হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
চলমান বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি প্রভাব যতই দুর্বল ও শিথিল হচ্ছে সেখানে যেন একধরনের নেতিবাচক শুন্যতা গ্রাস করছে। আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পতনের শেষ ধাপের সূচনা হয়েছিল ২০০১ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে জর্জ বুশের মুসলিম বিরোধি ক্রসেড’র মধ্য দিয়ে। ইতিপূর্বে মধ্যযুগে সামন্তবাদি খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছিল তা’ দুইশ বছরের বেশী সময় স্থায়ী হয়েছিল। সে সব যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া। ঐক্যবদ্ধ মুসলিমদের হাত জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়া খৃষ্টানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে বিংশ শতকের দু’টি বিশ্বযুদ্ধে মুসলমানদের সেই শক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও বহুধাবিভক্ত করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিরা ফিলিস্তিনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হাজার বছর আগে হেরে যাওয়া ক্রুসেডের চুড়ান্ত শোধ গ্রহনের পথ রচনা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জাতিকে নিজ ভ’-খন্ড থেকে বিতাড়িত করে কিছু ভাসমান লোককে জড় করে একটি সত্যিকারের স্বাধীন ও রাজনৈতিক জাতিসত্তা নির্মান করা যে সম্ভব নয়, ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর বিগত সত্তুর বছরে তা প্রমানীত হয়েছে। এ কারণেই নতুন সহশ্রাব্দের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আরেকটি ক্রুসেডের ঘোষনা দিতে হয়েছিল। যদিও সেই ক্রুসেডে বিশ্বের খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কোন সমর্থন ছিলনা। মূলত: পশ্চিমা কর্পোরেট পুঁজিবাদের পাওয়ার এলিটদের স্বার্থে মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিনিয়োগ লাভজনক করতেই এই কথিত অন্তহীন যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল। এই যুদ্ধের পর গত ১৬ বছরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শক্তি অনেক দুর্বল ও নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের শিথিল মুষ্ঠির ভেতর ঢুকে পড়ছে আরো কদাকার, বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত আঞ্চলিক শক্তির খড়গ। বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিন এশিয়ার এ অংশে ঘটে চলা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তারই প্রচ্ছন্ন ছায়া দেখা যাচ্ছে। যেখানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে প্রায় অর্ধশত কোটি মসুলমানের সামনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার যখন আরাকান প্রদেশের প্রায় তিন মিলিয়ন রোহিঙ্গা মুসলমানকে ইতিহাসের নজিরবিহীন পন্থায় নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে তখন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি শক্তির পক্ষ থেকে কোন শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা।
পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডার কারণে এটা অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা নয়। বিশেষত: ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একজন ইসলাম বিদ্বেষী-বর্ণবাদি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সময়ে একটি মুসলিম সম্প্রদায় এথনিক ক্লিনজিংয়ের সম্মুখীন হওয়ার সময় তাদের নিরবতার মানে বিশ্বসম্প্রদায়ের বুঝতে বাকি নেই। তবে মানবতার দাবী যদি কারো কাছে গুরুত্ববহন নাও করে, শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দাবীকে সামনে রেখে চীন ও ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তি কি করে এমন একটি রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক গণহত্যার ঘটনাকে মেনে নিচ্ছে তা এক বিষ্ময়কর প্রশ্ন। যেখানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার সরকারকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করছে। বার্মার ডি-ফ্যাক্টো নেতা ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির নোবেল পুরষ্কারসহ অতীতে অর্জিত সব সম্মাননা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সুচিকে দেয়া সম্মাননাসহ তার প্রতিকৃতি ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নামিয়ে ফেলা হচ্ছে। তখন চীন এবং ভারতের মত দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুচির সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীদের