পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
২৫ বছরে অর্ধেকই ঝাউবন ধ্বংস : দুর্যোগের ঝুঁকিতে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ : জনবসতি ফল-ফসল জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য বিপন্ন : বনখেকো ও ভূমিদস্যুদের নেপথ্যে ‘বনের রাজা ওসমান’ : দৈনিক কোটি কোটি টাকা লেনদেন
সমগ্র দেশে বনভূমি ও বনজ সম্পদের ধ্বংসলীলা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বনখেকো ও বনভূমির দস্যুরা। তাদের সাথে একাট্টা হয়ে নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংসের তান্ডবের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজশ রয়েছে বনবিভাগের ‘বনের রাজা ওসমান গনি’র মতো দুর্লোভী অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বন উজাড় করে কাঠ পাচারের নেপথ্যে লেনদেন হচ্ছে দৈনিক কোটি কোটি টাকা। মূল্যবান বন ও বনজ সম্পদ ধ্বংসের কর্মকান্ডে সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে দেশের সমগ্র সমুদ্র উপকূলভাগ চর ও দ্বীপাঞ্চলের বনাঞ্চল নিধনের কারণে। ‘গ্রিন বেল্ট’ বা ‘উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী’ উজাড় করে দেয়া হচ্ছে প্রতিদিনই নির্বিচারে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ বছরে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৫০ শতাংশেরও বেশি সুশোভিত ঝাউবন উজাড় হয়ে গেছে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসসহ বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্বিপাক এবং জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। উপকূলের জনবসতি, ফল-ফসল, উদ্ভিদরাজি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য বিপন্ন হচ্ছে মারাত্মক আকারে। মানুষের জীবন-জীবিকা ও জনস্বাস্থ্যের উপরও পড়ছে এর অনিবার্য বিরূপ প্রভাব।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোঃ শফিউল আলম গতকাল (শুক্রবার) ইনকিলাবকে বলেছেন, উপকূলীয় বনজ সম্পদ ধ্বংসকারীদের আগে চিহ্নিত করতে হবে। এর পেছনে যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি ঘের, লবণ চাষ এবং শিপব্রেকিং ইয়ার্ড তৈরি অনেকাংশে দায়ী। উপকূলে এ ধরনের কাঠামো সুষ্ঠু পরিকল্পনা সহকারে করতে হবে। তাছাড়া জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও কাঠ পাচার করে কেওড়া বনসহ সবুজ বেষ্টনী উজাড় করে দেয়া হচ্ছে। একইভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে ঝাউবীথি। উপকূলীয় বনাঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। অতীতে এই বনাঞ্চল পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু তা ক্রমেই বিরান হওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভোগ করছি। জনবসতি, ফসল, ক্ষেত-খামার, প্রান্তিক অর্থনীতি ও সহায়-সম্পদ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তিনি আরও জানান, উপকূলের যেসব জায়গায় দুর্যোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি সেসব এলাকায় আবার নতুন করে উপকূলীয় বান্ধব বনায়ন করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তা সংরক্ষণের জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠি যাতে উপকূলের গাছপালা কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে এরজন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প জ্বালানির সংস্থান করতে হবে। এর পাশাপাশি বন বিভাগের জনবল বৃদ্ধি করে এর দক্ষতা, স্বচ্ছতা আরও নিশ্চিত থাকা প্রয়োজন।
এদিকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের জনগণের জন্য দুর্যোগে প্রাকৃতিক ‘ঢাল’ বা ‘বর্ম’ হিসেবে বহুমুখী গুরুত্ব বহন করছে বন-জঙ্গল। আর তা বেপরোয়া ধ্বংস করছে সংঘবদ্ধ বনখেকো দুর্বৃত্তরা। বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড, স›দ্বীপ, বন্দরনগরীর হালিশহর-কাট্টলী, আনোয়ারার পার্কি থেকে শুরু করে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, উখিয়া, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে প্রতিনিয়তই চলছে সবুজ বেষ্টনীর ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সুশোভিত ঝাউবীথি উজাড় করে দেয়া হচ্ছে বন বিভাগের কর্তাদের নাকের ডগায়। এর বেশিরভাগই জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ অপরূপ বালির সৈকত (স্যান্ডি বীচ) সুরক্ষার জন্য ঝাউবীথি অপরিহার্য প্রাকৃতিক বর্ম। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতজুড়ে পর্যটক আকর্ষণে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ঝাউবীথি। উপকূলে বনাঞ্চলও সৃজন করা হয়। যা কালক্রমে অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
