Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে কত মানুষ চিকিৎসার জন্য যায়, তার সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। তবে সংখ্যাটি যে কয়েক লাখ হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ বিপুল সংখ্যক মানুষ অর্থ ও শ্রম খরচ করে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করছে। কারণ একটাই, সেখানে গেলে ভাল স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাবে। চিকিৎসকদের সঠিক রোগ নির্নয়, ভালো আচরণ, প্রয়োজনের বাইরে একগাদা টেস্ট না করানো, সর্বোপরি তুলনামূলক কম খরচে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নিশ্চিয়তা পাওয়া। রোগীর যত বড় লাইন হোক না কেন, একজন রোগীকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ ও দেখার জন্য যতক্ষণ সময় লাগবে, ততক্ষণই সেখানের চিকিৎসকরা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ ধরনের চিকিৎসা খুব কম বলেই এসব মানুষ ভারতে ছুটে যায়। যাদের বেশি টাকা-পয়সা আছে, তারা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যান। তবে কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের হাসপাতালগুলোর উপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশে রোগীর আস্থা জন্মেছে। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া দেশের জন্য কোনো গৌরবের বিষয় নয়। এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্দশার চিত্রই ফুটে ওঠে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়ম এবং ভুল চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই এ ধরনের অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর কারণে আত্মীয়-স্বজনদের হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যাদের সামর্থ্য আছে ভাঙচুর করার বা রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে কিনা তা জানার সুযোগ রয়েছে, তারাই কেবল প্রতিবাদ করতে পারছে। যারা জানে না, তারা রোগীর হায়াৎ ছিল না বলে ধরে নেয়। চিকিৎসকের যে ভুল ছিল, এটা ধরা বা বোঝার সাধ্য তাদের থাকে না। এখন প্রায়ই আশপাশের মানুষকে বলতে শুনি, অমুক রোগ হয়েছে, ইন্ডিয়া চলে যাও। ভাল চিকিৎসা পাবা, ভাল হয়ে যাবা। তখন মনে হয়, আমরা এত উন্নতি করছি, অথচ চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি নেই! উন্নতি কেবল ঝকঝকে-চকচকে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভবন আর সাইনবোর্ডের। ভেতরে চিকিৎসার উন্নতি নেই। এক রাজধানীর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, শত শত ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল। রাজপথ থেকে শুরু করে অলিতে-গলিতে। এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, সারা দেশে যে ১৫ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, তার অর্ধেকই ঢাকায়। এত এত চিকিৎসা কেন্দ্র, তারপরও মানুষ কষ্ট করে বিদেশ চলে যাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, এগুলোর সিংহভাগই চিকিৎসার নামে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে চিকিৎসা গৌণ, ব্যবসা মুখ্য। সরকারি হাসপাতালগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। নানা ঝক্কি-ঝামেলার পরও প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এসব হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অথচ কিছু দিন আগে বলা হয়েছে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। এ কথা যখন শোনা যায়, তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে লাখ লাখ রোগী ভারত যাচ্ছে কেন? আমাদের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা পাওয়ার এই দুর্দশা কেন? রাষ্ট্র কেন এ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না? বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে বছরে যে শত শত কোটি টাকা চলে যাচ্ছে, তা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
দুই.
সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এখানে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয় ৬৭ শতাংশ এবং ওষুধে ৭০ শতাংশ। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জন্য চিকিৎসা ব্যয় ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ সরকারিভাবেও চিকিৎসা ব্যয় কমানো হয়েছে। এ চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না বাংলাদেশে চিকিৎসার চিত্র কী। এ সুযোগে বেসরকারিভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে-সেখানে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। যেগুলোর চিকিৎসা মান বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে চিকিৎসার নামে চলে ব্যবসা। এমন হতো, ব্যবসা করলেও চিকিৎসাটা যথাযথ পাওয়া যাচ্ছে, তবে আফসোস থাকত না। পরিতাপের বিষয়, এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই, তবে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যায় না। আবার যে চিকিৎসায় যত অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা, তার দ্বিগুণ-তিন গুণ ব্যয় করতে হয়। বলা যায়, এসব চিকিৎসা কেন্দ্র এবং এক শ্রেণীর চিকিৎসক মানুষের অসুস্থতার দুর্বলতম সময়ের সুযোগ নিয়ে যা খুশি তা করে যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রোগও নির্নয় করতে পারছে না। ক্যান্সার না হলেও বলে দেয়া হচ্ছে ক্যান্সার। আমার পরিচিত এক তরুণ সম্প্রতি দাঁতের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। তার মাড়ি ফুলে যায়। দন্ত চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে সাত দিনের এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। তারপরও ভাল না হলে তার একটি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল দেখে চিকিৎসক বলে দেন তার মাড়িতে ক্যান্সার হয়েছে। তরুণের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে সে ভারতের বোম্বেতে একটি বিখ্যাত ক্যান্সার হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে বলা হয়, এটা তেমন কিছু নয়। লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে অল্প দিনের মধ্যেই ভাল হয়ে যাবে। কোনো ধরনের ক্যামো (ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত পদ্ধতি) দিতে হবে না। তরুণ নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তরুণ সেখানের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলল, হাসপাতালে অনেক ভোর থেকেই লাইন ধরতে হয়। অনেক মানুষ দিনের আলো না ফুটতেই লাইন ধরে। তিন-চার ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কারণ লাইনের বাইরে কোনো রোগীই তারা দেখে না। যত বড় ভিআইপি হোক না কেন, ক্ষমতা ব্যবহার করে দেখানোর সুযোগ নেই। হাজার হাজার রোগী লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। চিকিৎসকদের মধ্যেও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। অসীম ধৈর্য্য ধরে তারা রোগী দেখে। একজন রোগীকে ভাল করে দেখতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ দেখে। সবচেয়ে বড় কথা, ডাক্তারের কাছে গেলে তার কথা শুনেই মন ভাল হয়ে যায়। এমনভাবে আচরণ করে যে, কিছু হয়নি। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অসংখ্য রোগী প্রতিদিন সে হাসপাতালে যায়। একবার দেখার পর এমনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা দেয়া হয় যে, সে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশে চিকিৎসা করতে পারে। জরুরী পরিস্থিতি না হলে সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ই-মেইলে যোগাযোগ করেও চিকিৎসা নেয়া যায়। এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা হলে রোগী মানসিক শক্তির জোরে এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। আমাদের দেশে কবে এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা হবে! তরুণের কথা শুনে ভাল লাগল এ কারণে যে, কয়দিন আগেও সে ক্যান্সার হওয়ার সংবাদ শুনে মৃত্যু ভয়ে আক্রান্ত হয়েছিল, এখন সে পুরোপুরি সুস্থ হতে শুরু করেছে। দুঃখ লাগল, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র দেখে। অনেকে বলতে পারেন, এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। না, এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। শতকের মধ্যে একটা হলে তা ব্যতিক্রম হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, যে লাখ লাখ মানুষ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে ভারত যাচ্ছে, সেগুলো কোনোভাবেই ব্যতিক্রমী ঘটনা হতে পারে না। এটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে তারা সেখানে যাচ্ছে। আমাদের দেশে জটিল রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তো অনেক চিকিৎসক রীতিমতো ব্যবসা করে চলেছে। মেয়েদের ব্রেস্ট ক্যান্সার এখন বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ চিকিৎসায় আমাদের দেশে চিকিৎসক সংখ্যা খুবই কম। যে কয়জনের নামডাক আছে, তাদের অনেকে এ ধরনের রোগীদের নিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা করে যাচ্ছে। আমার পরিচিত এক মহিলা বুকে লাম্প বা পিন্ড নিয়ে এক নামডাকওয়ালা মহিলা চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসাধীন ছিলেন। যতবার চিকিৎসকের কাছে যান, ততবারই রক্ত পরীক্ষা, বুকের আল্ট্রাসনোগ্রাম ধরিয়ে দেন। আবার এ পরীক্ষা রোগীর ইচ্ছামতো জায়গা থেকে করতে পারবেন না, চিকিৎসকের নির্দিষ্ট করা ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে করতে হয়। এর বাইরের রিপোর্ট তিনি গ্রহণ করেন না। বাধ্য