Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার অর্ধেক সময় পর চাল বরাদ্দ হলেও জেলেদের হাতে পৌঁছেনি

দক্ষিণাঞ্চলের জেলে পল্লীগুলোতে হতাশার দীর্ঘশ্বাস

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আশ্বিনের বড় পূর্নিমার মূল প্রজনন মওসুমে সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধের ২২দিনের নিষেধজ্ঞার অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। নিষেধাজ্ঞা আরোপের ১১দিনের মাথায় ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে মৎস অধিদফতরের চাহিদার অর্ধেক পরিমান চাল বরাদ্ধ দেয়া হলেও তা বিতরণ শুরু হয়নি এখনো। ১২অক্টোবর বরাদ্বের আদেশ জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছার পরে তা উপজেলা প্রশাসনের কাছে পাঠান হয়েছে। তবে ১৩ ও ১৪ অক্টোবর সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় পরবর্তী কার্যক্রম থমকে গেছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্বের আদেশ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে পাঠাবার পরে জেলেদের মাঝে চাল বিতরণের সিøপ সরবারহ এবং তা স্থানীয় খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলনে ২২ অক্টোবর পেরিয়ে যাবে। ততদিনে জেলেদের সাগর উপক‚ল ও নদ-নদীতে মাছ ধরতে নামতে হবে। অথচ টানা ২২দিন জীবিকার সুযোগ বন্ধ থাকায় দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের উপক‚লভাগের জেলেরা যথেষ্ঠ কষ্টে আছেন।
মৎস অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে গত ১অক্টোবর থেকে ২২তারিখ পর্যন্ত মৎস আহরণে বিরত থাকা বেকার জেলেদের খাদ্য সংস্থানে বিশেষ ভিজিএফ-এর মাধ্যমে ৪০ কেজি করে চাল প্রদানের অনুরোধ জানানো হলেও বিষয়টি নিয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয় যথেষ্ঠ বিলম্বিত সাড়া দিয়েছে। উপরন্তু মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর দেশের জেলে পরিবার পিছু ৪০ কেজি করে চাল প্রদানের অনুরোধ জানালেও বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে তার অর্ধেক, ২০ কেজি করে। এবার দেশের উপক‚লীয় ১১২টি উপজেলার ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২টি পরিবারকে ২০ কেজি করে ৭হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্ব দিয়েছে ত্রান মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ২ লাখ ২৭ হাজার ৯৪৩টি জেলে পরিবারের জন্য বরাদ্বকৃত চালের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫৮ কেজি। তবে এ বিভাগে নিবন্ধিত ইলিশ জেলে পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ১৬ হাজার। ফলে ১ লাখ ৯ হাজার জেলে পরিবার কোন খাদ্য সহায়তা পচ্ছে না।
গতবছরও ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রায় ২.৮০ লাখ জেলেকে ২০ কেজি করে সাড়ে ৪ হাজার টন চাল খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছিল। বিগত বছরগুলোতে উপক‚লের মূল প্রজনন এলাকার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সারা দেশের নদ-নদীতে ইলিশ আহরণ সহ পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু চলতি বছর ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাইরেও উপক‚লের ১২টি জেলার সব নদ-নদীতে জাল ফেলাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে ঐসব জেলার জেলেদের ইলিশ বাদে অন্য মাছ আহরনেরও কোন সুযোগ নেই।
জেলেদের মতে, বিকল্প কর্মসংস্থান বা খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা না করে নদীতে নামতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তাদের এখন মহা দুর্দিন। যদিও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশ সম্পর্কে জেলেসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও যথেষ্ঠ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। মূল প্রজনন মওসুমে ইলিশ আহরণে সাধারন জেলেরাও খুব একটা আগ্রহী নয়। তবুও পেটের তাগিদেই অনেক জেলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছে বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধীক মহল। ওয়াকিবাহাল মহলের মতে, টানা ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার শুরুতেই জেলেদের সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে মূল প্রজনন মওসুমে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরো বেশী কার্যকর হত।
এদিকে গত ১ অক্টোবর থেকে ইলিশ আহরণে নিষেধজ্ঞা অমান্য করার অপরাধে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক‚লীয় এলাকায় ইতোমধ্যে সহ¯্রাধীক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে প্রায় হাজারখানেক জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। আদালত এসময়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় ছাড়াও জাল আটক ও বাজেয়াপ্ত করেছে প্রায় সোয়া ২ লাখ মিটার। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। আভিযান চলাকালে ৩২ মেট্রিক টনের মত ইলিশ ও জাটকা আটক করা হয়েছে। গত ১৪ দিনে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার অভিযান পরিচালনা করেছে মৎস অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন। প্রজনন মওসুমে ইলিশ আহরণে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে জেলা প্রশাসন ছাড়াও বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, কোষ্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও র‌্যাব ছাড়াও বিভিন্ন জেলা পুলিশও কাজ করছে বলে মৎস অধিদফতর জানিয়েছে।