বিগত ২৫ বছরের ব্যবধানে সৈকত ও আশপাশ এলাকায় শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি ঝাউবীথি বিরান হয়ে গেছে এবং ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে প্যারাবন। এ বিষয়টি বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। উক্ত সময়ের মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংসকরণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছে ‘চকরিয়ার সুন্দরবন’। উপকূলীয় ঝাউবন-বীথি ও প্যারাবন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে সৈকত ঘিরে থাকা প্রকৃতির প্রাচীর পাহাড়-টিলা ও উঁচু ভূমি কেটে-খুঁড়ে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব-নির্বিকার। বন খেকো, বনের ভূমিদস্যু, ‘বনের রাজা ওসমান’দের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর উপকূলে, খাল ও খাঁড়িগুলোতে চলাচলকারী দেশীয় কার্গোজাহাজ, ট্যাংকার, কোস্টার, ট্রলারসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক নৌযানের বর্জ্যতেল কিংবা পোড়া জ্বালানি তেলের নিঃসরণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ধ্বংসের মুখে পড়েছে উপকূলের গাছপালা।
পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্যই রয়েছে উপকূলের বন-জঙ্গল। অথচ এই বনাঞ্চল গত ৩০ মে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ইতিপূর্বে ‘আইলা’ ‘সিডর’, ‘রোয়ানু’ ‘নার্গিসে’র মতো দুর্যোগকে বুক তছনছ করে ঠেকিয়েছে। উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক বর্মের মতোই আগলে রেখেছে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগকে। অথচ নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে সাগর উপকূলের বনভূমি। হুমকির মুখে পড়েছে বন্য জীবজন্তু পাখ-পাখালির নিরাপদ চারণভূমি, বিরল ও মূল্যবান উদ্ভিদরাজি, হরেক জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতির ঢাল বা বর্ম বৃক্ষরাজির ঢাল যতই বিপন্ন হচ্ছে ততই উপকূলীয় ভূমির গঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে। আকার-আয়তনও হ্রাস পাচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুন। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সমগ্র উপকূল। টেকনাফ থেকে শুরু করে সীতাকুন্ড অবধি সমুদ্র সৈকতে ঝাউগাছ, কেওড়া গাছ কেটে সাবাড় করে দেয়ার মধ্যেই উপকূলের বন উজাড় থেমে নেই। বঙ্গোপসাগর উপকূলভাগে চর ও দ্বীপাঞ্চল জুড়ে দেশের ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখা বরাবর বন-জঙ্গল কেটে উপকূলকে বৃক্ষশূণ্য করা হচ্ছে। উপকূলীয় বন বিভাগ পরিণত হয়েছে হরিলুটের আখড়ায়। যথাযথ তদারকির অভাবে অনিয়মই সেখানে নিয়ম।দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নেই কোন বালাই। উপকূলে নতুন করে বনায়ন আর পরিচর্যার নামে নয়-ছয় গোঁজামিল করে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করছে দুর্নীতিবাজ চক্রটি। উপকূলে ম্যানগ্রোভ বন রক্ষকদের ভক্ষকের ভূমিকায় জড়িত অসৎ চক্রটি থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে সম্প্রতি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) সফিউল আলম চৌধুরীর সততা, দক্ষতা, কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ফলে বনদস্যুরা এবং ‘বনের রাজা ওসমান’রা কিছুটা তটস্থ হয়ে হলেও অসৎ সিন্ডিকেট এখনও দমেনি। নেপথ্যে চালিয়ে যাচ্ছে তাবৎ অপকর্ম, হরিলুট আর দুর্নীতির ভাগ-বাটোয়ারা।
এদিকে বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, উপকূলীয় অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কিনারভাগে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছাড়াও উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত পাহাড় টিলা বা উঁচুনিচু ভূমি কাটা বা পরিবর্তন করা হচ্ছে সমানে। বন-জঙ্গলে বিভিন্ন জাতের গাছপালা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। গত প্রায় এক দশকে ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিরল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। উপকূলে গাছপালা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, হরেক জীববৈচিত্র্যের বিচরণ ও বংশবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। এতে করে সামগ্রিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। আগে দেখা যেতো বিভিন্ন পাখি গাছে বিচরণকালে ফলমূল খেতে গিয়ে গাছের উপর থেকে যে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে তাতেই বট, অশ্বথ, আম-জামসহ বহু জাতের গাছপালা গজিয়ে ওঠে। মানুষের হাতের ছোঁয়া বা কোন যত্ম ছাড়াই গাছগুলো বড় হয়ে ঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত হয় পাহাড় আর উপকূল। অথচ এখন পাখির বিচরণযোগ্য বৃক্ষরাজি কমে আসার সাথেই এই প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাবে বৃক্ষরাজি তেমন আর বাড়ছে না।
এ অবস্থায় বিভিন্ন জাতের গাছপালা বাংলাদেশের উপকূল সংলগ্ন পাহাড় টিলা ও উঁচুনিচু উপত্যকাময় উর্বর পললভূমি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু কেওড়া বা ঝাউবীথি নয়- উপকূলে বা এর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে যেসব গাছপালা এখন প্রায় বিলুপ্তির মুখে এর মধ্যে রয়েছে, বাবলা, হরতন, বট, অশ্বথ, মান্দার, তেলসুর, চাপালিশ, গামার, মেহগনি, বহেরা, নিম, তেঁতুল, জাম, ঢাকিজাম, শিমূল, শিশু, কাও, ডালিম, বাইন, হারতকি, গাব প্রভৃতি। গাছাপালা কমে গিয়ে মানুষের বন্ধু পাখি, পোকা ও জীবজন্তু তাদের বংশ বিস্তারে সহায়ক পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।