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে। বিবৃতির বিষয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন সন্তোষ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার মতে, বিবৃতির ভিত্তিতে সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তবে যা করার দ্রæত করতে হবে। সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ তার পক্ষে সম্ভব সবকিছু করতে প্রস্তুত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদ যদি তার ভূমিকা পালন না করে তাহলে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে না।
নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বটে, তা সত্তে¡ও বাংলাদেশ সর্বসম্মত বিবৃতিটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। ‘প্রস্তাবের স্থলে বিবৃতি’ মিয়ানমারের কূটনৈতিক সাফল্যের প্রমাণ বহন করলেও তাতে সে খুশি হতে পারেনি। এরকম বিবৃতি সে চায়নি। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দফতর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি দুই দেশের আলোচনাকে ‘মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত’ করতে পারে।
মিয়ানমারের এই প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ চাইছে না। গোড়া থেকেই সে এর বিরোধিতা করে আসছে, যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যেই এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। মিয়ানমার মনে করে এবং বলেও আসছে, দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে বসেই এ সংকটের সমাধান হবে। এটা আসলে তার একটি ধাপ্পা বা কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে সে একদিকে সংকটটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে চাইছে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, ইস্যুটি অনেক আগেই আন্তর্জাতিক চরিত্র লাভ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের তরফে যখন বলা হয়, সন্ত্রাস-সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে, গৃহচ্যুৎ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে, তখন আর ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক থাকে না, বহুপাক্ষিক ইস্যু হিসেবেই বিবেচিত হয়। তাছাড়া যখন কেথাও গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের মতো মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে তখন আন্তর্জাতিক বলতে পারে না এটা ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ কিংবা দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে এর সমাধান সম্ভব।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি মোটেই নতুন নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীদের পরিকল্পিত হত্যাকাÐ, বর্বর নিপীড়ন-নির্যাতন ও বিতাড়ন যুগের পর যুগ ধরে চলছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সব অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। অথচ তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বংশ পরম্পায় সেখানে বসবাস করছে। এখন মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা সে দেশে অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশ থেকেই মূলত এই অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা নাকি বাঙালী। বাংলাদেশ মূলত তিনটি কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে জাড়িয়ে পড়েছে। প্রথমত: রাখাইন বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের একটি রাজ্য। সেখানে সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীদের হত্যা-নির্যাতন যখন বেড়ে যায় তখন নিরূপায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ আশ্রয় নিতে ছুটে আসে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত: রোহিঙ্গারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। এটা তাদের হত্যা-নির্যাতন ও উৎসাদনের বড় কারণ। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি এ দেশের মুসলমানদের সহমর্মিতা আছে সঙ্গতকারণেই। দেখা গেছে, সরকারিভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ বন্ধে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলেও সে ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। স্থানীয় মুসলমানরা গোপনে-প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে একটা জনসম্মতি এদেশে বরাবরই আছে। তৃতীয়ত: রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ বলা হচ্ছে, যদিও তারা বাঙালী নয়। এই বাঙালী বলেই তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপে রয়েছে। আগে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখের ওপর। সাম্প্রতিক গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের মুখে আরও প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে এবং প্রতিদিনিই দলে দলে আসছে। বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান চাপ বহন করার সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশ চায় যত দ্রæত সম্ভব তাদের ফেরৎ পাঠাতে। রোহিঙ্গাদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরৎ নেয়া হোক, মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশের এটাই প্রত্যাশা ও কামনা। ভৌগোলিক অবস্থান ও অবস্থার ফেরে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি পক্ষ হয়ে পড়েছে। দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে হোক বা আন্তর্জাতিকভাবে হোক, বাংলাদেশ এর দ্রæত সমাধান চায়, চায় টেকসই সমাধানও। অতীতের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে এর গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ১৯৭৮ সালে যখন ব্যাপক আকারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ ঘটে, তখন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে তাদের অনেককে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব হয়। এর পর ১৯৯২ সালেও কিছু সংখ্যককে ফেরৎ পাঠানো হয়। অতঃপর আগে থেকে যাওয়াদের সঙ্গে ২০১২ ও ২০১৬ সালে যারা আসে তাদের ফেরৎ পাঠানো যায়নি। এখন সব মিলে ১০/১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিদিনই দলে দলে তারা আসছে। এই আসা বন্ধ হবে না এবং আশ্রিতরাও আর কখনো স্বদেশে ফিরতে পারবে না, যদি না তাদের নাগরিক অধিকারসহ সকল অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে সময় ক্ষেপন করছে এবং এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে যাতে আর কখনই রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ফিরতে না পারে। কাজেই, বাংলাদেশকে মিয়ানমারের কথামতো দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে সমাধানের পথে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারার নির্বুদ্ধিতা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। তাই বলে মিয়ানমারের সঙ্গে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা বন্ধ করতে বা ভেঙ্গে দিতে হবে, এমন নয়। সফর বিনিময়, সংলাপ, আলোচনা সবই চালিয়ে যেতে হবে। তবে সমাধানের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া বা সিদ্ধান্তের বেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিতে হবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ থাকলে সমাধান স্থায়ী ও টেকসই হবে। মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহিতার একটা জায়গায় আটকাতে হবে।
