চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
হযরত উম্মে হাকিম (রা.)-এর ঘটনা। তিনি নিজ অনুসন্ধানে সত্য দীন কবুল করেছিলেন। নিজে সত্যের ঠিকানা পাওয়ার পর তার মনের মাঝে স্বীয় স্বামীকে বাঁচানোর ইচ্ছা জাগে। তার স্বামী ছিল আবু জাহলের পুত্র ইকরামা। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় এবং দোয়ায় স্বামীকেও মুসলমান বানিয়ে নেন। স্বামীকে ইসলাম কবুল করাতে তিনি কত প্রিয় এবং মহব্বত ভালোবাসা ভরা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। হযরত উম্মে হাকিম (রা.)-এর মুসলমান হওয়ার কৃতিত্বের মুকুট তার শিরেই সুশোভিত হয়ে আছে। মুসলমান হওয়াটাই মাধ্যম হয়ে গেছে স্বামীকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার। স্বামীর আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার সম্মান মর্যাদা আর কৃতিত্বের নিদর্শন তাঁর ললাটেই অংকিত। তাঁর ভাগ্যেই একজন মুজাহিদকে প্রস্তুত করার চিরকল্যাণ অবধারিত হয়ে আছে। তাঁরই খেদমত, সেবা, পরিচর্যা, সঙ্গ, সাহচর্য, প্রবোধ, সান্ত্বনা স্বামীকে শহীদের মর্যাদাদানের বিনিময়। তাঁরই নির্ভীকতা, সাহসিকতা, বাহাদুরির ওপর প্রভাব রয়েছে মামা খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-এর। ইতিহাসের অম্লান পৃষ্ঠায় দু’জন শহীদ স্বামীর স্ত্রী হওয়ার গর্ব অহংকার তাঁরই।
হযরত উম্মে হাকিম (রা)-এর জীবন আমাদের মুসলমান বোনদের জন্য তাদের স্বামীদের মুসলমান বানানোর আদর্শ নমুনা। আজও যদি মুসলমান স্ত্রীরা তাদের সেসব স্বামীর পেছনে মেহনত করেন, যারা ইসলামের কোনো বিধান থেকে উদাসীন ও অমনোযোগী অথবা এমন কোনো কাজ করে চলেছে যাতে মালিক, মনিব, প্রভু পরওয়ারদেগার, দয়ালু মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হবেন; তাহলে তারা উম্মে হাকিম (রা)-এর সাথি হয়ে জান্নাতে থাকবেন।
আজো যদি আমাদের মুসলমান বোনরা তাদের স্বামীদের শোধরাতে এসব উপায় অবলম্বন করেন যেসব উপায় হযরত উম্মে হাকিম (রা.) স্বামীকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণে অবলম্বন করেছিলেন, তাহলে তারাও স্বামীদের জাহান্নামের পথ থেকে ফিরিয়ে জান্নাতের পথে তুলে আনতে সফল হবেন।
এ জন্য প্রথম করণীয় হচ্ছে, স্বামীর প্রতি অকৃত্রিম মহব্বত ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হবে। এর পন্থা হচ্ছে অনুগমন এবং তাদের আদেশ নিষেধ মানা। সুতরাং কোনোভাবে স্বামীর নাফরমানি অবাধ্যতা করা, তাদের সামনে মুখ ছড়ানো অথবা নিজের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রæটি-বিচ্যুতি অস্বীকার করা উচিত নয়। শক্ত কথা বলে, রাগ ক্রোধ প্রদর্শন করে, বেয়াদবিপূর্ণ কোনো কথা বলে স্বামীকে অসন্তুষ্ট করতে যাবেন না।
তাছাড়া খুব বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া প্রার্থনা করবেন যে, হে আল্লাহ! আমার স্বামী, পুত্র ও ভাইদের নামাযী দীনদার গুনাহ থেকে আত্মরক্ষাকারী, নেক কাজের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণকারী বানিয়ে দিন! তাদেরকে জগতময় দীন প্রচার-প্রসারকারী মুজাহিদ এবং দীনের প্রতি আহ্বানকারী বানিয়ে দিন! তাদের শহীদী জীবন দান করুন! তাদের কবরসমূহকে দূর দূরান্তের দেশসমূহে আল্লাহ তায়ালার দীন, মুহাম্মদী ফুলবাগানে পানি সিঞ্চনের মাধ্যম নির্ধারিত করুন! তাদের হাত থেকে ভীরুতা কাপুরুষতার চুড়ি ও কান থেকে ভয়ভীতির কালি নামিয়ে দিন! তাদের অন্তর থেকে চিরকাল দুনিয়ায় অবস্থানের ধ্যান খেয়াল বের করে দিন! হে আল্লাহ! আপনার নিজের এবং আপনার মহব্বত ভালোবাসা দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত দ্বারা তাদের অন্তর্জগত সবুজ শ্যামল, সজীব প্রাণবন্ত করে দিন! আপনার দীনের জন্য জীবনদান সহজ করে দিন।
আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করার পাশাপাশি ঘরে ঝগড়াঝাটির আগুন না লাগিয়ে মহব্বত ও ভালোবাসা, স্নেহ ও করুণাভরা ভঙ্গিতে শালীন শোভন পন্থায় তাদের দীনের দাওয়াত দিন। স্বামী-সন্তান যদি হারাম পন্থায় আয় উপার্জনে জড়িত থাকে, মিথ্যা বলে সওদাপাতি, ব্যবসায় পণ্য বিক্রি করে, হারাম পণ্য সামগ্রীর ব্যবসা করে, ঘুষ গ্রহণে অভ্যস্ত হয়, মানুষ থেকে কর্জ নিয়ে সময়মতো আদায় না করে- এসব ত্রুটিবিচ্যুতি ও খারাপ স্বভাব যদি তাদের মাঝে থাকে তাহলে সংস্কার সংশোধনের চেষ্টা প্রচেষ্টা চালাবেন। এসব স্বভাব আচরণ যে খুবই খারাপ, গর্হিত ও নিন্দিত এ কথা বারবার বুঝাবেন। তাদের ভালো পরিবেশে পাঠাবেন। মাঝ রাতে উঠে চোখের পানি বইয়ে তাদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করবেন।
হযরত উম্মে হাকিম (রা.)-এর উপরোক্ত আমলগুলো যদি আবু জাহালের পুত্র ইকরামার অন্তঃকরণ মোমের মতো নরম করতে পারে তাহলে আপনার এ আমলগুলো আপনার স্বামী, ভাই ও পুত্রের মন নরম করতে পারবে না কেন! যদি আপনি স্বামী ও পুত্রদের দীনের পথে আনতে, তাদের সংশোধনের উদ্দেশে আন্তরিকতার সাথে এ কাজগুলো করেন, তাহলে আপনার এ আমল, এ কর্মপদ্ধতি অবশ্যই আপনার স্বামী এবং পুত্রদের মন গলাতে ও নরম করতে সক্ষম।
আপনি একবার দরদের সাথে এসব আমল করেই দেখুন না। রাতে ওঠে ফরজ নামাজসমূহের পর তপ্ত অশ্রু বইয়ে দোয়া করুন। সব সময় স্বামীর প্রতি মহব্বত, ভালোবাসা ও আনুগত্য অনুগমন করুন। বিনম্রভাবে দীনের দাওয়াত দিন। তাকে দীনি আমলে উদ্বুদ্ধ করুন। প্রত্যেক দুঃখ কষ্টে সবর সহনশীলতা অবলম্বন করুন। ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মুশকিল আসান করে দিবেন, প্রত্যেক কাঁটা ফুলের করবেন, প্রত্যেক নমরুদের অগ্নিকুন্ড ইবরাহীম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালামের ফুল বাগানের ন্যায় বানিয়ে দেবেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা আপনার যাবতীয় আশা-আকাক্সক্ষা, কামনা-বাসনা পূর্ণ করে দিবেন।
একটু ভাবুন! হযরত উম্মে হাকিম (রা.) স্বামীকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে মক্কা মোকাররমার পাহাড় থেকে বেরিয়ে, আর পাহাড় টিলা ঘেরা মক্কার মরু প্রান্তর কষ্টসঙ্কুুল পথঘাট অতিক্রম করে ইয়েমেনের সমুদ্র উপকূলে উপনীত হয়েছেন। যে যুগে আধুনিক যুগের মতো মোটর গাড়ি, সামুদ্রিক জাহাজ প্রভৃতি কোনো যানবাহনই ছিল না। সেই তখন হযরত উম্মে হাকিম (রা.) ইয়েমেনের সমুদ্রপোক‚লে স্বামীকে পেয়ে যান এবং সেখান থেকে তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে নিয়ে আসেন।