গণহত্যার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করার ঘটনা বিশ্বের জন্য এক নতুন বিষ্ময়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর এমন নির্মম নির্লজ্জ গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও বিশ্বের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীনের এমন ভ‚মিকায় যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, চলতি শতকের শেষার্ধে বিশ্ব যে নতুন একটি এশীয় শতাব্দীতে প্রবেশ করতে চলেছে বলে ভবিষদ্বানী করা হচ্ছে, সেখানে চীনের নেতৃত্ব গ্রহনের যোগ্যতা আছে কি? এমনিতে চীন কমিউনিজমের রেজিমেন্টেড অর্থ-বাণিজ্যব্যবস্থা থেকে গত কয়েক দশকে একটি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে তার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হলেও চীন এখনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আয়ত্ব করতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি। যেখানে জায়নবাদি ষড়যন্ত্র ও কর্পোরেট প্রোপাগান্ডা সত্তে¡ও আমেরিকা ও ইউরোপ এখনো মাল্টি কালচারালিজমে বিশ্বাস করছে, নানা রকম প্রতিবন্ধকতার পরও সেখানে মুসলমানসহ অন্যান্ন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেখানে চীনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভিন্ন মতাবলম্বিরা এখনে যেন স্তালিন বা ম্যাকার্থিজমের যুগের চরম বৈরিতার সম্মুখীন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিংয়ে চীন সরকারের সমর্থন যখন বিশ্বে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে, তখন চীনে শতাব্দীকাল ধরে নিপীড়িত উইঘুর মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর নজিরবিহিন হস্তক্ষেপ করল চীনা প্রশাসন। শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান যখন নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার এই সময়ে চীন সরকার জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ঘরে থাকা পবিত্র কোরআন শরীফ ও নামাজ পড়ার জায়নামাজসহ ধর্মীয় গ্রন্থাবলী ও সামগ্রী পুলিশের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করেছে।
সিরিয়া যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক ইউরোপীয় রিফিউজি ক্রাইসিসের সময় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আহ্বানে ইউরোপের দেশগুলো কয়েক মিলিয়ন শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। গণহত্যার সম্মুখীন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিও অনুরূপ আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এসব আহ্বানে সাড়া না দিয়ে চীন-ভারত ইসলাম ও রোহিঙ্গা বিরোধি অবস্থান আরো সুদৃঢ় করেছে। সমুদ্রপথে পাড়ি দেয়া রোহিঙ্গাদের ভারতে প্রবেশের সব পথ কঠোরভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এমন ঘোরতর বিপদের সময় ইতিপূর্বে ভারতে অবস্থানরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা বললেও রাখাইনে এথনিক ক্লিনজিং বন্ধ বা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারত কোন ভ‚মিকা গ্রহণ দূরের কথা মধ্যস্থতাকারির ভ‚মিকা পালনেও অনীহা প্রকাশ করেছে। এ অবস্থান চীন ও ভারতের ইসলাম বিদ্বেষী ভ‚মিকা হিসেবেই শুধু নয়, বরং মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের অমানবিক অবস্থান হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। ইউরোপ আমেরিকায় ইসলামোফোবিয়া বা ব্যাপক ইসলাম বিরোধি প্রপাগান্ডা থাকলেও সেখানে সাধারণ মানুষের ঘর থেকে কোরআন বাজেয়াপ্ত করার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় ফরমান বা নির্দেশনা জারি করে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাস বা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া যায়না। এতে তাদের মধ্যে জাতিসত্তা ও স্বাধীনতার স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে হাজার হাজার কোরআনের হাফেজ, আলেমেদ্বীন রয়েছেন। কোন সরকারী নির্দেশনা দিয়ে তাদের অন্তর থেকে কোরআনের বাণী বা শিক্ষা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ঘোষিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল টার্গেট হচ্ছে মুসলমানরা। দেড় দশকের বেশী সময়ের এই যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ দখল ও ডি-স্ট্যাবিলাইজ করে দেয়ার সাথে সাথে পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে নানাবিধ বৈষম্যনীতি আরোপ করার পরও সেখানে ইসলামের অগ্রযাত্রা এতটুকু হ্রাস পায়নি। উল্টো পশ্চিমা তরুন প্রজন্ম ইসলাম ও কোরআনের শিক্ষার