মিয়ানমার মুখে বলছে, দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে সে সমাধান চায় কিন্তু বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা লক্ষ্যযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেই হোক আর মিত্রদের পরামর্শ মোতাবেকই হোক, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির অফিসের একজন মন্ত্রী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফর করেন। তার সঙ্গে বৈঠক শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতি মেনে তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রস্তুত। ঠিক এর পরদিন অর্থাৎ ৪ অক্টোবর সু চির অফিস থেকে বলা হয়, বৈধ নাগরিকেরা মিয়ানমারে ফিরে আসতে পারবে এবং মিয়ানমার তাদের পুনর্বাসন করবে। বলা বাহুল্য, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেবল মাত্র ১৪ থেকে ১৮ হাজার রোহিঙ্গাই স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ভুলটি বুঝতে পারে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বই তো নেই। তদপুরি, মিয়ানমারে বসবাসকারী হিসেবে প্রামাণিক কাগজপত্রও তাদের অধিকাংশের নেই। হত্যা-নির্যাতনের মুখে যারা ঘর থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছে তাদের পক্ষে কোনো কাগজপত্র আনা কী করে সম্ভব হতে পারে? স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে যান। সেখানে তিনি শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেন। একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রæপ গঠনে ঐকমত্য ব্যতীত তার সফরের আর কোনো অর্জন নেই। তার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর হয়নি। দেশে ফিরে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার কিছুই করবে না। তার এই অভিমত থেকে বুঝা যায়, দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে সমাধান মিয়ানমারের একটি ফাঁদ। ফাঁদের ব্যাপারটি যে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বুঝতে শুরু করেছে, সেটা জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির পূর্বে উল্লেখিত বক্তব্য থেকে উপলদ্ধি করা যায়।
রোহিঙ্গা ইস্যু দ্বিপক্ষীয় নয়। তা এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের গোটা বিষয়টি মানবাধিকার লংঘনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে নিরব থাকতে পারে না। কাজেই দায়িত্ব নিয়ে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। আশার কথা, তারা এগিয়ে আসছেও। তাদের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানাতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে।
এ মাসেই চীন, জাপান, জার্মানি ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উন্নয়ন বিষয়কমন্ত্রী এবং মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ১৮ থেকে ২১ তারিখের মধ্যে তারা আসবেন। এখান থেকে তারা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে ‘এশিয়া-ইউরোপ মিটিং’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দেবেন। মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুতেই বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের আলোচনা হবে। তাদের কেউ কেউ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনেও যাবেন। বাংলাদেশের অবস্থান ও অবস্থা তাদের কারো অজানা নেই। তবু আরো ভালোভাবে জানানোর ও সমর্থন লাভের এটা একটা বড় সুযোগ। উল্লেখ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান হত্যাকাÐ, নির্যাতন ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা প্রভৃতি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রায় শুরু থেকেই সোচ্চার। তারা নানাভাবে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিএ সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এসেছে। একটি বিবৃতিও সিপিএ’র তরফ থেকে দেয়া হয়েছে। ৫২ জাতির এই সংস্থার পার্লামেন্ট সদস্যরা সর্বসম্মতিতে যে বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়েছে, তাতে গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিঃশর্তভাবে দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহŸান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা যে মানবেতর ভয়ংকর সংকটের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে, সে সংকটের সমাধান করতে এগিয়ে আসার ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিবৃতিতে আহŸান জানানো হয়েছে। এই সঙ্গে বিবৃতিটি মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি সিপিএভুক্ত সকল দেশের সংসদ সদস্য, জাতিসংঘের মহাসচিব এবং সংশ্লিষ্ট সকল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সিপিএ’র সেক্রেটারি জেনারেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি এবং সিপিএ’র বিবৃতির মধ্যে মিয়ানমারের প্রতি স্পষ্ট বার্তা রয়েছে। এই দুটি বিবৃতির মধ্যে দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ আরও দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেকটাই স্বস্তির ব্যাপার। তবে এতে আত্মতুষ্টি লাভের কোনো সুযোগ নেই। যত দ্রæত সম্ভব এই ইস্যুর ইতি টানার মধ্যেই প্রকৃত সাফল্য নিহিত রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুর সন্তোষজনক ও স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার পূর্বাপর আহŸান জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে যে সাড়া পাওয়া গেছে তা আশাব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক। আমরা প্রত্যাশা করি, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একই সমতলে দাঁড়িয়ে এই গুরুতর ইস্যুর নিরসনে যথাযথ ভূমিকা ও ব্যবস্থা নেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক চাপ ও পদক্ষেপ ছাড়া এই ইস্যুর নিশ্চিত ও স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।