পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্বপ্নের মিনি সিঙ্গাপুরের পথে মাতারবাড়ীর অগ্রযাত্রায় অন্যতম প্রধান অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরটি হবে সমন্বিত এবং বহুমুখী (মাল্টি পারপাস) সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন। মাতারবাড়ী এনার্জি হাবকে ঘিরে পর্যায়ক্রমে এর পরিধি বিস্তৃত হবে আঞ্চলিক ‘হাব পোর্ট’ হিসেবে। যা হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। জাপানের কাশিমা সমুদ্র বন্দরের একই আদলে ভৌত ও কারিগরি অবকাঠামো সাজানো হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) পরিকল্পিত এনার্জি হাব বিশেষত দেশের বৃহৎ বিদ্যুৎ মেগাপ্রকল্প স্থাপন নিয়ে জরিপ-গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নকালে মাতারবাড়ীতে বহুমুখী একটি সমুদ্র বন্দরের সম্ভাবনা খুঁজে পায়। পরিকল্পনাও গ্রহণ করে। বন্দর-শিপিং বিশেষজ্ঞদের মতে, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের প্রেক্ষাপট তিনটি।
এক. বঙ্গোপসাগরের কিনারভাগে বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং ভূ-কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্চেন্ট জাহাজ চলাচলের কেন্দ্রবিন্দুতে এর অবস্থান। সাগরপ্রান্তিক অবস্থানগত সুবিধা গ্রহণ করে পৃথিবীর উন্নত ও মধ্যআয়ের দেশসমূহ গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করেছে কিংবা এখন গড়ে তুলছে। আর এ ক্ষেত্রে সাগরঘেঁষা মহেশখালী মাতারবাড়ী রয়েছে সবচেয়ে অনুকূল ও সুবিধাজনক পয়েন্টে।
দুই. চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের আমদানি-রফতানি প্রবাহের ৯২ শতাংশ সামাল দিতে গিয়ে জাহাজের জট ও কন্টেইনারসহ পণ্যজট, পরিবহন সঙ্কটে হিমশিম অবস্থা। বর্তমানে ২৪ লাখ টিইইউএস’রও বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। যা ২০২১ সালে ৩৬ লাখে উন্নীত হবে। জোয়ার-ভাটা নির্ভর এবং ফিডার পোর্ট হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের কিছু প্রকৃতিগত সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। রয়েছে জেটি-বার্থের ঘাটতি।
তিন. ভারত, শ্রীলংকা, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলো একাধিক গভীর সমুদ্র বন্দর (ডীপ সী পোর্ট) স্থাপন করেছে এবং নতুন নতুন মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে। এমনকি মিয়ানমারের রাখাইনে (আরাকান) বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করা হচ্ছে। চীনা বৃহৎ বিনিয়োগ গ্রুপ সিআইটিআইসি’র নেতৃত্বে কনসোর্টিয়াম গঠন করে যার ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকছে চীনের। প্রতিবেশী বন্দরসমূহ বাংলাদেশের প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিপিংসহ ব্যবসা-বাণিজ্য আয়ত্তে নিচ্ছে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হলে বিদেশের ট্রানজিশনাল, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা মাদার পোর্টের (যেমন- কলম্বো, হাম্বানটোটা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর, পোর্ট কেলাং) উপর নির্ভরতা তেমন আর থাকবে না। গভীর সমুদ্র বন্দরের হাত ধরে শিপিং খাত উপখাতসহ অপার সম্ভাবনাময় সমগ্র সামুদ্রিক অর্থনীতির (ব্ল ইকোনমি) বিকাশ ঘটবে। সবল অর্থনীতির সোপান হয়ে উঠবে। বদলে যাবে দেশের অর্থনীতির গতিধারা।
এদিকে ভূমি উন্নয়নসহ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের প্রাথমিক কাজ চলছে। মাতারবাড়িতে প্রাথমিকভাবে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ মেগাপ্রকল্পের জন্য অপরিহার্যতার কারণে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বন্দর সুবিধা। সেই সুবাদে নির্মিত হবে কন্টেইনার ও বহুমুখী সুবিধায় ৪টি জেটি-বার্থ। ২০২৩ সাল নাগাদ জেটিতে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ট্যাংকার ভিড়ানোর টার্গেট নিয়ে কাজ এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। প্রথমে ৪৬০ ফুট দৈর্ঘের কন্টেইনার জেটি-বার্থ এবং ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে বহুমুখী জেটি নির্মিত হবে। ৮ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ এ বন্দরে ভিড়তে পারবে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথেই সমন্বিতভাবে গভীর সমুদ্র বন্দরটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে। বর্তমানে যেসব মাদার ভেসেল বড় আকার ও অধিক ড্রাফটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারেনা, সেগুলো চট্টগ্রাম বহির্নোঙর হয়ে কুতুবদিয়া পর্যন্ত ভিড়ে এবং লাইটার জাহাজের সাহায্যে মালামাল খালাস করে। মাতারবাড়ীতে ভিড়তে পারবে সেসব জাহাজ। তবে মাতারবাড়ী বন্দর হবে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিপূরক। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে মাতারবাড়ীর অবস্থান। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১৪ মাইল ব্যবধান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কারিগরি দিকগুলো তত্ত্বাবধান করছে। বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, সরকারের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে আগামী বছর ২০১৮ সালের শেষের দিকে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মূল কাজ শুরু করবে জাইকা। ২০২৫ সাল নাগাদ পুরোদমে অপারেশনে যাবে বন্দর। এর বিস্তৃতি হবে ৫ কিমি। সম্পূর্ণ বন্দর মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। যার সিংহভাগ অর্থায়নে জাপান জাইকার মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে সময়ের প্রয়োজনে আরও জেটি-বার্থ ও টার্মিনাল স্থাপনের উপযোগী জায়গা রয়েছে। কন্টেইনারবাহী, খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) পণ্য এবং জ্বালানি দ্রব্যসহ বিভিন্ন ধরনের কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা এবং পরিমাণের উপর ভিত্তি করে বন্দরের আয়তন বাড়ানো যাবে। জাইকার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল এ যাবত দফায় দফায় বৈঠক করেছেন মাতারবাড়ী বহুমুখী সমুদ্র বন্দর মেগাপ্রকল্প নিয়ে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন চায় জাইকা। জাপানী সংস্থাটি বলেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জেটি নির্মাণের সাথে সমন্বিতভাবে সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপিত হলে নির্মাণ ব্যয়ও অনেক কমে যাবে। ইতোপূর্বে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল তাদের আর্থ-কারিগরি সমীক্ষায় মহেশখালীর সোনাদিয়াকে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী হিসেবে অভিমত দেয়। তবে মাতারবাড়ীতে এনার্জি হাব প্রতিষ্ঠা এবং সেখানেও একই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো (সী সাইড, বার্থিং ও ড্রাফট) বিদ্যমান থাকায় জাইকাসহ দেশীয় বিশেষজ্ঞরা বন্দর স্থাপনের বিষয়ে একমত। চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেছেন, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ২০২৩ সাল নাগাদ পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম শুরু করার টার্গেট নিয়ে কাজ চলছে। সেখানে ১৬ মিটার ড্রাফটের ২৫০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব। জাইকার গবেষণার আলোকে নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সহায়ক হবে এই বন্দর। তিনি বলেন, এরজন্য আমাদের বাড়তি খরচ নেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা নিয়ে আসা জাহাজগুলোর পোর্ট কলের জন্য বন্দরের প্রয়োজন। তাই তাদের প্রয়োজন। আমরা সুযোগ-সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে সমুদ্র বন্দরটি গড়ে তুলছি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, বঙ্গোপসাগরের মাত্র দুই কিমি ব্যবধানে ১৬ থেকে ১৮মিটার গভীরতা এবং প্রাথমিকভাবে ৩০০ ফুট চওড়া হলেও পরবর্তীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ৭৫০ ফুট চ্যানেল দিয়ে অনায়াসে জাহাজ ভিড়তে পারবে। মাতারবাড়ীর উত্তর দিকে চরের কিনারে চ্যানেল সৃজনের জন্য ড্রেজিং করা হচ্ছে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দক্ষিণ দিকে। আর উত্তরে গড়ে উঠবে গভীর সমুদ্রবন্দর। সেখানে স্থাপন করা হবে একটি করে কন্টেইনার ও বহুমুখী জেটি-বার্থ ও টার্মিনাল। প্রতিটি টার্মিনালে দুটি করে জেটি থাকবে। জাইকার গবেষণায় অপার সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। জাপানের কাশিমা পোর্টের অবস্থান মাতারবাড়ির মতোই। এর অনুসরণে সাজানো হবে সমুদ্র বন্দরটি। গত ১৮ অক্টোবর নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের টিম মাতারবাড়ী পরিদর্শন করেন। এ সময় নৌমন্ত্রী জানান, বাণিজ্যিক বন্দরের (মার্চেন্ট পোর্ট) সুযোগ-সুবিধা ও সম্ভাবনাকে ধারণ করেই গড়ে উঠবে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, বেজা চেয়ারম্যান, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) কো-অর্ডিনেটর, নৌ সচিব, ভূমি সচিব, বিদ্যুৎ সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা মাতারবাড়ী পোর্ট স্থাপনের লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। একটি বৃহৎ বন্দরের প্রাকৃতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের নিরিখে মাতারবাড়ী দেশে শিল্পায়ন-বিনিয়োগ ও সবল অর্থনীতির জন্য বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে গেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।