প্রতি অনসুন্ধিৎসু ও আগ্রহী উঠার মধ্য দিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ বেড়ে যেতে দেখা গেছে। অত্যন্ত ধার্মিক ও ঐতিহ্য প্রিয় রোহিঙ্গা বা উইঘুর মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়িনের বিরুদ্ধে আরো বেশী শানিত ও প্রতিবাদি হয়ে উঠেছে। চীনা কর্তৃপক্ষের কোরআন, জায়নামাজ ও তসবিহ বাজেয়াপ্তের নির্দেশে বিক্ষুব্ধ সেনেগালের জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার( যিনি চীনের সাংহাই সিনহুয়া ক্লাবেও খেলে থাকেন) ডুম্বা এক টুইট বার্তায় বলেছেন, যদি চাইনিজরা জানত যে মুসলমানরা জায়নামাজ ছাড়া মাটিতে বা মেঝেতেই নামাজ পড়তে পারে এবং হাজার হাজার মুসলমানের কোরআন মুখস্ত আছে, সব মুসলমান কোরআন না খুলেই নামাজ পড়তে পারে, তাহলে তারা হয়তো মুসলমানদের হৃদপিন্ড খুলে জমা দেয়ার আদেশ দিতো। ডুম্বার এই টুইটবার্তাটি রিটুইট করেছেন ৩৭ হাজার মানুষ। রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি মানবতা বিরোধি অপরাধে লিপ্ত হওয়ার বিরুদ্ধে শুধু মুসলমান নয়, সারা বিশ্বেরই এখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া কর্তব্য বলে মন্তব্য করেছেন এই সেনেগালিজ ফুটবল তারকা। সাধারণ মানুষের কথাবলার পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও নানা ক্ষেত্রে তারকা ব্যক্তিত্বরা শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে প্রতিবাদ প্রতিরোধের পথ রচনা করতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও এমন সব তারকারা অসাধারণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন।
গত সপ্তায় কলাম্বিয়ার রাজধানী বগোটায় অনুষ্ঠিত ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ড সামিটে অংশ নিয়ে আইরিশ তারকা গায়ক ও লেখক বব গেল্ডফ মিয়ানমারের ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার জন্য অং সান সুচিসহ বিশ্ব নেতাদের নাম ধরে ধরে দোষারোপ করেছেন। বিশ্বের ১৯৬টি দেশ থেকে অংশগ্রহনকারি প্রায় দেড়হাজার ডেলিগেটের মধ্যে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিক কোফি আনানসহ শান্তিতে নোবেল জয়ী বেশ কিছু বিশ্বনেতা উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বব গেল্ডফ বিশ্বের নানা স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন, চিনা প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মত নেতাদের পাশাপাশি বিশ্বের স্বৈরাচারি শাসকদের প্রতি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি অং সান সুচিকে ইতিহাসের ঘৃন্য এথনিক কিèনজার বলে অভিহিত করেন। বব গেলডফের এই বক্তব্য অং সান সুচির কাছে দু:খজনক বলে মনে হয়েছে। মিয়ানমারের রাজধানী নেইপেদোতে সুচি বব গেল্ডফের বক্তব্যকে ‘ডিসগ্রেস’ বা মানহানিকর বলে আখ্যায়িত করেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সহাবস্থানের রাজনীতিকে সামনে রেখে একজন শান্তির প্রবক্তা, যিনি বিশ্বসম্প্রদায় নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভ’ষিত করেছিল তিনি কি করে এমন হিংস্র রক্তপিপাসু শক্তির হত্যাযজ্ঞের প্রতিভ’ হয়ে উঠতে পারেন, অং সান সুচি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। এক সময়ের মুক্তির প্রতিক নন্দিত রাজনৈতিক তারকা এখন বিশ্বব্যাপী নিন্দিত গণধিকৃত নটরিয়াস এথনিক ক্লিনজার।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি প্রক্রিয়ায় উল্টো হাওয়া বইতে শুরু করে। ইসরাইলের যুদ্ধবাজ নেতা নেতানিয়াহুর সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম সাক্ষাতেই ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান থেকে সরে দাড়ানোর ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অধিকৃত এলাকাগুলোতে দ্বিগুন উৎসাহে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের অর্কেস্ট্রেটেড যুদ্ধে যখন ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নগরীগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হচ্ছিল, ইসরাইল তখন অবরুদ্ধ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী জনপদগুলোর উপর সর্বাত্মক সামরিক আগ্রাসন চালায়। তবে হিজুবল্লাহ ও হামাসের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে প্রথম বারের মত ২০০৬ এবং ২০১৪ সালে বড় ধরনের কৌশলগত ও সামরিক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় আইডিএফ। সে সব যুদ্ধে ইসরাইলীদের পরাজয় মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের মানচিত্র বদলের পরিকল্পনায় বড় ধরনের ছেদ টেনে দিতে বাধ্য করে। অত:পর ইরানের সাথে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে জায়নবাদিদের ইরান আক্রমনের ষড়যন্ত্রও ভেস্তে যায়। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেই ষড়যন্ত্র পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করছে জায়নবাদিরা। চলতি বছরের শুরুতে জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদে মুসলমানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং নজরদারি ক্যামেরা স্থাপনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের কাছেও কৌশলগত পরাজয় ঘটে ইসরাইল সরকারের। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় সম্প্রতি ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন এবং চুড়ান্তভাবে পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের দখলে নেয়ার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছেন। ইসরাইল রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদি নীতি ও পরিকল্পনা পুনরুল্লেখ করে নেতানিয়াহুর এই ঔদ্ধত্তপূর্ণ ঘোষনার পর লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ইসরাইলের প্রতি পাল্টা হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। হাসান নাসরাল্লাহ’র এই হুশিয়ারী ব্যতিক্রমী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জায়নবাদি ইসরাইল ধ্বংস হওয়ার আগেই ধর্মপ্রান ইহুদিদের ইসরাইল ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, জায়নবাদ মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও অভিন্ন শত্রু। তবে হাসান নাসারাল্লাহ্র এই আহ্বানের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন ও ব্যক্তি জায়নবাদি ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষনা দিয়েছে। হাসান নাসরাল্লাহ কণ্ঠে সে সব ধর্মপ্রান মানবতাবাদি ইহুদিদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নেতানিয়াহু ও ইসরাইলের মিলিটারি কমান্ডাররা যে সব যুদ্ধ ও সম্প্রসারণবাদি পরিকল্পনার কথা বলছেম সে সম্পর্কে ইহুদিদেরকে সকর্ত করেন তিনি। তাদের এসব পরিকল্পনা ইসরাইল রাষ্ট্রের চুড়ান্ত ধ্বংসই ডেকে আনবে। তারা যদি তাদের সরকারের জায়নবাদি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাড়াতে না পারে তাহলে আগামী যুদ্ধে ইসরাইলের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেতে পারে। তার আগেই ইহুদিরা ইসরাইলীদের ইসরাইল ত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন হাসান নাসরাল্লাহ। বিগত দুইটি যুদ্ধে হামাস ও হেজবুল্লাহর কাছে আইডিএফ’র পতনের পর আগামী যুদ্ধের যে প্রস্তুতি চলছে তাতে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি ধ্বংস হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইসরাইলীরা যখন বড় বড় আরব রাষ্ট্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তখন নিজেদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি ধ্বংসের ঝুঁকি তাদের নিতেই হবে। যেখানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ পতনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে সেখানে মজলুম ফিলিস্তিনী ও আরবদের সাথে চুড়ান্ত যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল ইসরাইলের পতন অনিবার্য। কয়েক বছর আগে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পুরোধা নীতি নির্ধারক ব্যক্তিত্ব হেনরি কিসিঞ্জার এক দশকের ইসরাইল রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। এটি নিছক কোন অনুমান নির্ভর ভবিষ্যদ্বানী নয়। প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ষোলটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক যৌথ গবেষনায় ৮২পৃষ্ঠার এক রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। এই গবেষনাপত্রের শিরোনাম দেয়া হয়েছিল প্রিপেয়ারিং ফর অ্যা পোস্ট ইসরাইল মিডল-ইস্ট’ বা ইসরাইল পরবর্তি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। কিসিঞ্জার ২০২২ সালের পর ইসরাইলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও গোয়েন্দা গবেষকরা সময়সীমা সুনিদ্দির্ষ্ট করেননি। ইসরাইল পরবর্তি বিশ্বে মুসলমানদের ঐক্য, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সুসংহত হবে। রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দি শক্তি হিসেবে চীন, রাশিয়ার মত শক্তির পুঁজিবাদি স্বার্থপরতার ভ‚মিকাই ধরা পড়েছে। তাদের কাছে যুদ্ধমুক্ত, শান্তিকামী মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা করা যায়না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।