Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুখ্যাত বেলফুর ঘোষণার শত বছর

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফুরের লেখা চিঠিটা পৌঁছলো ব্রিটেনের প্রভাবশালী ইহুদি নেতা লর্ড লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে। ইংরেজিতে লেখা কয়েক লাইনের সে চিঠিটার বাংলা ভাষান্তর এ রকম:
‘আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাকে জানাচ্ছি যে, হিজ ম্যাজেস্টি’র সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ইহুদিদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে নিন্মোক্ত ঘোষণা প্রদান করছে: হিজ ম্যাজেস্টি’র সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতি অনুকূল মনোভাব ব্যক্ত করছে এবং এ লক্ষ্য অর্জনে ব্রিটিশ সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। এখানে সুস্পষ্টভাবে বোঝানো হচ্ছে যে, ফিলিস্তিনের বর্তমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার অথবা অন্য যে কোনো দেশের ইহুদিদের ভোগকৃত অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদার প্রতি বিদ্বেষমূলক হতে পারে এমন কিছু করা হবে না। আমি কৃতজ্ঞ হব যদি আপনি এই ঘোষণাটি জিওনিস্ট ফেডারেশনকে জানিয়ে দেন।’
এই হচ্ছে ইতিহাসের কুখ্যাত সেই বেলফুর ঘোষণা। এ ঘোষণায় এমন একটি স্থানে ইহুদিদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয় যেখানকার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ফিলিস্তিনি। পরে ১৯২২ সালে ইহুদি নেতা চাইম ওয়েইজম্যানের সাথে এক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফুর ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ বলেন, বেলফুর ঘোষণার অর্থ চূড়ান্তভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তুর্কি শাসনের বিরোধিতা করার বিনিময়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়েছিল ব্রিটিশরা, যে কারণে ফিলিস্তিনে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরালো রূপ লাভ করেছিল।
বেলফুর ঘোষণার পর আরবরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি রাজনীতিক ও জাতীয়তাবাদী নেতা আওনি আবদ আল হাদি বলেন, ফিলিস্তিনের সাথে সম্পর্কহীন এক ব্যক্তি আরেক বিদেশীর কাছে ইহুদিদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করতে পারে না। ১৯২০ সালে হাইফায় এক ফিলিস্তিনি কংগ্রেসে বেলফুর ঘোষণার তীব্র নিন্দা ও তা আন্তর্জাতিক আইন ও স্থানীয় জনগণের স্বার্থ বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি নেতা নবি মুসা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। এ সময় ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ ফিলিস্তিনি ও ৫ ইহুদির প্রাণহানি ঘটে।
তবে তখনো কেউ এই সর্বনাশা ঘোষণার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা করতে পারেনি। বিশ্বের বহু গোলমাল ও অশান্তির স্রষ্টা ফিলিস্তিনের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার সেদিন মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক বিষফোঁড়ার জন্ম দিয়েছিল এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ইহুদি রাষ্ট্রের যে বীজ সেদিন তারা বপন করেছিল, ৩১ বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তার ষোলকলা পূর্ণ হয়। ব্রিটেন ও তার সহযোগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ৫৩১টি ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর উচ্ছেদ করে ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্বর, খুনী, বিবেকহীন ইহুদিদের হত্যা, ধ্বংস ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের নির্মম ও নিষ্ঠুরতার অসহায় শিকার হয় ফিলিস্তিনিরা। এরপর থেকে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সহযোগিতায় অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনি ভূখন্ড অধিগ্রহণ করে চলেছে ইসরায়েল। ৭০ বছর ধরে চলছে সেখানে মানুষ ও মানবতার নিত্য লাঞ্ছনা ও অবমাননা।
সারা বিশে^র ফিলিস্তিনিরা ২ নভেম্বর অভিশপ্ত বেলফুর ঘোষণার শততম বার্ষিকী পালন করছে। বেলফুর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বাসভ‚মি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেনের অঙ্গীকার। এ ঘোষণাই পরে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনিরা কয়েকশ’ বছর ধরে ছিল ওসমানীয় খিলাফতের শাসনাধীনে। প্রথম মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তিভুক্ত দেশ তুরস্কের পরাজয়ের পর তৎকালীন অন্যতম প্রধান বিশ্বশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স ওসমানীয় খিলাফতকে ভেঙ্গে ফেলার ও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে দেয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তারই অংশ হিসেবে সৃষ্টি করা হয় ইরাক, জর্দান, সিরিয়া ও লেবানন নামে চারটি দেশ। এর মধ্যে ইরাক ও ট্রান্স জর্দান (পরে জর্দান) হয় ব্রিটিশ আশ্রিত এবং লেবানন ও সিরিয়া হয় ফরাসি আশ্রিত। অন্যদিকে ইহুদিদের দাবির মুখে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি বাসভ‚মি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেন। এভাবেই তৈরি হয় মধ্যপ্রাচ্যের অভিশাপ ইসরাইলের রূপরেখা। ১৯০১ সালের আগে ফিলিস্তিনে ইহুদিরা ছিল জনসংখ্যার ৩ শতাংশ। পরিকল্পনা মোতাবেক শুরু হয় ফিলিস্তিনে ইহুদি আগমন ও জমি ক্রয়। ১৯১৪ সালে তারা হয় জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। বেলফুর ঘোষণার সময় ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ছিল ইহুদি। ১৯২২ সালের এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ৭ লাখ ৫২ হাজার ১৮১ জন জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। এভাবে ১৯২২ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ২২ শতাংশ হয়ে দাঁড়ায় ইহুদিরা।
ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্য, যে ইহুদিরা শত শত বছর ধরে ছিল তাদেরই সংখ্যালঘু ও শাসন ক্ষমতাহীন প্রতিবেশী, আজ সে ইহুদিরাই হয়েছে তাদের শাসক তথা দন্ডমুন্ডের কর্তা। গ্রামের পর গ্রাম, এলাকার পর এলাকায় পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করার, প্রতিবাদ করলে গুলি করে হত্যার, গ্রেফতারের, বছরের পর বছর বিনাবিচারে কারাগারে আটক রাখার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ইহুদিরা। কে কাকে শাসন করবে, কে ক্ষমতায় থাকবে আর কে ক্ষমতা হারাবে এটা সর্বদাই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় সত্য। কিন্তু প্রায়শই যে শক্তিমান মানুষের ইচ্ছা শক্তিহীন মানুষদের জীবন ও ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তারই জাজ¦ল্যমান প্রমাণ ইসরাইল। আর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিগুলো একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় জনগোষ্ঠিকে ক্রমাগত শক্তিশালী করার মাধ্যমে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে, আধুনিক বিশ্ব তার দৃষ্টান্ত ফিলিস্তিন। বিগত কয়েক দশকে ৬০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে সিরিয়া, ইরাক, মিসর, লেবানন, জর্দান, সউদি আরব, কুয়েত, তিউনিসিয়াসহ বিশে^র দেশে দেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজেছে। অন্যদিকে বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে ৬০-৭০ লাখেরও বেশি ইহুদি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ফিলিস্তিনের মাটিতে। তারা আসছেই আর ক্রমাগত ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
ইতিহাসের পাতা খুলে দেখা যায়, ইহুদিরা হচ্ছে এক অভিশপ্ত সম্প্রদায়। বিশে^র নানা দেশে তারা বসবাস করেছে, কিন্তু কোথাও তারা স্থানীয় জনসমাজের সাথে মিশে যেতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থের বাইরে অন্যের স্বার্থ তাদের কাছে বরাবরই ছিল গৌণ। এক সময় তারা ফিলিস্তিনে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পরে অন্তর্কলহের শিকার হয়ে তারা ক্ষমতা হারায়। রোমকরা তাদের বিতাড়িত করলে তারা আবার বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ইতিহাস আরো বলে, ইহুদিরা ক্ষমা করতে শেখেনি কোনোদিন। পরাজিত শত্রুর প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শন করার গুণের অধিকারী তারা ছিল না কোনোদিন- সেদিনও না, আজও নয়। তাদের ধর্মগ্রন্থের একই বাণী তারা শিখেছে, জীবন নিয়ে জীবন দেবে। চোখের বদলে চোখ। দাঁতের বদলে দাঁত। হাতের বদলে হাত। পায়ের বদলে পা।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বলে বেলফুর ঘোষণার পরপরই ফিলিস্তিনে নীল নকশা অনুযায়ী ইহুদিদের আগমন শুরু হয়। প্রথমদিকে দরিদ্র ফিলিস্তিনিরা নগদ অর্থের প্রলোভনে ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রি শুরু করে। ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এ কার্যক্রম বেশ জোরেশোরে চলে। তারপর শুরু হয় বলপ্রয়োগে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা। আরবদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টির জন্য ইহুদিরা গুপ্ত সশস্ত্র বাহিনী সৃষ্টি করে। ১৯৪৮ সালে ঘটে নকবা বা গণবাস্তুচ্যুতির ঘটনা। ইহুদিরা সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে ইসরাইল ত্যাগ করতে বাধ্য করে। বর্তমানে প্রবাসী ফিলিস্তিনিরা ছাড়াও ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২৫ লাখ ও গাজায় ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজ জন্মভ‚মিতে বন্দী ও অধিকারহীন অবস্থায় দিনযাপন করছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৪৮ সালের পর থেকে প্রতিবছর ২ নভেম্বরকে কালো দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ফিলিস্তিনি জনগণসহ বিশ্বের মুসলমানরা। এদিকে বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনি ও বিবেকমান মানুষ যখন অভিশপ্ত বেলফুর ঘোষণার শততম বার্ষিকীতে ব্রিটেনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছে তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এদিন তিনি লন্ডনে শিশু-কিশোর-নারীসহ অসংখ্য নিরীহ ফিলিস্তিনি হত্যাকারী ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে অভ্যর্থনা জানাবেন। ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তেরেসা মে বলেন, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আমরা যে ভূমিকা পালন করেছি সেজন্য আমরা গর্ববোধ করি এবং আমরা গর্বভরে সে ঘটনার শতবর্ষ উদযাপন করব। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বেলফুর ঘোষণার ব্যাপারে কিছু মানুষ যে স্পর্শকাতরতা দেখায় সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আমরা জানি, এ ব্যাপারে আমাদের আরো অনেক কর্তব্য রয়ে গেছে। বেলফুর ঘোষণার শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত নৈশভোজে তিনি ও নেতানিয়াহু যোগ দেবেন। তবে এ উৎসবে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন উপস্থিত থাকবেন না বলে জানিয়েছেন। তার পক্ষে দলের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব এমিলি থর্নবেরি এতে উপস্থিত থাকবেন।