এখানে একটি বিষয় চিন্তা করার মতো। তাহলো, হযরত উম্মে হাকিম (রা) স্বামীর অধিকার আদায় করে ইসলাম প্রচার প্রসারের দায়িত্বও পুরোপুরি আদায় করেন। এতে তিনি অনাগত মুসলমান বোনদের জন্য এ শিক্ষা রেখে গেছেন যে, একজন মুসলিম স্ত্রীর দায়িত্ব শুধু তার স্বামী এবং সন্তানদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়; বরং যেভাবে পুরুষদের দুনিয়াময় ইসলাম প্রচার প্রসারের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি মুসলিম নারীরাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তা পর্যন্তই নবুয়ত রিসালাতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী-রাসূল আগমন করবেন না। সুতরাং দুনিয়ার সব নারী পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করুক, তারা সবাই যথার্থভাবে মুসলমান হোক- এ চিন্তা ফিকির করাও একজন মুসলিম নারীর অত্যাবশ্যক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এজন্য যদি নিজের দেশ ছেড়ে স্বামীর সাথে পরদেশে হিজরত করতে হয় তার জন্যও প্রস্তুত থাকবে।
হযরত উম্মে হাকিম (রা.) দীন ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য সিরিয়া এবং হযরত রোকাইয়া (রা.) মক্কা মোকাররমা থেকে হাবশায় গমন করেছিলেন। হযরত খানসা (রা.) তাঁর পুত্রদের সাথে গিয়েছিলেন ইরাক। হযরত উম্মে হারাম (রা.) সাইপ্রাস দ্বীপে গমন করেন। সেখানেই তাঁর ইন্তেকাল হয় এবং সঙ্গী-সাথিরা তাঁকে সেখানেই দাফন করেন।
এছাড়া আরও বহু মহিলা সাহাবী দীন প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে স্বামী এবং নিজের মুহাররাম পুরুষদের সাথে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে গমন করেছেন। দীন প্রচার প্রসারের উদ্দেশে জন্মভূমি ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে গমনের কারণে তাঁদের কবরও জন্মভূমি থেকে বিভিন্ন দূর-দূরান্তের দেশে হয়েছে।
অতএব অনাগত মুসলিম বোনদের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত এসব মহিলা কবরগুলো তাদের দীন প্রচার প্রসারে চেষ্টা সাধনার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। তারা যেন কবর থেকে মুসলিম বোনদের বলছেন, দেখ বোনেরা! আমরা ঘরবাড়ি জন্মভূমি ছেড়ে আল্লাহর রাস্তায় গমন করেছি, দীর্ঘ পথ সফরের দুঃখ কষ্ট বরণ করেছি, ঠান্ডা গরমের কষ্ট সয়েছি, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার নাম সুউচ্চে তুলে ধরতে চেষ্টা সাধনা, মেহনত ও পরিশ্রম করেছি। এ পথেই যখন মৃত্যুর সময় এসেছে, আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে আহŸানকারী এসে গেছে, তখন আমরা সফরেই আল্লাহর আহŸায়কের আহŸানে সাড়া দিয়েছি। যেখানে আমাদের মৃত্যু হয়েছে আমরা সেখানেই দাফন হয়েছি। অতএব আজকের মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে, অন্তরে দীন প্রচার প্রসারের আগ্রহ অনুরূপ দক্ষতা যোগ্যতা অর্জন করা। নিজের জীবন, মাল, বিবেক, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, যোগ্যতা, চিন্তা-ফিকির সবকিছু আল্লাহ তায়ালার দীন প্রচার প্রসারের কাজে লাগানো। যেন দীন প্রত্যেক পচা ঘরে, কুঁড়েঘরে, ইমারত অট্টালিকায় তথা সর্বত্র জিন্দা হয়। এ চেষ্টা সাধনা এ কাজে মেহনত পরিশ্রম করতে করতে আমাদেরও যেন শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়। আমাদের কবরও যেন আল্লাহ তায়ালার পথেই রচিত হয়। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেন আমরা আল্লাহ তায়ালার দীন প্রচার প্রসারের কাজে লেগে থাকি। প্রত্যেক মুসলমান নারীরই নিজের মেয়ে, বোন এবং পুত্রদের জন্য এ কামনাই পোষণ করা উচিত।
লেখক : আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।