Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক মহল

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ৮:২৯ পিএম

সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের আসন্ন ওই নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এখনই তৎপর হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মহল। ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দূতিয়ালি করছেন। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের পরামর্শ অব্যাহত রেখেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে দূতিয়ালিও করে। এখন সে অবস্থানে নেই ভারত। ক্ষমতাসীন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরে এসে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন দিল্লী চায় সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থাকার পাশাপাশি তারা জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র ব্যাপারেও তৎপর। জাতিসংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ-সুষ্ঠু হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানুষের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল সব সময় তৎপর। সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে কমনওয়েলথের মহাসচিব এমেকা এনিয়াকুর বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়াম ঢাকা সফর করে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেন। নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর জাতিসংঘ আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঁচ ধরনের কারিগরি সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এই সহায়তার আওতায় নির্বাচনের প্রস্তুতি, বায়োমেট্রিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন কার্যক্রমের মানোন্নয়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং ভোটারদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী সহিংসপ্রবণ এলাকা নির্ধারণ করে সহিংসতা প্রতিরোধ এবং আইন-বিধি (কোড অব কন্ডাক্ট) মেনে চলার বিষয়ে ইসির মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা ও ইসির স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রস্তুত।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কেবল অংশগ্রহণমূলক নয়, এটি অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘ বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেখতে চান। নির্বাচনের বিষয়ে দেশের জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংহত ও শক্তিশালী করতে জাতিসংঘের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে আমরা আমাদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী স্টেক হোল্ডারদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। জাতিসংঘ আওতার বাইরে গিয়ে কখনো কোনো কাজ করে না। জাতিসংঘ যেমন নির্বাচনের সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে; তেমনি কানাডাও সহায়তার কথা বলেছে। কানাডা দীর্ঘদিন থেকে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা করে থাকে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে পর তারা সেই সহায়তার ধারা সংকুচিত করে। সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ নির্বাচনের আয়োজন হলে তারাও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে বলে জানিয়েছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব সম্প্রতি ঢাকা সফর করেন। ঢাকায় তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন, নরেন্দ্র মোদী চায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সেটাই প্রত্যাশা করে বলে তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জানিয়ে দেন। এর কয়েক দিন পর অক্টোবরের শেষের দিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফর করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের নীতি নির্ধারকসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন। বৈঠকের দেশের চলমান অবস্থা তুলে ধরা হলে তিনি জানান, বিজেপি কোনো একক দল বা ব্যক্তি নয়; রাষ্ট্র এবং দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। বাংলাদেশে যাতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয় সেটাই প্রত্যাশা করে দিল্লী। এর আগে মার্কিন একজন উপমন্ত্রী এবং বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ঢাকা সফর করে কার্যত একই ধরণের বার্তা দিয়েছেন। দেশের বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের কারণেই আমেরিকা জিএসপি সুবিধা ফিরে দেয়নি; ইউরোপীয় ইউনিয়নও জিএসপি সুবিধা সংকুচিত করে নিয়েছে।
মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও অন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের তৎপরতা চলছেই। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে। আবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বানিকার্ট। বিদেশী দুই কূটনীতিক কার্যত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয় তারা বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, নতুন চ্যালেঞ্জ, তাদের প্রত্যাশা ও সহযোগিতার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেন। ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যেন না হয় তেমনটাই প্রত্যাশা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আবার নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আগ্রহী ভারতও। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কারিগরি কোন বিষয়ে বাংলাদেশ সহযোগিতা চাইলে ভারত দেবে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত আর কখনও হস্তক্ষেপ করবে না বলেও তিনি মোদী সরকারের অবস্থান জানান।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে। ইউরোপের এই বৃহত্তর জোটের প্রত্যাশা ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের সব দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। সরকার সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নেবেল প্লেয়িং ফি- গতে তুলবে। গত ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুশাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক সাব গ্রুপের বৈঠক। ওই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন দেখতে চায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সময় নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যুন। গত ৯ মে ইউরোপ দিবস উপলক্ষে ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৈশ্বিক এজেন্ডা হিসেবে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করে। তিনি বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কাম্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন চাইলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই কমিশন শক্তিশালী করতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে। নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট কোন সহায়তা চাইলেও ইইউ প্রস্তুত আছে। আন্তর্জাতিক মহলের মতোই দেশের বিশিষ্টজন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও চান গণতন্ত্রকে রক্ষার প্রয়োজনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অপরিহার্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