হয়েই চিকিৎসকের নির্ধারিত স্থান থেকেই পরীক্ষা করতে হয়। এভাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ব্যথার ওষুধ দিয়েই মাসের পর মাস চিকিৎসা চলাকালীন একদিন রোগীকে চিকিৎসক জানালেন, তার পিন্ডটি ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। টাকা-পয়সা রেডি করেন, দ্রæত অপারেশন করতে হবে। রোগী থ হয়ে যান। চিকিৎসককে বললেন, আপনিতো আগেই পিন্ডটি অপারেশন করে ফেলতে পারতেন। তখন এটি ফেলে দিলে তো আর ক্যান্সারে পরিণত হতো না। চিকিৎসক চুপ করে থকেন। ক্ষোভে-দুঃখে রোগী সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তার কাছে এবং দেশে এর অপারেশন করবেন না। তিনি বিদেশ চলে যান। বুঝতে বাকি থাকে না, চিকিৎসক এই রোগীকে নিয়ে মাসের পর মাস তার ব্যবসা চালিয়েছেন এবং তার মতো আরও অনেক রোগীকে নিয়ে একইভাবে ব্যবসা চালাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে বুকে ব্যথা নিয়ে আমার এক পরিচিত ব্যক্তি চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক কোনো ধরনের পরীক্ষা না করেই বললেন, এ কিছু না। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। তিনি হাসতে হাসতে রোগীকে বলেন, যদি কোনো বেসরকারি হাসপাতালে যেতেন তবে, তৎক্ষণাৎ দামদস্তুর করে আপনার হৃৎপিন্ডে রিং পরিয়ে দিত। আপনাকে হার্টের রোগী বানিয়ে ফেলত। একজন সৎ চিকিৎসক যখন এ কথা বলেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের নামকরা অনেক বেসরকারি হাসপাতাল কীভাবে রোগীর অসুস্থতার সুযোগে ব্যবসা করে চলেছে।
তিন.
বাংলাদেশে প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে কতজন মানব সেবার ব্রতে ব্রতী হয়ে চিকিৎসক হয়, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি যেসব মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, সেগুলোর মান নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, এমন অনেক মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, যেগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবের পাশাপাশি ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য জরুরী উপকরণই নেই। এসব মেডিক্যাল কলেজ থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাস করছে, তারা কেবল সার্টিফিকেটধারী চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য সবার থাকে না। কেবল ধনী ব্যক্তিদের পক্ষেই এখানের পড়ার খরচ চালানো সম্ভব। সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন এমন স্বপ্ন পূরণ করার জন্য অনেক অভিভাবক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি করান। সেখানে সন্তান প্রকৃত অর্থে চিকিৎসক হতে পারছে কিনা, এ খোঁজ-খবর নেন না। ফলে পাস করার পর সন্তান কেবল সার্টিফিকেটধারী ডাক্তারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটি এখন অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত চিকিৎসক হওয়ার বিষয়টি যে অনেক সাধনার ব্যাপার, তা খুব কমই উপলব্ধি করা হয়। এই যে মেডিক্যাল কলেজ নামে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, এগুলোর মূল কাজই হচ্ছে ব্যবসা করা। অভিভাবকরাও আনন্দ পান সন্তান ডাক্তার হয়েছে। চিকিৎসার মতো একটি মহান পেশা নিয়ে এমন ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া আর কোথাও আছে কিনা, জানি না। সার্টিফিকেট সর্বস্ব এসব চিকিৎসক যখন পেশার সাথে জড়িত হয়, তখন কি কোনো রোগী নিরাপদ থাকতে পারবে? ডাক্তার বানানো থেকে শুরু করে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলার পেছনে সেবার পরিবর্তে কাজ করছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা কম থাকার কথা। ফলে অপচিকিৎসা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। যে কয়টি নামকরা বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটির ক্ষেত্রেও রোগীকে জিম্মি করে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজন না থাকা সত্তে¡ও রোগীকে আইসিইউতে রেখে মোটা অংকের বিল উঠানো একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ও অস্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের পক্ষে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। যেখানে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং এর ব্যয় সহজ ও সহনশীল পর্যায়ে থাকা প্রয়োজন, সেখানে দেখা যাচ্ছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে যদি অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা যেত, তবে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হতো না। বরং ভারতের মতো আশপাশের দেশ থেকে রোগীরা বাংলাদেশে ছুটে আসতো। সরকারি হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে না উঠার সুযোগেই একশ্রেণীর মুনাফাখোর বেসরকারিভাবে চিকিৎসাকে অতি দামী পণ্যে পরিণত করেছে। মানুষের সবচেয়ে অসহায় সময়কে পুঁজি করে যেমন খুশি তেমন অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এর পরিবর্তে সঠিক চিকিৎসাও মিলছে না। এর ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এ সুযোগ ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালগুলো নিচ্ছে। তারা তুলনামূলক কম খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এমনকি বাংলাদেশে তাদের যোগাযোগ সেন্টার এবং রোগীদের টার্গেট করে আলাদা শাখা খুলছে। রোগীদের আস্থা অর্জন করার জন্য মানসিক শক্তি যোগানো থেকে শুরু করে সাশ্রয়ী খরচে ওয়ান টাইম চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশের মানুষও আস্থাশীল হয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছে।
চার.