অন্যদিকে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বেলফুর ঘোষণা দিবস উদযাপনের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক কামাল হাওয়াশ বেলফুর ঘোষণার মতো অপরাধের জন্য ব্রিটেনকে ক্ষমাপ্রার্থনা করার আহবান জানান। তবে গত এপ্রিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের করা আবেদনের জবাবে ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলে, এটি এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। ব্রিটিশ সরকার এ জন্য গর্ব বোধ করে। এর জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্ষমা প্রার্থনা করবে না।
শক্তির জোরে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ফিলিস্তিনের মাটিতে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের আরোপ করা রাষ্ট্র ইসরাইলকে মেনে নেয়নি আরব দেশগুলো। আরব দেশগুলো বারংবার চেষ্টা করছে ইসরাইল নামক বিষফোঁড়া থেকে মুক্তি পেতে। এ নিয়ে ১৯৪৮, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে তিনটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধে শক্তি ও সমর্থনের প্রবল ছায়া বিস্তার করে ইসরাইলের পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ গোটা পাশ্চাত্য। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিকসহ সর্বাত্মক সমর্থন পেয়ে আসছে। প্রতিটি যুদ্ধেই আরবরা দেখেছে, তারা ইসরাইল নয়, বিশ্বের অমিত শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে, যে কারণে প্রতিটি যুদ্ধই তাদের জন্য পরাজয় ও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। পাশাপাশি ষাটের দশকে ফিলিস্তিনকে ইসরাইলের দখলমুক্ত করার জন্য শুরু হওয়া ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) এই নগ্ন বাস্তবতা থেকে আরবরা উপলব্ধি করে যে সামরিকভাবে ইসরাইলকে পরাজিত করা বা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কখনোই সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তাদের সমর্থক পশ্চিমা গোষ্ঠিও এটাই চাইছিল। তাই ১৯৭৩-এর পর বিদ্যমান বাস্তবতা থেকে ফিলিস্তিনি স্বার্থের তিন সম্মুখসারির দেশ মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার সাথে মার্কিন দৌত্যে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলের অস্তিত্ব ও তার টিকে থাকার অধিকারকে স্বীকার করে নেয় প্রবল ইসরাইল বিরোধী মুসলিম বিশ্বের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। অর্জিত হয় ইসরাইলের বহুকাক্সিক্ষত বিজয়। কিন্তু ফিলিস্তিন আজো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। স্বদেশের মাটিতে ফেরার অনিঃশেষ আকাক্সক্ষা বুকে নিয়ে দেশে দেশে উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে স্বদেশচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। এদিকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের গুরুতর লংঘন ঘটিয়ে অধিকৃত এলাকায় ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনি ভ‚মি দখল করে তাদের বাস্তুচ্যুত করে চলেছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইসরাইলকে সমর্থন অব্যাহত রাখায় তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অক্ষম। অন্যদিকে অপর দু’বিশ্ব শক্তি রাশিয়া ও চীন নানা বিষয়ে যুক্তরষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ইসরাইলের অন্যায় পদক্ষেপ ও অমানবিক আচরণের ব্যাপারে নীরব। বাস্তবে ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে দু’দেশই। এমনকি এককালে আরব বিশ্ব ও ফিলিস্তিনিদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত অপর উদীয়মান বিশ্বশক্তি ভারতও আজ ইসরাইলের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব ও সামরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ। বরং ইসরাইলের অব্যাহত একগুঁয়ে আচরণে বিরক্ত হয়ে দেশটির অন্ধ সমর্থক বলে পরিচিত পশ্চিমাদেশগুলোর কারো কারো অবস্থান বিগত দশকে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে আংশিক ইসরাইল বিরোধিতায় রূপ নিয়েছে। তবে তা ফিলিস্তিনিদের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণে এখনো সহায়ক নয়।
ইসরাইলদরদী ব্রিটেন ফিলিস্তিনিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বেলফুর ঘোষণার মধ্য দিয়ে শত বছর আগে রক্তপাত, অর্ধকোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ও মানবাধিকার লংঘনের যে কলংকিত ইতিহাস রচনা করেছিল, আজো তার বিষময় ফল বয়ে চলেছে ফিলিস্তিনিরা। নিজভূমে তারা পরবাসী। তাদের অন্তহীন বেদনার ভার কবে লাঘব হবে, কবে তারা নিজ মাতৃভূমিতে একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তা কেউ জানে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