কিন্তু জেলেদের অভিযোগ, ‘সরকার ও প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিন থেকেই বিভিন্ন নদ-নদী ও সাগর উপক‚লে অভিযানে নেমেছে। আমাদের পেটে যে ভাত নেই, সে খবর তো কেউ রাখছে না’। বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা ও পিরোজপুরের একাধীক ইলিশ মোকামে এখন শুনশান নীরবতা। বন্ধ উপক‚লের অন্তত ৩ হাজার বরফকলও। আর জেলে পল্লীগুলোতে হতাশার দীর্ঘশ্বাস। বেশীরভাগ জেলে পরিবারই খুব কষ্টে সময় পার করছেন। সব জেলেই ভেবেছিল গতবছরের মত এবারো অন্তত কিছু খাদ্য সহায়তা মিলবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা বলবতের দুই-তৃতীয়াংশ সময় পার হলেও এখনো জেলোরা কোন চাল হাতে পায়নি।
মৎস অধিদফতরের মতে, দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে পরিবার ইলিশ আহরনের সাথে জড়িত। যার ৩২% সার্বক্ষনিক ও ৬৮% খন্ডকালীন এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়াও ইলিশ বিপনন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাল, নৌকা ও বরফ তৈরী এবং মেরামত কাজে আরো ২০-২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। দেশের ৬টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেই প্রায় সোয়া তিন লাখ জেলে এ পেশার সাথে জড়িত বলে মৎস অধিদফতর জানিয়েছে। যার ৬৫% সার্বক্ষনিকভাবে ইলিশ আহরনে জড়িত বলে মৎস অধিদফতরের এক জরিপে বলা হয়েছে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশী। মৎস সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে এর অবদান প্রায় ১২Ñ১৩%। এমনকি সারা বিশ্বে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ক্রমশ হৃাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এখন তা গড়ে ৫% স¤প্রসারিত হচ্ছে। গত দেড় দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
অথচ ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে গত দু’বছর ধরে দেশে কোন প্রকল্পও নেই। তবে মৎস অধিদফতর থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি প্রকল্প পেস করার পরে তা মন্ত্রণালয় হয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পৌঁছেছে। মৎস গবেষনা ইনষ্টিটিউট থেকেও ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে একটি গবেষনা ধর্মী প্রকল্প মন্ত্রনালয়ে পেস করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মৎস বিজ্ঞানীদের মতে, অভিপ্রায়নী মাছ ইলিশ সারা বছরই কমবেশী ডিম ছাড়ে। কিন্তু আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পরের সময়টিতেই সাগর থেকে ছুটে এসে অপেক্ষাকৃত মিঠাপানির উপক‚লীয় এলাকায় প্রায় ৮০ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ে বলে বিজ্ঞানীগন নিশ্চিত হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের মৎস আইনের আওতায় আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পরে ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ সহ উপক‚লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সহ ১২টি জেলার নদ-নদীতে এবারো সব ধরনের মৎস আহরণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে ১ অক্টোবর থেকে। এ নিষেধাজ্ঞা বলবত করনে উপক‚লীয় ৩০টি জেলার দেড়শ’ উপজেলায় মৎস অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের ৫৯ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একাধীক মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। মৎস অধিদপ্তর কেন্দ্রীয় ভাবেও বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছে। মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ভিন্ন একটি কমিটি মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করছে।
আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে থেকেই মা ইলিশের দল ঝাকে-ঝাকে সাগর মোহনা সহ ভাটি মেঘনার ভোলা ও ল²ীপুর জেলার মধ্যবর্তি ঢালচর, মনপুরা, মৌলভীর চর, কালির চর ও পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদী এলাকার প্রায় ৭হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছুটে এসে ডিম ছেড়ে থাকে। ফলে ইলিশের মূল প্রজনন ক্ষেত্র হিসেব উপক‚লের ঐ ৭হাজার বর্গ কিলোমাটার এলাকাকে চিহ্নিত করে গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ দিন উপক‚লের ১২টি জেলার সব নদ-নদীতেই সব ধরনের মৎস আহরনই বন্ধ রাখা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

৫ মার্চ, ২০২২
১২ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