অসুস্থ মানুষ শুধু পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয় না, দেশ ও জাতিরও বোঝায় পরিণত হয়। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারও বোঝা হয়ে চেপে বসে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিন দিন যেভাবে বাণিজ্যিক রূপ লাভ করছে, তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রিয়জনকে সুস্থ্য করে তুলতে সর্বস্ব বিকিয়েও যখন মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাওয়া যায় না, তখন সেই পরিবারটির অবস্থা কী হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। এসব পরিবারের দুঃখ-কষ্ট নীরবে-নিভৃতে থেকে যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন বলেছেন, রোগ হলে মানুষ এমনিতেই বিপদে পড়ে যায়। তার ওপর যদি চিকিৎসা নিতে গিয়ে এ বিপদ আরো বাড়ে তাহলে মানুষ রোগে বাড়িতে বসে ভুগলেও খরচ সামলাতে না পারার ভয়ে চিকিৎসার ধারেকাছে যাবে না। অথচ চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় এড়ানো যাবে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, দেশে এখন চিকিৎসা ব্যবসার মওকা শুরু হয়েছে। যে যেভাবে পারছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ২ টাকার জিনিস অবলীলায় ১০ টাকা নিয়ে নিচ্ছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা ব্যয় এখন বাংলাদেশেÑএটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার। তিনি বলেন, মানুষকেও সচেতন হতে হবে। বড় সইনবোর্ড, ঝকঝকে সাজসজ্জা দেখে ভালো চিকিৎসার আশায় কোথাও গেলে গলা কাটবেই। আগে জানতে ও বুঝতে হবে, খোঁজখবর নিতে হবে কোন চিকিৎসায় কত খরচ লাগে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খরচের কারণে চিকিৎসা এখন মানুষের কাছে বড় একটি ভীতিকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন চিকিৎসা ব্যয় যত বাড়ছে, মানুষ তত বেশি অসহায় হয়ে পড়ছে। চিকিৎসা বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাবেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। অনেক সময় ব্যয়বহুল চিকিৎসা করতে গিয়ে অর্থাভাবে মাঝপথে চিকিৎসা থামিয়ে দিতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। বেসরকারিভাবে যেসব চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এবং উঠছে, তাদের মূল লক্ষ্য যে ব্যবসা, তা সবার জানা। তারপরও প্রিয়জনের চিকিৎসার্থে এসব মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গতি থাকে না। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। চিকিৎসা সেবায় যে অরাজকতা চলছে, তা দেখার যেন কেউ নেই। সরকারেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার উচিত বেসরকারি কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মান কী অবস্থায় রয়েছে, তা মনিটর করা। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা রয়েছে। কোন চিকিৎসায় কত খরচ হতে পারে তা বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে একটি মূল্যতালিকা প্রস্তুত করে দিতে পারলে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ অনেখানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, চিকিৎসা সেবায় যারা নিয়োজিত তাদের বিবেক এবং মানবিক বিষয়টি বড় করে তোলা। এ দায়িত্ব মানুষ হিসেবে তাদের নিজেদেরই পালন করতে হবে। মানুষের অসহায় সময়ের সুযোগ নেয়া কোনোভাবেই বাঞ্চনীয় হতে পারে না। অন্যদিকে সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত চিকিৎসা সেবামূল্য সর্বনি¤œ পর্যায়ে রাখা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় সবচেয়ে বেশি-এটি কোনো গৌরবের বিষয় হতে পারে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাস্থ্য


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