Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উম্মাতের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শরীআহ অভিযোজন বর্তমান সময়ে ব্যাপক ব্যবহৃত একটি ফিকহী পরিভাষা। প্রাচীন ফিকহের কিতাবে এ পরিভাষার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, তবে কাছাকাছি কিছু পরিভাষা আছে, আধুনিক সময়ে আলিমগণ বিভিন্নভাবে এই পরিভাষাটি সংজ্ঞায়িত করেছেন। ড. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, শরীআহ অভিযোজন অর্থ উদ্ভূত পরিস্থিতির উপর শরঈ নস প্রয়োগ। কোন মাসআলার শরীআহ অভিযোজন অর্থ উক্ত মাসআলাটিকে (শরীআহ বিরোধী বিধান থেকে) মুক্তকরণ ও তাকে নির্দিষ্ট গণ্য দলীলের সাথে সম্পৃক্তকরণ। এক কথায়, সা¤প্রতিক কোন বিষয়কে শরীআহ’র রঙে রঙিন করাকে বলা হয় শরীআহ অভিযোজন। অর্থাৎ, যেসব বিষয়ে শরীআহ’র সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নেই তাকে শরীআহ’র বিধানের সাথে খাপ খাওয়ানো বা শরীয়াতের বিধানের সাথে তার যোগসূত্র স্থাপন।
আধুনিক সময়ের ফকীহগণের নিকট দু’টি কারণে শরীআহ অভিযোজন শব্দটি বিশেষ গুরুত্ববহ। প্রথমত, সা¤প্রতিক বিষয়গুলো সমকালীন সর্বশেষ অবস্থাসমৃদ্ধ। পূর্ববর্তী ফিকহের কিতাবে যে সম্পর্কে কোন আলোচনা বিদ্যমান নেই। আবার বিষয়গুলো জটিল, দুর্বোধ্য অথচ জীবনঘনিষ্ঠ। এ কারণে এর বিধান নির্ণয় কষ্টসাধ্য। কেননা এক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা প্রয়োজন। অতএব শরীআহ অভিযোজন উক্ত পরিক্রমার একটি পদক্ষেপ ও পর্যায়।
দ্বিতীয়ত, বিগত কয়েক যুগে সভ্যতার উন্নতি ও সমাজব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্ত নেই। এসব উন্নতি ও পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যেসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কিত বিধান গবেষণা করার মত ‘মুজতাহিদ মুতলাক’ (স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চিন্তার অধিকারী শরীআহ উদ্ভাবক) এর অভাব এবং মাযহাবী মুজতাহিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে শরীআহ অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা সা¤প্রতিক বিষয়ে বৈশিষ্ট্য, এর গুণাগুণ বিবেচনা ও তাকে রূপায়নের ক্ষেত্রে এর স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
শরীআহ অভিযোজন শরীআহ’র মূলনীতির ভিত্তিতে শুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে হতে হবে। অর্থাৎ, সা¤প্রতিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিকটতম মূলনীতির মাধ্যমে অভিযোজনক করা যাতে ঐ মূলনীতির বিধানকে উক্ত বিষয়ের বিধান হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এতে কোন জটিলতা নেই। বরং জটিলতা তখনই দেখা দেবে যদি অসামঞ্জস্য মূলনীতির মাধ্যমে অভিযোজন করা হয়। পরিস্থিতিকে শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ রূপায়নের জন্য সাধনা করা। বিষয়টি গবেষক, বিচারক ও আইন বিশ্লেষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কিছু বিধান উক্ত বিষয়ের রূপায়ণেরই একটি অংশ। অতএব যে ব্যক্তি সা¤প্রতিক বিষয় রূপায়ণ করবে তার উচিত এর পূর্ণ ও শুদ্ধ রূপায়ণ করা এবং ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবস্থা, শাখা-প্রশাখা, মূলনীতি ইত্যাদি অবগত হওয়া। মুজতাহিদকে মাসআলা উপস্থাপন ও মূলনীতির সাথে একীভূতকরণের ফিকহী যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
ইসলামী আইন গবেষণার ক্ষেত্রে সম্মিলিত ইজতিহাদ একটি নতুন মাত্রা। ইসলামের প্রাথমিক যুগসমূহে মুসলিম পন্ডিতগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের পারদর্শিতার ফলে ব্যক্তিগত বা একক গবেষণার মাধ্যমে সফলতার সাথে তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয় সম্ভব হলেও বর্তমান সময়ে তা কষ্টসাধ্য। কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ’র দুর্বল অবস্থানের কারণে শেষের শতাব্দীগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার সেই সোনালী সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। যার প্রেক্ষিতে সঠিক ইজতিহাদ করার মত প্রজ্ঞাবান আলিম এর ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে বর্তমানে একক গবেষণার সা¤প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের যোগ্যতাসম্পন্ন গবেষকের অভাব মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে বর্তমান সময়ে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চিন্তা-চেতনার জগতে বিরাট বিপ্লব সাধিত হওয়ায় জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন দিক নিয়ে ইজতিহাদ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহ সম্মিলিত ইজতিহাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।
সম্মিলিত ইজতিহাদ একটি আধুনিক ফিকী পরিভাষা। পূর্ববর্তী উসূলের কিতাবসমূহে এ বিষয়ক স্বতন্ত্র কোন অধ্যায় পাওয়া যায় না। সম্মিলিত ইজতিহাদের পরিচয়ের জন্য ইজতিহাদের সংজ্ঞা আবশ্যক। বিভিন্ন গ্রন্থে ইজতিহাদের অসংখ্য সংজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা ইমাম ফাতুহী র. এর সংজ্ঞাটিকে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য সাব্যস্ত করতে পারি। তিনি বলেন ‘কোন বিষয়ের শরঈ বিধান অর্জনের জন্য ফকীহ কর্তৃক তার শক্তি ব্যয় করা।’ বর্তমান সময়ের কেউ কেউ সামষ্টিক ইজতিহাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন- * ড. আব্দুল মাজীদ শারফী বলেন, বিধান উদঘাটনের পদ্ধতির আলোকে কোন বিষয়ের শরঈ বিধান সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহ কর্তৃক চেষ্টা সাধনা এবং পরামর্শের পর উক্ত বিধানের উপর তাদের সকলের বা অধিকাংশের ঐক্যমত। * ড. আল-আবদু খলীল বলেন, কোন বিষয়ের শরঈ বিধানের উপর কোন যুগের উম্মতে মুহাম্মাদীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুজতাহিদের ঐক্যমত। প্রকৃতপক্ষে সম্মিলিত ইজতিহাদ হচ্ছে- কোন বিষয়ের শরঈ বিধান নির্ণয়ের জন্য একদল আলিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং পারস্পরিক পরামর্শ ও পর্যালোচনান্তে উক্ত বিষয়ের উপর ঐক্যমত্য স্থাপন করাকে সম্মিলিত ইজতিহাদ বলা হয়। যেমন ইসলামিক ফিকহ একাডেমী জিদ্দায় করা হয়ে থাকে।
(চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